আগের পর্ব
খাটটি পেয়ে আমার সারাদিন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আগের বাসায় ম্যাট্রেস ছিল। বাসা ছাড়ার সময় বাড়ীয়ালাকে ফেরত দিতে হয়েছে । ম্যাট্রেসগুলোয় উনি ফ্রি থাকতে দিয়েছিলেন। ওটি তার সামার ক্যাম্পিং এ লাগে।
আমেরিকায় ক্যাম্পিং খুব জনপ্রিয় । সামার আসলেই ঘর বাড়ি ফেলে এরা বনে বাদাড়ে চলে যায় । সেখানে কিছুদিন তাঁবু খাটিয়ে থাকে । বন জঙ্গল অসহ্য মনে হলে আবার লোকালয়ে ফিরে আসে।
সুরিয়ার বাসায় এতদিন ওর সোফায় ঘুমিয়েছি । সুরিয়া অবশ্য যেদিন আসি সেদিন আমাকে বলেছিলো , এখানে তুমি খুব আরামে ঘুমাবে । মথু যখন থাকত, মথু ঘরে আর আমি লিভিং রুমে এই সোফাটাতে ঘুমাতাম।
সুরিয়াদের আগের এপার্টমেন্টে; আরও অনেকের সাথে ওরা একটি রুম নিয়ে থাকতো । সুরিয়া বলল, তখন ও নাকি তারা আলাদা ঘুমাতো । মথু উপরে খাটে আর সে নিচে মেঝেতে । আর ও বলল, একি ঘরে থাকলে কি হবে, জানো মথু কিন্তু এখনও আমাকে ছোঁয়নি ।
মথু আসলেই খুব ভদ্র ছেলে ছিল । সুরিয়া ও খুব ভদ্র মেয়ে । আমি কখনই ওদের সম্পর্ক নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি। তবু সুরিয়া আমাকে কেন এত কিছু বলল বুঝলাম না ।
রাতে নাসরিনের সাথে যখন কথা হল । ওকে বললাম , আমরা বাইরে থেকে যা ধারনা করি তা সবসময় ঠিক নয় । সুরিয়া আমাকে আজ সবটা বলেছে । নাসরিন বলল , তাই নাকি ? এসব গল্প সুরিয়া কোনোদিন আমাকে করে না । তোমার মতো গাড়লদেরকেই শুধু করে।
আমি যে সুরিয়ার কথা শতভাগ বিশ্বাস করেছিলাম তা নয় । তবে নাসরিনে আমাকে গাড়ল বলাতে বেশ রাগ হল ।
যাই হোক খাটটি পেয়ে আমি খুব আরাম করে ঘুমুচ্ছিলাম। নিজের একটা খাট , নিজের একটা বিছানা অন্যরকম অনুভুতি কাজ করছিল । দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে কাজ করতাম আর ভাবতাম কখন বাসায় যেয়ে খাটে গড়াগড়ি দেবো ।
এর মাঝে প্রফেসর মনে করিয়ে দিলেন ১৩ই জুলাই ল্যান্ডস্যাট ক্যালিব্রেসন মিটিঙের কথা । স্যু ফলসে, ইরসে হবে মিটিং । ইরস হল আর্থ রিসোর্স অব্জারভেশন সেন্টার। সহজ কথায় স্যাটেলাইট ডাটা যেখানে জমা হয় ।
মিটিংটা ছিল নাসা, আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড মিটিং । মিটিং এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। প্রফেসর বললেন, আমরা সকাল ৬টায় রওনা দেব । ৬টার মধ্যে সবাই যেন চলে আসে । মিটিং এ ব্রেকফাস্ট থাকবে তবে কোন লাঞ্চ দেওয়া হবে না । বাড়ি থেকে খাবার আনতে পার অথবা কিনতে পার। খাবার একটু এক্সপেন্সিভ হতে পারে।
আমি একটু অবাকই হলাম । এত আয়োজন , এত প্রস্তুতি । খাবারই দেবে না ! সে আবার কি রকম মিটিং । আমাদের দেশে মিটিং মানেই তো খাওয়া দাওয়া ।
ঐ দিন ভোরে উঠে লাঞ্চ বানিয়ে ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । এত ভোর, আমার ধারনা ছিল , রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা । কিন্তু দেখলাম না ভালই গাড়ি চলছে । সর্টকার্ট করতে আমি ভিতরের রাস্তা দিয়ে গেলাম । ভিতরের রাস্তায় কেউ নেই আর ভোর পাঁচটা, তাই সূর্যের আলোও ততটা ফোটেনি ।
ভিতরের রাস্তায় এক বাড়ি ছিল । তার সামনে একটা ভাঙ্গা গাড়ি । মনে হয় কেউ থাকেনা । একদিন সন্ধ্যায় এক থুত্থুরে বুড়িকে বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছি । বুড়িকে আমার গল্পের সেই ডাইনী বুড়ির মত মনে হয়েছিল ।
আমি জোরে পা চালাচ্ছিলাম। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি বুড়ি বেরিয়ে এসে আমার ঘাড় মটকে দেবে । ডিপার্টমেন্ট পৌঁছে দেখি পুরো ঘেমে গেছি । কাপড় চোপড় পাল্টে অনেক্ষন ধরে সাজগোজ করলাম ।
৬টা বাজে আমরা রওনা দিয়েছি । আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রফেসর এরন । সাতজন বসা যায় । বেশ বড় গাড়ি । পিছনের সিটে আমি আর মারকট বসলাম । পথে যেতে যেতে অনেক ফসলের মাঠ পড়ল । সূর্যের আলো তখন কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে । খুব চমৎকার লাগছিলো দেখতে । বেশীর ভাগই সব গম , যবের ক্ষেত ।
আমেরিকার ফসল সম্পর্কে গল্প হচ্ছিল। জানলাম ভৌগোলীক কারণে এখানে মসলার চাষ হয় না । এই কারণে আমেরিকান খাবারে মসলা থাকেনা । যেখানে যেটি হয় তাদের তো সেটি খেয়েই অভ্যস্ত হওয়ার কথা । তবে আমেরিকানরাও এখন মসলা খাওয়া শুরু করেছে । প্রধানত মেক্সিকো ও আরও অনেক দেশ থেকে মসলার আমদানি করা হয় ।
এক ঘণ্টা পর আমরা ইরস পৌছালাম । তার আগে আমাদের সিকুরিটি চেক করা হল । ল্যারি নিজেই বলল ,খুবই হাস্যকর এসবের কোন মানে হয় । ইরসে আছেটা কি , টেররিস্টরা কেন আসবে এখানে?
৪/৫ মাস আগে প্রফেসর এরন একবার জিগ্যেস করছিলেন , ডু ইউ নো ওবাইদুল ফ্রম বাংলাদেশ ? এর আগে তিনি আমাদের গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়া নিয়ে অনেক গল্প করছিলেন । তখন মনে হয়েছিল, বাহ্ উনি আমার দেশের অনেক খবরই রাখেন । আর বাংলাদেশের ওবাইদুল কাদেরকে তো সবাই চেনেই ।
আমি বললাম, ইয়েস আই নো হিম ভেরি ওয়েল । হি ইজ দা মিনিস্টার অফ আওয়ার কান্ট্রি। তিনি বললেন , ওহ রিয়েলি ! একচুয়ালি হি ওয়াজ মাই স্টুডেন্ট ।
আমার উত্তর শুনে অনেকক্ষণ হাসলেন উনি আর ঘটনাটি আমি ভুলেও গেলাম ।
আমাদের পিছনে আর একটি গাড়ী চেকের জন্য অপেক্ষা করছিল । কিন্তু তাদেরকে আগে যেতে দেওয়া হল। ডক্টর হেল্ডার বললেন গাড়িতে ওবাইদুল আছে । নামটা আমার খুব চেনা মনে হল। কোথায় যেন শুনেছি এ নাম ।
যাই হোক আর কতগুলি চেক পেরিয়ে আমরা ইরসে ঢুকলাম।মিটিং শুরু হওয়ার আগে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে। ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। ব্রেকফাস্ট এত পরিমানে দেওয়া হয়েছে যে লাঞ্চ করার আর দরকার নেই ।
কিন্তু সময় কম আর গপগপ করে খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখলে ভাল দেখায় না । আমি শুধু একটি আপেল নিলাম । মিটিং শুরু হল । চারদিক পিনপতন নীরবতা ।
খুব আস্তে করে আমি আপেলে কামড় দিচ্ছিলাম যাতে আমার আপেলের কামড়ে মিটিঙের কোন অসুবিধা না হয় । কিন্তু সেই আস্তেটাতেই মনে হলো যেন অনেক শব্দ হচ্ছে । পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে । নিশ্চিত হতে পাশে বসা সুদীপকে বললাম , দেখোতো আমি আপেল খেলে তুমি কোন কচকচ শব্দ শোনো কিনা । সুদীপ বলল , হুম হাল্কা কচকচ শোনা যাচ্ছে ।
আপেল খাওয়া বাদ দিয়ে আমি মিটিঙে মন দিলাম । আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল । আমার পরিচয় যখন দিল তার আগ পর্যন্ত আমার ধারনা ছিলনা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আমার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে । বিদেশে প্রফেসররা অবশ্য এভাবেই কথা বলেন । নাউ ইউ আর ইন চার্জ অফ দিস প্রজেক্ট । ইউ আর সাইন্টিস্ট । উই অল আর সাইন্টিস্ট হেয়ার ...। এরকম আরও অনেক কিছু ।
এই অনেক কিছুর কারনে যেটি হয় , যে ছেলেটি মনে মনে ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিল । একসময় তার মনে হয়, সত্যিই কি আমি সাইন্টিস্ট না ? চাইলে কি আমিও কিছু করতে পারি না ।
এই কিছু করার জন্য ছেলেটি দিনরাত কাজ করে । কাজ না করে অবশ্য এখানে উপায় ও নেই । ফায়ার করতে এরা ওস্তাদ । তবে ফায়ার এরা ফায়ারিং মুডে করে না । চোখে জল আনার মত করে বলে দেখ আমি তোমাকে এ বছর সাপোর্ট দিতে পারছি না । আসলে আমার সে সুযোগ নেই । ফান্ডের অবস্থা ভাল নয় । আমার খুব খারাপ লাগছে এ জন্য । তোমাকে সাপোর্ট দিতে পারলে এ মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতাম ...।
কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটি হয়, আসলে সে বড় অঙ্কের ফান্ড পেয়েছে । তোমাকে দিয়ে সে তার আউটকাম পায়নি বলে এই কৌশল ।
তবে খারাপ ভাবে কখনই এরা বলবে না , খারাপ ব্যাবহার করবে না । কারো মনে কষ্ট দেওয়া আমেরিকানদের কাছে প্রচণ্ড অমানবিক ব্যাপার । কিন্তু হৃদয় ভেঙে খান খান করা , পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেওয়া সামান্য ব্যাপার ।
মিটিঙের লোকজনের অধিকাংশই ছিল নাসার ক্যালিব্রেসন সাইন্টিস্ট , ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আর কয়েকজন ইরস ইমপ্লয়ী । আমার চোখ শুধু খুঁজছিল এদের মধ্যে কোন বাংলাদেশি আছে কিনা । হুইল চেয়ারে বসা একজনকে দেখলাম । তাকে আমার বাংলাদেশী মনে হল । ইরস ইমপ্লয়িদের যখন পরিচয় দেওয়া হল । জানলাম তার নাম ওবাইদুল এবং নিশ্চল আমাকে বলল, হি ইজ ফ্রম বাংলাদেশ ।
বাংলাদেশ নামটা শুনে আমার আবেগে আপ্লুত হওয়ার কথা কিন্তু ওবাইদুলকে দেখে ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি এই ওবাইদুলের কথায় তিনি বলেছিলেন । কিন্তু সেই ওবাইদুল এমন হতে পারে সেটি আমার ধারনার ভীষণ বাইরে ছিল । ওবাইদুল কে আমি এখানে ভাই বলে সম্বোধন করাটা সমীচীন মনে করছি ।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওবাইদুল ভাইকে দেখছিলাম । মিটিং এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না ।
ওবাইদুল ভাইয়ের বর্ণনা কিভাবে দেব ঠিক বুঝতে পারছিনা । এর জন্য সত্যি ক্ষমা চাচ্ছি। ওবাইদুল ভাই একটি হুইল চেয়ারে বসে আছেন, হাত পা নড়াতে পারছেন না । হাতের সাথে একটা শক্ত লাঠির মত বেঁধে রেখেছেন ।সেটা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পাসওয়ার্ড টাইপ করলেন ।
ভাবছিলাম, যদি পাসওয়ার্ড টাইপ করতে এতক্ষন লাগে তাহলে উনি কি করে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করছেন! এত এত কাজ কি করে করছেন ! একজন বলল একটা ভয়েস ট্রান্সলেটর দিয়ে উনি কাজ করেন । তবে ওনার প্রেসেজেন্টেসনের সময় মনে হল , কথা বলতেও ওনার বেশ কষ্ট হচ্ছে ।
মাঝখানে আমাদের ট্রি ব্রেক দেওয়া হল । আমি ওবাইদুল ভায়ের সাথে দেখা করতে গেলাম ।নিজের পরিচয় দিলাম । আমাকে খুব সহজেই তুমি করে বলা শুরু করলেন । একজন বাংলাদেশী পেয়ে উনিও যেন বেশ আনন্দিত । বেশ হেসে হেসে কথা বলছিলেন। চমৎকার করে হাসেন উনি।
আমার ধারনা ছিল ওবাইদুল ভাই নিশ্চয়ই আমার বছর সাত আট বছরের সিনিয়র হবেন । কিন্তু তাঁর ব্যাচ শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হবার অবস্থা । তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন । '৮৯ এর ব্যাচ । কিন্তু তাকে দেখলে সেটি মনে হবার কোন কারন নেই । গৌর বর্ণের মুখ খানায় চমৎকার হাসি যেন তাকে চির তরুন করে রেখেছে ।
এই চির তরুনটি যখন আমার সাথে কথা বলছিলেন । এই দীর্ঘ কথা বলার সময় একবারও ঘাড় নড়াননি । সেটি কোন লজ্জা বা ইচ্ছাকৃত কারনে নয় । ওবাইদুল ভাই ঘাড় নড়াতে পারেন না ।
বছর কয়েক আগে বন্ধুদের সাথে এক আলো ঝলমলে দিনে তিনি ঘুরতে বেরিয়েছিলেন । তখন তাদের গাড়িতে একটা এক্সিডেন্ট হয় । ওবাইদুল ভাই এর বাকি বন্ধুদের তেমন কিছু না হলেও সেই আলো ঝলমলে দিনে তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে । তবে তাঁর নিজ কর্মগুনে সেই অন্ধকার তিনি সরিয়ে ফেলেছেন । তাঁর নির্মল হাসি , উপস্থাপন দেখে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে ।
কলেজে থাকতে আমার এক বন্ধু ছিল ওর নাম প্রিয়াঙ্কা । পরে ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে চলে যায় । আমরা বন্ধুরা একদিন গল্প করছিলাম । এক বন্ধু একটা লোকের গল্প বলছিল, যে অমুক পারে, তমুক পারে তবে ঘাড় নড়াতে পারে না ।
হঠাৎ প্রিয়াংকা চেঁচিয়ে ঊঠলো, তাহলে লোকটা বেঁচে আছে কেমন করে ? আমি বললাম, না বাঁচার কী আছে ?
না লোকটা তো আকাশ দেখতে পারে না , আকাশ না দেখে কেউ বাঁচে থাকে কিভাবে?ওবাইদুল ভাইকে দেখে প্রিয়াংকার কথাটা মনে পড়ে গেলো । আকাশ নিয়েই যার কাজ , সেই কিনা আকাশ দেখতে পারে না ।
লাঞ্চ টাইমে আমি টুনা সালাদ কিনলাম । সবার সামনে বক্স খুলে খাব ভেবে অদ্ভুত লাগছিল । সুদীপ বলল তুমি না খাবার এনেছ ? আমাকে দাও। সুদীপ কে নুডুলস দিয়ে আমি ওবাইদুল ভায়ের কাছে গেলাম ।
দেখলাম তার আমেরিকান সহকর্মীরা তার খাবার এনে দিচ্ছে। খাওয়া শেষে পরিষ্কার করে দিচ্ছে । আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছে ।করুণা করে নয় , খুব সম্মানের সাথেই করছে । বুঝলাম আমেরিকান চাকরীর এই এনি টাইম হায়ার এনি টাইম ফায়ার বাজারে ওবাইদুল ভাই খুব গুরুত্বপূর্ণ । নিশ্চয়ই আমেরিকানদের কাছে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল এতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন কি করে !
শুনেছি ওবাইদুল ভাই স্যু ফলসের একটা বিশেষ ফ্ল্যাটে থাকনে । শারীরিক ভাবে অসুবিধাগ্রস্থ লোকদের জন্য এই ফ্ল্যাট । চব্বিশ ঘণ্টা নার্স থাকে সেখানে । অফিসে আসার সময় এক আমেরিকান সহকর্মী ওনাকে রাইড দেন ।
আমেরিকার প্রতি আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হত । তাদেরকে অমানবিক , নির্দয় , নিষ্ঠুর মনে হত । কিন্তু সেদিন যেন বারবার ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞই হচ্ছিলাম ।
মিটিং থেকে ফিরতে আঁটটার মত বেজে গেল । তখনও কটকটা রোদ । ল্যারি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল ।
পরদিন ল্যাবের সাপ্তাহিক মিটিং। ল্যারি আমাকে বলল , তুমি কি প্রতিদিন এত দুর হেঁটে আস ?
- হুম ।
ডক্টর হেলডার বললেন, কেন তোমার গাড়ি নেই ?
- নেই ।
-ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই ?
-নেই ।
সাইকেল আছে ?
-আছে, তবে চালাতে পারি না ।
একটা মানুষ সাইকেল চালাতে পারে না , উনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না । বললেন, তাহলে তুমি তোমার দেশে কি করতে ? সাইকেল চালাতে পার না , গাড়ি চালাতে পার না । পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিতে নাকি সবসময় এখনকার মত হাঁটতে ?
আমি বললাম , না হাঁটতাম না । প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট নিতাম, ওটার নাম রিক্সা । আমাদের দেশের মানুষ তোমাদের মত এত হাটে না।
বুঝিয়ে বললাম, রিক্সা খুব ভাল ট্রান্সপোর্ট । ওটা তোমাকে বাসার সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে । ওটাতে খুব হাওয়া হয় । ওটাতে চড়লে তোমার মন ভাল হয়ে যাবে , কখনও বমি পাবে না। যেহেতু মাত্র দুজন বসা যায় এবং বেশ ঝাঁকুনি হয় তাই তুমি ওটাতে ডেট ও করতে পার । ঝাঁকুনির সুবিধা , তুমি মাঝে মাঝে না চাইতেই অপরপক্ষের ছোঁয়া পাবে ।
- ওহ্ ইট স রোমান্টিক।
- ইয়েস।
- হুম, তবে চিন্তা কর না জান্নাতুন । রায়ান তোমাকে এখন থেকে সাইকেল চালানো শেখাবে।
পরদিন ল্যাব শেষে রায়ান দেখি দাঁড়িয়ে আছে । বলল চল, তোমাকে সাইকেল চালানো শেখাই । বললাম, দেখো এই বুড়ো বয়সে এই শিখে হাত পা ভাংতে চাই না ।
রায়ান হাসতে হাসতে বলল, হাউ ওল্ড আর ইউ ? এক বছর কমিয়ে বললাম । বলল, রিয়েলি? তোমাকে তো অনেক ইয়াং দেখায় ।
রায়ানের মন্তব্যে ভীষণ খুশি হলাম আমি ।
-হুম আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল তুমি কখনও এশিয়ানদের বয়স অনুমান করতে পারবে না ? তাদেরকে আসল বয়সের থেকে অনেক ইয়াং দেখায়।
রায়ানের কথায় খুব রাগ হল আমার ।
এর মধ্যে আমি এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম । আমার কিছুটা ভুলে যাওয়া রোগ ছিল । সেদিন চুলায় মুরগী রান্না করব বলে তেল গরম দিলাম । দিয়ে মেঝেতে কি যেন একটা পড়েছিলো , সেটা পরিস্কার করছিলাম । পরিস্কার করতে করতে চুলায় যে কিছু দিয়েছি বেমালুম ভুলে গেলাম ।
আমি যখন ঘষে ঘষে মেজেটা তকতকে করছি , সুরিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল ফায়ার ফায়ার । ততক্ষণে ফায়ার এলার্ম বাজতে শুরু করেছে ।
সেদিন তেল একটু বেশিই ঢেলেছিলাম পুরা সপ্তাহের রান্নার জন্য । তেল পুরাটা পুড়ে শেষ না হলে আগুন নিভবে না । তেলের আগুন পানিও দিতে পারছিনা ।কিন্তু বাসা তো কাঠের এর মধ্যে আগুন ধরে যেতে পারে । সুরিয়া বলল , আগে চুলাটা নিভাও । কিন্তু ভয়ে ও বস্তুর কাছে আমি যাচ্ছি না ।
সুরিয়াই চুলা নিভিয়ে গনগনে পাতিলটাকে মেঝেতে রাখল । তখনও দাও দাও করে আগুন জ্বলছে । সুরিয়া একটা চেয়ার নিয়ে গেল ফায়ার এলার্ম খুলতে । কিন্তু কিছুতেই সে পারছিলনা । তখন রাত ১২ টা বাজে । আমাদের ভয় হচ্ছিল ফায়ার ব্রিগেড না চলে আসে ।
আমাদের কলিং বেল ক্রমাগত বাজছে । বুঝতে পারছিলাম না, ফায়ার ব্রিগেডের লোক কিনা । দরজা খুলে দেখি , এপার্টমেন্টের সবাই চলে এসেছে । ভীষণ ফোলা আর উৎকণ্ঠা তাঁদের চোখে । আমেরিকানরা সাধারনত রাত আটটা নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে । আগুন ধরেছে ভেবে তারা কাচা ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসেছে ।
একজন বলল , ডু ইউ হ্যাভ ফায়ার ইন ইওর হোম ?ডু ইউ নিড টু কল ৯১১ ?
আমরা বললাম, কই নাতো , সেরকম কিছু নয়।
বিকট শব্দ করে ফায়ার এলার্ম তখনও বাজছে ।
(চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৭