বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নির্মূল করা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মূল পরিকল্পনা বলেই মনে হচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জনকারী এই মহান পরিবারকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি সব সময় এক নাম্বার শত্রু বলে বিবেচনা করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ জাতির জনক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করেন। ১০ বছরের শিশুপুত্র রাসেলও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সৌভাগ্যক্রমে সেইদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশের বাইরে অবস্থান না করলে খুনিদের উদ্দেশ্য পুরোমাত্রায় সফল হতো। দেশের বাইরে থাকার কারণে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেছে বলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরবার সুযোগ পান। সেই থেকে তিনি নিরন্তন সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুদের মোকাবেলা করে তিনবার ক্ষমতাসীন হন। এখনো তিনি ক্ষমতায় আছেন। তার রাজনীতিতে প্রবিষ্ট হওয়ার মূল লক্ষ্য ছিল দেশ এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, '৭১-এর মানবতাবিরোধী ঘাতক চক্রের বিচার করা। দেশের জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশকে একটা আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণকামী ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। কখনো বিরোধী দলে, কখনো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। '৭২-এর সংবিধানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, দেশ ও জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সর্বাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টির কারণে দেশরত্ন শেখ হাসিনার মহান প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে যতটুকু অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তাও তুচ্ছনীয় নয়। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আজ ক্ষমতায়। দেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই উন্নয়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ আজ একটা মডেল রাষ্ট্র। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখণ ৭%-এর উপরে, মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার, মুদ্রাস্ফীতি ৬-৭ এর মধ্যে, এবারের বার্ষিক বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৩,৪০,০০০ কোটি টাকার, দেশের জনগণের কর দানের ক্ষমতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা সন্তোষজনক, খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লবী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এদেশের মানুষ আজ আর অনাহারে থাকে না। অচিরেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হতে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশ আজ ঈর্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতির কারণে। শেখ হাসিনা একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদই নন, দক্ষ প্রশাসকও বটে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যার দক্ষতা উন্নয়নের পূর্বশর্ত তা এমনভাবে শেখ হাসিনা সুনিয়ন্ত্রণ রেখেছেন যে কোথাও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে এরূপ দাবি করা যাবে না। প্রতিকূল ও প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হচ্ছে বলেই প্রশাসনকে অনেক সময় কঠোর হতে হচ্ছে। মহল বিশেষ যেভাবে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটিয়ে উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে চাইছে, তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলেই কখনো কখনো গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে রাজনৈতিক কারণে হত্যা, অগি্নদগ্ধ করা, সম্ভ্রমহানি করা হবে, হত্যা করা হবে, আর যারা এটা করবে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের প্রদান করতে হবে কেন এটা বোধগম্য নয়, দাবি তো এটাই? সাংবাদিক শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের মতো ব্যক্তিরা রাজনৈতিক হত্যার পরিকল্পনাকারী হবেন এবং তারা সুশীল সমাজের সদস্য বলে তাদের কিছু বলা যাবে না এবং ওটাই যদি গণতন্ত্র হয়, বাংলাদেশের জনগণ সেই গণতন্ত্রের প্রত্যাশী বলে মনে করে না।
জয়ের অপরাধ কী? কেন জয়কে হত্যা করা হবে? জয়ের অপরাধ তিনি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র। তার অপরাধ তিনি বাংলাদেশকে তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এমন একপর্যায়ে পেঁৗছে দিয়েছেন ও অদূর ভবিষ্যতে অপার সম্ভাবনাময় পরিবেশ সৃষ্টির আশ্বাস দিচ্ছেন, তা স্বাধীনতার শত্রুদের কাছে পছন্দনীয় নয়। যে কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকা- ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সেই একই কারণে বঙ্গবন্ধু পরিবারের উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়কেও তারা নিশ্চিহ্ন করতে চায়। জয় একজন মেধাবী যুবক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে অসাধারণ মেধার অধিকারী, ইতোপূর্বেই তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। বাংলাদেশের ডিজিটাল রাষ্ট্রের রূপকার প্রধানমন্ত্রীর শুধু পুত্র হিসেবে নয় একজন মেধাবী ও যোগ্যতার কারণেই তাকে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আইসিটি খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে হাজার হাজার যুবককে চাকরির সুযোগ করে দেয়া, ইউনিয়ন পর্যায়ে আজ এর সুফল পাচ্ছে জনগণ। স্কুল শিক্ষা পর্যায়ে আইসিটির বিস্তার ঘটেছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে যাচ্ছে। দেশে বসে কী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়, এদেশের যুবককে জয়ই তা শিখিয়েছেন। মেধাবী, কর্মদক্ষ, সাহসী এই যুবক বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নবতর সুযোগ্য নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। অনেকের অপপ্রচার রাজনৈতিক কারণেই তিনি করতেন। আমার মতে, জয়কে রাজনীতির কাছে যেতে হবে না, রাজনীতিই জয়ের কাছে আসবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। এই অসাধারণ দেশপ্রেমিক মেধাবী যুবককে যারা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য বলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ভবিষ্যতের রাজনীতি নিরাপদ করার স্বার্থে হত্যা করতে চান, তারা জয়ের মাতা দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রকৃত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করেও খুনিরা তার দর্শনকে ধ্বংস করতে পারেননি। শেখ হাসিনা আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট দলের প্রধান হয়ে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা পূরণে নিরন্তন চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জয় শেখ হাসিনার পুত্র। তিনবার ফেল করে সে মেট্রিক পাস করেনি। মাতা প্রধানমন্ত্রী বলে একটা রাজনৈতিক অফিস খুলে কোটি কোটি টাকা অর্জন করে বিদেশে পাচার করেননি। মাতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মিল কলকারখানা গড়ে তোলেননি। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা হওয়ার পূর্বে কখন দেশে এসেছিলেন, তা কাকপক্ষিও জানতো না। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে জয়ের সরকারি অফিসে একটা টেলিফোন করার নজির দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাকে খুব কমই দেখা গেছে। যুব সম্প্রদায়ের একটা অংশ একসময় সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে জয়কে রাজনীতিতে প্রবিষ্ট হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, তিনি এসেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে দেখা হয় এবং সভা-সমাবেশে হাজার হাজার যুবক জয়কে পেয়ে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানায়। যখনই তার রাজনীতিতে প্রবেশের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তিনি তা সহজেই এড়িয়ে যান। জয়ের রাজনীতিতে আসতে পারেন এরূপ সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান তাতে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করে অপপ্রচার চালিয়ে অপকৌশল অবলম্বন করে কি নোংরা রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তা এদেশের জনগণের জানা আছে। জয় একটি কথাও বলেননি, কোথাও তারেক সম্পর্কে।
পারিবারিক পরিবেশে রাজনীতি এই উপমহাদেশে বিদ্যমান। এ কথা স্বীকার করতেই হবে। একজন সুশিক্ষিত, সচেতন, দেশপ্রেমিক ও সাহসী যুবক হিসেবে দেশসেবার ব্রত নিয়ে যদি জয় রাজনীতিতে আসতে চান তা কি অস্বাভাবিক বিষয় বলে বিবেচিত হবে। মাতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তাকে রাজনীতিতে আসার প্রয়োজন পড়ে না। ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তিনি ইচ্ছা করলেই ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আসলে তাতে কারো মাথা ব্যাথার কারণ হওয়া উচিত নয়। আর সেই কারণেই তাকে বিদেশের মাটিতে হত্যা করে ক্ষমতার মোহকে চিরস্থায়ী করবার লক্ষ্যে তাকে শারীরিকভাবে অপসারণ করবার অপচেষ্টা যারা করে চলেছেন তারা আর যাই হোক গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে দেয়ার যোগ্য নন। '৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় তা আজও অব্যাহত আছে। '৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় মহিলা নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৩ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে এবং বিগত আড়াই দশক ধরে অন্তত ২০ বার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়ে তারা তো প্রমাণই করেছে তাদের মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু পরিবার। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, সুদক্ষ নেতৃত্বকে চিরতরে অপসারণ করে, রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে, তারা চিরদিনের জন্য ক্ষমতায় যেতে চান। তারা স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী রাষ্ট্র বানাতে চায়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ঘাঁটি বানাতে চায়। এই কারণেই ওরা জয়কে ভয় পায়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউই ওদের নিকট নিরাপদ নয়। তাই এই অব্যাহত হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোন অপশক্তি জড়িত সেই তথ্য বাংলার মানুষের আজ আর অজানা নয়।
ডা. এসএ মালেক:রাজনীতিক ও কলাম লেখক