ইজতেমায় যাওয়ার একটা ঘটনা শেয়ার করি, দেখুন কি অবস্থা......
ঘটনা আরও বছর কয়েক আগের। আখেরী মোনাজাতের আগের দিন বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম মোনাজাতে শরীক হব। মোনাজাতের দিন সকালে সবাই রওয়ানা হলাম গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। সকাল ৭টার দিকে। কেউ কিন্তু ফজরের নামাজ পড়ি নাই। মনে হয় সবাই পাক পবিত্রও না। যাই হোক, রাস্তায় এসে দেখি যথারীতি গাড়ী বন্ধ, পায়ে হেটে রওয়ানা হলাম, শুরুটা ভালোই ছিল, হাটার গতিও ভালো। রাস্তার দুই পাশে বাংলা সিনেমার গরম পোস্টার আর মাঝে মাঝে এক টিকেটে দুই ছবি'র পোস্টার দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম, এর মাঝে শুরু হল প্রেম পিরিতের গল্প বা মেয়ে ঘটিত আলাপ। দল ভাগ হয়ে গেল দুই তিন ভাগে। কারও গল্পের বিষয় হিন্দি মুভি, কারও প্রেম, আবার কারও কারও অশ্লীল গল্প। আমি সবার সাথেই অল্প অল্প আছি। এর ভিতর আমি ব্যকুবের মত বলে ফেললাম আমরা সবাই আল্লাহু আল্লাহু জিকির করতে করতে গেলে কেমন হয়? প্রতিউত্তরে আমি নানামুখী তিরস্কার এবং উপদেশ শুনা শুরু করলাম।
ওরা বলল আরে ব্যাটা আগে কয়টা পাপ কইরা লই, একটু পরে তো সব মাফই হইয়া যাইব।
আমি বললাম আমাগো দোয়া যে কবুল হইব এইটা তো শিউর না।।
ওরা বলল, আরে গাধা আমরা দোয়া করলে কি আর মাফ হইব। ওইখানে কত আলেম ওলামারা হাত তুলব, সবার সাথে আমরা শরীক হইলে, আমাগো দোয়াও কবুল হইয়া যাইব।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝতে চেষ্টা করলাম, পাপ করলাম আমি, আর দোয়া করল আরেকজন, আমার ঈমানী জোরও মজবুত না, তারপরও আমার সব পাপের ক্ষমা হইয়া যাইব, তাইলে যে, একদিন হাদিসে পড়লাম সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর পাপেরও হিসাব হইব, কি জানি, এইগুলা নিয়া ভাবতে গেলেই আমার সব গোলমাল লাইগা যায়। আমি মাঝে মাঝে শুনি বিনা হিসাবে বেহেশত, আবার শুনি যাররা যাররা পরিমাণ পাপেরও শাস্তি হবে। উহ্ আর ভাবতে পারছিলাম না।
এর ভিতর এক সঙ্গী বলল না টু পয়েন্ট ফাইভ মাইনাস না করলে আর হাটা সম্ভব না। মানে হচ্ছে পেচ্ছাব করবে। এই পেচ্ছাব জিনিসটাও একটা সংক্রামক রোগের মত। একজনের ধরেছে তো বাকী সবারও একই অবস্থা। কিন্তু রাস্তার আশেপাশে কোন জায়গা দেখলাম না। বাস্তুহারা এলাকার দিকের একটা মার্কেটে সবাই ঢুকলাম, উদ্দেশ্য এস্তেঞ্জার। কিন্তু মার্কেটের টয়লেট তালা মারা । অগত্যা আমরা ফেরত আসলাম রাস্তায়। দেখি একটা ৭ টনী ট্রাক পার্ক করা। ব্যস, একজন দৌড়ে গিয়ে প্যান্টের চেইন খুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিল। দেখাদেখি আমরাও। সবারই পড়নে জিন্স প্যান্ট আর পানজাবি। মাথায় তখনও টুপি পড়ি নাই। দুই একজন পড়ছে। জিন্স প্যান্ট পড়ে খোলা জায়গায় বসে পেচ্ছাব করা যায় না।
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আবার রাস্তায় সবাই। এর মধ্যে আমি আর একজন ছাড়া সবাই ধূমপানে অভিজ্ঞ। ওদের সবার তখন চা আর ধূমপানের নেশা লেগে গেল। রাস্তার পাশের দোকানে আবার ব্রেক নিলাম। মিনিট পনেরর মত ব্রেক।
ব্রেক এর পর জোর কদমে হাটা শুরু। এই যাত্রায় একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, সেটা হল মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানার নাম করে ভিক্ষাবৃত্তি। সিজনাল এই ভিক্ষুকরা এতিমদের খাওয়ানোর কথা, মসজিদের উন্নয়নের কথা বলে নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা আবার দলে দলে ভাগ হয়ে মাইক নিয়ে বসেছে, তাদের এক এক জন আবার টার্গেট নিয়ে বসেছে টাকা কামাইয়ের রেকর্ড করার। মানুষজনও হাজী মুহম্মদ মহসীন হয়ে দান করছে আজ। তারা জানে না এই টাকার ১০% ও মসজিদ, এতিমখানায় যাবে না।
গল্প বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে।দু:খিত। এরপর আমরা এস্তেমার খুব কাছাকাছি মিলগেট এলাকায় চলে এলাম। প্রচন্ড ভিড়, রোদও চড়া হয়ে উঠেছে, ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকলাম এস্তেমার মার্কেটে। উদ্দেশ্য কম্বল, জায়নামাজ, তসবিহ,লাঠি বিবিধ খরিদ করা। ঘুরতে ঘুরতে দুই একজন দলছাড়া হয়ে গেল। বেলা প্রায় ১১টা। আমরা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। এর মাঝেই রব উঠে মোনাজাত ধরছে, মোনাজাত ধরছে। পরে দেখি না ভূয়া আওয়াজ। এরকম অনেকবার। এরপর আমরা মার্কেট থেকে বের হলাম। আবার রাস্তায় ফেরত আসলাম। উদ্দেশ্য কোথাও বসে মোনাজাত করে ফেরত আসা। এর মধ্যে কয়েকজন বলল চল বাসার দিকে হাটা ধরি। সামনে যাইতে যাইতে যেইখানে মোনাজাত শুরু হয়, সেইখানে বইসা পড়ুম। আমি রাজি হলাম না, সাথে থাকল আরও দুইজন। ওরা হাটা দিল। আমি ৫টাকা দিয় ৬-৮ মাসের পুরাতন পেপার কিনে, রাস্তার ডিভাইডারে বিছিয়ে বসে পড়লাম, চিপাচিপি করে। আধা ঘন্টা পরে কঠিন রোদ, আর গরম শুরু হইল। মোনাজাত আর শুরু হয়না। কিছুক্ষণ পরে পরেই ভূয়া রব উঠে মোনাজাত শুরু হইছে। শেষমেষ আমারও ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গে। ১২:১৫ মিনিট নাগাদ ধুর! বলে উঠে হাটা শুরু করি। নাকে মুখে তখন ধূলায় অন্ধকার। হাটতে হাটতে চেরাগ আলী এলাকায় এসে দেখি সব নীরব হয়ে গেল। বুঝলাম শুরু হয়েছে মোনাজাত। এক জায়গায় দাড়িয়ে গেলাম, হাত তুললাম। মোনাজাত ১৮-২০ মিনিট স্থায়ী হল। যেই না মোনাজাত শেষ হল, সব পাগলা ষাড়ের মত ছুটল। আমরাও হাটা দিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই ভীড়ের চাপে বাকী দুই সাথীকেও হরালাম। একা একা কিছুদূর হেটে আমি ক্লান্ত, কিন্তু পথ তখনও অনেক বাকী। একটা ড্রিংকস কিনলাম। খেয়ে আবার হাটা। রিকসা, মোটর সাইকেল আর ট্রাকের চাপে রাস্তায় হাটাও মুশকিল। তারপরও হেটে চলেছি। প্রায় শেষের দিকে এসে এলাকার এক পরিচিতের সাথে দেখা। বাকী পথটুকু তাড়াতড়ি শেষ করে বাসায় ফিরলাম। কোনমতে গোসল সেরে খাবার খেয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিলাম। যোহরের নামাজও পড়লাম না।
এরপর আর এস্তেমায় যাই নি।আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা শুধু শারীরীক কষ্ট আমাদের জন্য। কারণ আমরা মন থেকে মুমিন হতে পারি নাই। ধর্ম হচ্ছে মন থেকে সম্পূর্ন মানার বিষয়, কিছু মানলাম, আর কিছু মানলাম না, এই ধর্ম পালন করি বলেই মুসলমানদের আজকের এই দৈন্য দশা। আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার তৌফিক দান করুক। আমীন