১ম পর্ব
৩ য় পর্ব
১৮৫৭ সাল।বাহাদুর শাহ জাফরের সিংহাসনে আরোহণের ২০ বছর পূর্তি হয় এবছরে।সে বছরেই ভারতবর্ষে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের।
পলাশী যুদ্বের পরবর্তী ১০০ বছরের ঘটনা।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে।ভারত দখলে রাখতে ২০০০০০ ভারতীয় ও ৫০০০০ ব্রিটিশ সৈন্যের সমন্বয়ে গঠন করা হয় কোম্পানির সৈন্য বাহিনীর। এসময় দেশিয় সৈন্য বিভাগের লোকদের ওপর চলছিল জুলুম, বঞ্চনা ও নির্যাতন।দেশীয় সৈন্যদের মাঝে দিন দিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধছিল। ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে ধূমায়িত ক্ষোভের চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ ঘটে এনফিল্ড রাইফেলকে কেন্দ্র করে। এনফিল্ড রাইফেলের জন্য যে কার্তুজ তৈরি হয়, তাতে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো থাকে বলে গুজব ছড়িয়ে পরে। কার্তুজ দাত দিয়ে কামড়িয়ে গান পাউডার বের করে রাইফেলে ভরতে হত।এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সিপাইরা তাদের ধর্ম বিনষ্টের কারন দেখতে পায়।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭। বহরমপুর সেনাছাউনিতে সিপাহিরা অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে পুরনো মাসকেট বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করে। ঐ ঘটনায় জড়িত সিপাহিদের নিরস্ত্র ও বরখাস্ত করা হয়। ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের মঙ্গল পান্ডে নামের সিপাহি গুলি চালিয়ে একজন ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করে। বিচারে মঙ্গল পান্ডে ও তাকে সহায়তার অভিযোগে জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেয়া হয়।
১০ মে মিরাটে সিপাহিরা বিদ্রহ করে। এ সময় তারা ৫০ জন ইউরোপিয়ানকে হত্যা করে।১১ মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সিপাহিরা গর্জে ওঠে ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি।’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশার রাজ্য, সিপাহির হুকুম। সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। এ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়। তারপর বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতবর্ষে।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পরাজয় ঘটে ভারতিয় সিপাহিদের।বাহাদুর শাহ জাফর আশ্রয় নেন হুমায়ুনের কবরে। সাথে দুই ছেলে মির্জা খোয়ায়েশ ও জওয়ান বখত। তাঁর মোট ২২ জন ছেলের বাকিরা নিছক প্রাণটুকু বাঁচাতে লালকেল্লা ছেড়া জাম্মা মসজিদের চারপাশে, উর্দু বাজার, রোশন পুরা মালিওয়ারা, ছিপ্পিওয়াড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন, যে যেভাবে পেরেছে। ইংরেজ সৈন্যরা ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৮৫৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেনাপতি হডসনের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সৈন্য হুমায়ুনের সমাধি থেকে সম্রাট বাহাদুর শাহ ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্দী করেন।সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হায়রে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ভারতবর্ষের সম্রাটের বিচার করছে ভিনদেশি বেনিয়া, ভারতেরই মাটিতে। বৃটিশ সরকার শেষ মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং ইংরেজ নরনারী নিধনে উৎসাহ যোগান। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দন্ড দেওয়া হয়।
ক্যাপ্টেন হডসন বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্র ও নাতিকে হত্যা করে তাদের খন্ডিত মস্তক সম্রাটকে উপহার দেয়। পুত্র যুগল ও অন্যান্য প্রিয়জনের করুণ ও নির্মম পরিণতি প্রত্যক্ষ করে বৃদ্ধ সম্রাট শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৫