মোমিন মেহেদী
আমাদের এক বন্ধু রাজনৈতিক দল করেন। নাম- বাংলাদেশ সেবা পার্টি। সেই সেবা পার্টির চেয়ারম্যান নিজেই মানুষের সেবার জন্য নিবেদিত থাকেন। কখনো বন্ধুদের সংগঠনের সংবাদ কম্পোজ করে মেইল-ফ্যাক্স করার ব্যবস্থা করেন। আবার কখনো নিজেই হাতে হাতে পৌছে দেন সংবাদ-ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমের অফিসে। শুধু এখানেই শেষ নয়; তিনি না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতেও দেখেছি খুব পছন্দ করেন। যদিও এর সবই আমার দূর থেকে দেখা। তাঁর সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই, মাঝে সাঝে কথা হয়, দেখা হয় রাজপথে। তারপরও তিনি আমার বন্ধু। কেননা, নিজেকে তিনি নিবেদিত রেখেছেন নতুন কিছু করার জন্য, সেবার জন্য এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য। সে যাইহোক, সবচেয়ে বড় কথা হলো, যাদের সেবা করার ইচ্ছে আছে তারা সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। আর যাদেও সেবা করার নূন্যতম মানষিকতা নেই; তারা সেবক হিসেবে বারবার নির্বাচিত এবং মনোনীত হন। এই বর্তমান থেকে বেরিয়ে না আসলে আমাদের রাজনীতি, আমাদের অর্থনীতি আমাদের কূটনীতি, আমাদের সমাজনীতি আরো পিছিয়ে পড়বে। আরো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তার প্রাথমিক একটা প্রমাণ হলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর এবং দক্ষিণ। এই দুটি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন না দিয়ে অথর্ব-অযোগ্য প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সেই প্রশাসকের আমলের কিছু চিত্র তুলে ধরছি।
এক.
এক সময় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে সহজেই নাগরিকত্বের সনদ, জন্ম-মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদসহ প্রয়োজনীয় দলিলপত্র নিতে পারতেন নগরবাসী। দীর্ঘদিন নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় এসব সনদ পেতে যেতে হচ্ছে দূরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। তা-ও সহজে মিলে না। এ জন্য ধরনা দিতে হয় দিনের পর দিন। দিতে হয় বাড়তি টাকাও। প্রায় দুই বছর ধরে জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবা পাওয়ায় এ বিড়ম্বনার কথা শোনারও কেউ নেই। অন্যদিকে ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যার বিষয়ে নগরবাসী অভিযোগ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই ফল মিলছে না। সেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তি মেনে নিতে হচ্ছে তাদের। রাজধানীর শ্যামলী এলাকার কথা। এষানকার একজন নাগরিক জানেলন 'প্রথমত দুই ভাগ করা আমাদের কাম্য ছিল না। প্রতিনিয়ত নানান ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অধিকাংশ নাগরিক সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মহানগর এই দুটোকে গুলিয়ে ফেলছেন। ধরুন, আপনার ঠিকানা : ১৩৩/১, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২। এই ঠিকানায় কোথাও কি ঢাকা সিটি করপোরেশনের উল্লেখ আছে? তাইলে আপনার ঠিকানাও পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। আমরা সব জায়গায় যে ঢাকা লিখি এটা ঢাকা মহানগর, ঢাকা সিটি করপোরেশন নয়। রাজউক, ওয়াসা, ডিপিডিসি এগুলোকে তো ভাগ করা হয়নি, সুতরাং এগুলোর আগের ঠিকানায় আপনি সেবা পাবেন। এই ভাগের ফলে আমি কোনো উপকারই দেখতে পাচ্ছি না বরং অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া ভাগ করার পর যদি দ্রুত নির্বাচন দিত তাহলে বুঝতাম নাগরিক সেবার জন্য সরকার এটা করেছে। কিন্তু নির্বাচন দিচ্ছে না। আমরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কার কাছে গিয়ে বলব?' '
দুই.
তোতা বেপারী, ঢাকা শহরে আছেন প্রায় ৭ বছর। রাজধানীর সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'ভাই আমাগো আর সমস্যা কি। রোদে পুড়ি বৃষ্টিতে ভিইজা রিকশা চালাই। তয় যেইহানে থাহি জায়গাডায় মশায় ভরা। রাইতে মশার লাইগা ঘুমাইতে পারি না। আমগো মালিকরে কইছি হে কয় সিটি করপোরেশনের ওষুধ শেষ হইয়া গেছে। এহন কারে কি কমু। আমরা ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হইলেও তো বছরের পর বছর ধইরা থাহি। কী আর কমু ভাই। এইসব আমাগো কাছ থেকে শুনে কোনো লাভ নেই। সরকাররে গিয়া কন নির্বাচন দিয়া মেয়র বানাইতে। তাইলে অনেক সমস্যার সমাধান হইব। মেয়র অইলেও কি আর না অইলেও কি, আমাগো দিকে কেউ তাকাইবনি। মেয়র অইলেও রাস্তায় ঘুমাইতে অইব, না অইলেও রাস্তায় ঘুমাইতে অইব। তয় কারওয়ানবাজারের অনেক সমস্যা আছে। হেই গুলান যদি ঠিক করে তাইলে আমগো সুবিধা অয়। আগে তো সিটি করপোরেশনে অফিসাররা মশার লাইগা ওষুধ মারত। এহন তো দেহি না। এহন মশার লাইগা ঘুমাইতে পারি না।
তিন.
করিম আলী দুই মেয়েসহ পরিবার নিয়ে থাকেন মগবাজার রেলগেটের পাশে। সিটি করপোরেশনের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'অনেক সমস্যা আছে। আগে তো রেলগেটের পাশে কাউন্সিলর বসত। তার কাছে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলতাম। কিন্তু এহন কারো কাছে কিছু বলতে পারি না। বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি উঠে যায়। বাসার আশপাশে ময়লা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা সময়মতো ময়লা নেয় না। আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে মেয়র-কাউন্সিলর হলে আমরা অন্তত অভিযোগটুকু করতে পারব। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মায়ের মৃত সনদ নিতে এসে হয়রানির শিকার হয়েছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবিদ রেজা সাইদ। তিনি বলেন, 'প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব জমা দিয়েছি। কিন্তু নানা অজুহাতে আমাকে পাঁচদিন যাবত ঘোরানো হচ্ছে। নদ্দা এলাকার বাসিন্দা সাজিয়া বেগম সাতদিন ঘুরেও সন্তানের জন্ম সনদ নিতে পারেননি। তিনি বলেন, 'ডাক্তার সার্টিফিকেট নিয়ে অঞ্চল অফিসে যেতে বলা হয় আমাকে। অঞ্চল অফিসে গেলে বলে নগর অফিসের অনুমোদন না আনলে সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না। এভাবে আমাকে দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে। একজন ব্যবসায়ী এরমধ্যে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'দোকানের ট্রেড লাইসেন্সের জন্য প্রায় এক মাস আগে ফি জমা দেয়ার পরও লাইসেন্স নিতে পারিনি। পরে দালাল ধইরা দুই হাজার টাকা দিয়া ৬ দিনে লাইসেন্স পাইছি। অন্যদিকে ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট’র কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম শোভন অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলেন, 'কল্যাণপুর নাভানা গার্ডেনের সামনে গিয়ে দেখেন কি অবস্থা। ময়লা স্তূপের মধ্যে আমরা বসবাস করছি। এখানে এলে মনে হবে না আমরা ঢাকা শহরের মধ্যে আছি। এই অবস্থায় কোনো সিটি করপোরেশন চলতে পারে না। তাছাড়া একটু বৃষ্টি হলেই বাসার নিচে পানি জমে যায়। মাঝেমধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার সময় সমস্যায় পড়তে হয়। রিকশা না পেলে হাঁটু পানিতে ভিজতে ভিজতে যেতে হয়। এলাকার কোনো কাউন্সিলর নেই। সুতরাং এই ভোগান্তি পোহানো ছাড়া কিছুই করার নেই। সরকার যদি নির্বাচন দেয় দ্রুত তাইলে নতুন কমিশনাররা এসে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না ঠিক করা পর্যন্ত এই ভোগান্তি পোহাতে হবে। সরকার যদি দ্রুত নির্বাচন না দেয়, তাহলে এই ভোগান্তি পোহাতেই হবে।
এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন নির্বাচন দিচ্ছে না? উত্তরটা আমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারী হিসেবে বলি, মহাজোট সরকার আসলে চায় না যে, অন্য ৭ টি সিটি কর্পোরেশনের মত এখানেও তাদের পতন তৈরি হোক। আর চায় না বলেই এই দুই সিটি কর্পোরেশনে বছরের পর বছর নির্বাচন না দিয়ে এগিয়ে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। যেখানে নিজেরাই হয়তো হারিয়ে যাবে।
আমি কোন রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে নয়; নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বলতে চাই, এই সব ভূয়া পরিকল্পনা বাদ দিন। নির্বাচন দিন। তাতে যদি বিজয় আসে আপনার কাজের মাধ্যমে আসবে। আর যদি পরাজয় আসে, তা-ও আপনার কাজের মাধ্যমেই। কেননা, কথায় আছে ‘ যেমন কর্ম তেমন ফল।’ অতএব, বাংলাদেশকে রক্ষা করতে, বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করতে তৈরি হোন। ক্ষমতার রাজনীতি নয়, সেবার রাজনীতিতে তৈরি হয়ে এগিয়ে আসুন। দেখবেন নতুন করে বিজয়ের সূর্য হেসে উঠবে। আর তা না করে যদি মা- ছেলে মিলে হাজারো বলেন, ‘তথ্য আছে, জিতে যাবো।’ কোন লাভ হবে না। কেননা, মানুষ তথ্য চায় না। মানুষ ডিজিটাল চায় না। মানুষ কথা চায় না। মানুষ খেতে চায়। দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সেবা চায়...
মোমিন মেহেদী : কলামিস্ট, আহবায়ক, নতুনধারা বাংলাদেশ(এনডিবি)
Emial: [email protected]