বইপড়া কবে ছেড়ে দিয়েছি - এটি অভিমানের কথা। আসল কথা হলো, বই পড়তে চাই, পড়তে পারি না। ক্লান্ত দেহে মন ভাগাভাগি হয়ে যায়। প্রথম মনে বই পড়তে চাই, দ্বিতীয় মনে চাই না। কিন্তু এখনও নীলক্ষেত কিংবা চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে গেলে পুরান বই কেনার লোভ সংবরণ করতে পারি না! এখনও বইয়ের তাক দেখে মন আনন্দে নেচে ওঠে। বই পড়ার অভ্যাসটিকে কিছুটা নষ্ট করে দিয়েছে অনলাইন নিউজসাইটগুলো। নিউজ আর ভিউজ পড়তে পড়তে বই পড়ার আগ্রহটুকু আর থাকে না। কিন্তু আজ বলবো কিছু বইয়ের পাঠক অভিজ্ঞতার কথা।
আমার কাছে বইপড়া যেন লেখকের মনোজগতে আনন্দভ্রমণ। বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ' বা 'কপালকুণ্ডলা', বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী', শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত', রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' বা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' পড়ে এমন মনে হয়েছিল। চরিত্র আর কাহিনি পাঠের সীমা অতিক্রম করে আমি পেয়েছিলাম শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথকে। পেয়েছিলাম স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র বা বিভূতিভূষণকে। আর পেয়েছিলাম তাদের সময়ের সমাজচিত্রকে দেখার অসামান্য অভিজ্ঞতা। আহা কী যে আনন্দ! পড়তাম, হাসতাম, কাঁদতাম, পায়চারি করে হজম করতাম লেখকের বক্তব্যকে। বই পড়ার সময় মনে হতো আনন্দ সাগরে ডুবে আছি, কেউ তা জানে না।
বিদেশি কোন লেখা ভালো লাগলে আমার মনে একটি সিদ্ধান্ত কাজ করে। তা হলো, বাংলায় অনুবাদ করার জন্য 'অবাস্তবায়নযোগ্য' একটি সিদ্ধান্ত। ক্রিস্টোফার মারলো'র 'ডক্টর ফস্টাস' পরেই সিদ্ধান্ত নিলাম লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। এত অভিনব কাহিনি আর বিষয়বস্তু সাধারণ বাঙালি পাঠকের সামনে তুলে ধরা উচিত। বন্ধুদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম, "আ্ইছে, বাংলায় অনুবাদ করবে! কে পড়বে তোর লেখা? ওটা কি মারলো'র লেখার মৌলিকত্ব ধরে রাখতে পারবে?" এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলেও আলবেয়ার ক্যামুর 'দি আউটসাইডার' পড়ে প্রায় অর্ধেক বই অনুবাদ করে ফেললাম। ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' পড়েও এরকম হলো। ডিকেন্স-এর ‘আ টেইল অভ্ টু সিটিস’। প্ল্যাটো বা সক্রেটিসের 'এপোলজি' পড়েও তাই হলো। এরকম অর্ধেক অনুবাদ আছে অনেক লেখার।
এসব বই পড়ার অভিজ্ঞতা এখনও মনে আছে, মানে হলো এরা এখনও আমার মনে বাস করে। আমার আত্মিক জীবনাচরণকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, বলা যায় দৃষ্টিভঙ্গিতে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল রবার্ট ব্রাউনিং এবং ওয়াল্ট হুইটম্যানের লেখা। ব্রাউনিংয়ের 'রাবাই বেন এজরা' একটি দীর্ঘ কবিতা হলেও ওটার বাংলা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম। হুইটম্যানের কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছি। সবগুলোই এখানে আছে।
লুকিয়ে লুকিয়ে একটি বই পড়েছিলাম। স্কুল অথবা কলেজ জীবনে। একবার নয়, মোটামুটি তিন/চারবার। মোস্তফা মীরের 'ঈশ্বরের ঘ্রাণ'। পড়েছি খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে, কিন্তু বের হয়েছি ভালো চিন্তা নিয়ে। পড়েছি, থেমেছি, উপলব্ধি করেছি, আন্ডারলাইন করেছি, পাশে নোটও লেখেছি। বইটির সাবটাইটেল দিয়েছিলাম, 'গন্ধশাস্ত্র'। আমার কাছে গন্ধশাস্ত্র বলে মনে হয়েছিল। ওটি যেন বই নয়, একটি লিখিত চিত্রকর্ম!
হুমায়ুন আজাদের লেখার কথা বলে শেষ করা যাবে না! অনেকেই অবশ্য না পড়েই অনেক বলতে পারেন! নিজের লেখা ও বলার স্টাইলের জন্য অনেকের অপছন্দের কারণ হয়েছেন এই জ্ঞানতাপস। তার 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'কে বলতে চাই, সমকালীন বাংলার পরিপূর্ণ উপন্যাস। এর প্রথম পাতায় লেখেছিলেন 'মইনুদ্দিন মইনুলকে শুভেচ্ছা’। (আমার নামে ভুল থাকলেও সেটি আমার কাছে অনেক আনন্দের স্মৃতি ছিল। অটোগ্রাফসহ বইটি বেহাত হয়েছে একজন অপাঠকের হাতে!) 'আমার অবিশ্বাস' তেমনই একটি মন জাগানো গ্রন্থ। তার কবিতার চেয়ে উপন্যাস আর প্রবন্ধই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। একই ঘরানার লেখক, স্বশিক্ষিত আরজ আলি মাতুব্বর।
বই পড়লেই কি বিশ্বাস বদলে যায়? আদর্শ বদলে যায়? আস্তিক থেকে নাস্তিক, অথবা নাস্তিক থেকে আস্তিক? কই আমার তো তা হয় নি? নিজেকে বদলে দেবার মতো চাপ নিয়ে বই পড়ি নি। এই আশা নিয়ে বই পড়ি নি যে, সেটি আমার জীবনকে উন্নত করে দেবে। পড়তাম, শুধুই আনন্দের জন্য। বই পড়তে আনন্দ পেতাম। অবশ্য আনন্দ পাবো যেসব বইয়ে, সেগুলোই সংগ্রহ করতাম। বই কেনা, বই পড়া, এর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সবই আমার আনন্দের বিষয় হয়ে যেতো। জসিমউদদীনের 'নকশী কাঁথার মাঠ' এবং 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' পড়ার সময় যেসব সমকালীন গান তখন বাজতো চারপাশে, সেগুলোও আমার মনে আছে। সেসব গান আবার যখন শুনি, তখন আমার রুপাই আর সোজনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাংলার স্নিগ্ধ ছায়াময় গ্রামগুলোর কথা।
বই পড়লে আদর্শ বা আমল বদলে যায় এরকম মানসিকতা থাকলে বই পড়ার মতো নির্মল আনন্দ আর জ্ঞান লাভের অমূল্য সুযোগ থেকে বঞ্চিতই হতে হয়। বইকে বা এর লেখককে কোন মতবাদ দিয়ে শ্রেণীভুক্ত করে রাখা আর আকাশ দেখা থেকে দুচোখ বন্ধ করে রাখা একই কথা। পাউলো কোয়েলো’র ‘দি আলকেমিস্ট’ একটি আস্তিক মতবাদের গ্রন্থ। কিন্তু সেখানেও বলা হয়েছে, ধর্মকে জানার চেয়েও বিশ্বকে এবং এর মানুষকে জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। না হলে ধর্মকেও বুঝতে পারা যায় না।
--------------
ব্লগে আমার প্রোফাইলের পাশে ৫ বছর ১১ ঘণ্টা দেখে লেখতে শুরু করেছিলাম। দু'মাস হয়ে গেলো কোন লেখা নেই। এদিকে আবার ডিসেম্বর মাস - সামুর বিশেষ মাস। সবমিলিয়ে কিছু একটা লেখার ইচ্ছে হলো। কিন্তু বই পড়া নিয়ে এত অল্পে শেষ হবে না। লেখাটি সম্পাদিত হতে থাকবে...