বহুদিন আগে নিভিয়া ক্রিমের একটা বিজ্ঞাপন ছিল এরকম: বাড়ির কর্তা নিজে নিভিয়া ক্রিম ব্যবহার করার পর পরিবারের আর যারা ব্যাবহার করে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কর্তা বলছে: এ আমার ছেলে, এ নিভিয়া ব্যবহার করে; এ আমার মেয়ে, এ-ও নিভিয়া ক্রিম ব্যবহার করে। এভাবে যেতে যেতে এক পর্যায়ে স্ত্রীর পালা আসলে বলে: এ-ও নিভিয়া ক্রিম ব্যবহার করে “এ্যান্ড শি ইজ মাই” বলে একটা পজ নেয়। তারপর “নেভার” বলে আরেকটা পজ নিয়ে কোনো ডায়লগ ছাড়া দৃশ্যে ঢুকে যায়। বিজ্ঞাপনের এ পর্যায়টি আমার খুব মজা লাগতো – নেভার।
তো এই নেভারের সাথেই আমাদের, মানে পুরুষদের ‘এভার’ জীবন কাটাতে হয়। ভালোয় কাটে, মন্দে কাটে, ছন্দে কাটে, দ্বন্দ্বে কাটে। তারপর এক পর্যায়ে এক বা একাধিক “যোগচিহ্ন” যোগ হয় – যাদের পরিচয় ছেলেপুলে। ওরা এই দ্বন্দ্বে-ছন্দে, ভালোয়-মন্দে যোগ ঘটায়। কখনও কখনও যোগাযোগও। কোনো ছেলেপুলের বাবাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে, জীবনে একবারও তার স্ত্রীকে বলেনি: এই ময়না বা টিয়া, পারুল বা কামরুল (যোগ চিহ্নগুলি) না থাকলে কবে এই সংসার ছেড়ে বাউল বা রকস্টার হয়ে যেতাম!
আমাদের, মানে আমার মতো পুরুষদের বাউল, রকস্টার, ফিল্মস্টার কিছুই হওয়া হয় না। “হইলেও হইতে পারিতাম” – এমন “মনকলা” খেতে খেতেই দুইকুড়ি জীবন পার। কিন্তু ঐ যোগচিহ্ন বা চিহ্নগুলি তো ততোদিনে বালেগ হয় উঠে। তারা দেখে বাবা নামের লোকটা তো আসলে মুসোলিনির বংশধর, কৃপন, ঠগ এবং জালাতনকারি। এই লোকের জীবন দুটি শব্দে বাঁধা – ডু এবং ডোন্ট।
কথা কিন্তু ঠিক। আমি এবং আমার মতো অনেক পুরুষই আসলে “হ্যাপেন্ড টু বি এ ফাদার”। বাবা হওয়ার আগেই যে বাবা হওয়ার কথা ভাবতে হয়, প্রস্তুতি নিতে হয় – মানসিক, আর্থিক ও শারীরিক – আমরা জানতামই না। কেউ জানায়ও নাই। সোশাল বা পারিবারিক কাউন্সেলিং-এর বাহাদুরী তখন ছিল না। বাবা হতে শিখেছি নিজের বাবার কাছে। সেই বাবা ভালো না মন্দ তার বিচার যদি না-ও করি, উপযোগী যে না সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এদিকে জীবনের এ গলি, ও গলি, খাল-খানা-খন্দ, জলাডোবা পার হয়ে নিজেকে যখন আবিষ্কার করি যে আমি তো “ভালো” বাবা না, তখন আর বেইল নাই। ভালো বাবা হওয়ার সময় পার। শুরু হয় অভিজোযন প্রক্রিয়া। ডেফিনিটলি বাবার পক্ষ থেকে। সেখানেও হ্যাপার শেষ নাই। এমবাপ্পে-গতির পরিবর্তনশীল সমাজে দাবার চাল চলে না। খুঁড়িয়ে, গড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে তালে তাল মিলিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ হয়ে যেতে হয়।
ছেলেপুলেদের মা-এর কথা কিন্তু আলাদা। বাইরে থেকে শ্যাওলা-ময়লা যাই দেখা যাক না কেন, মা-এর সাথে ছেলেপুলেদের সম্পর্ক সুঠাম ও সুগঠিত। বাবার বা বাবাদের কপালে সেটা লিখা নাই।
এইটুকু পড়ে “গোইং টু বি ফাদার”গণ আবার হতাশ হয়ে পইড়েন না। মূল ঘটনা কিন্তু এতোটা হতাশাজনক না। এ যুগের ছেলেপুলে একটু বেশি বেশি একগুঁয়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা অন্যকে আক্রান্ত করে না। এদের (বেশিরভাগের) মগজে মুসোলিনির কোনো জায়গা নাই। গ্রাম্যতা নাই। এরা (বেশিরভাগ) অসাম্প্রদায়িক। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না। প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি এদের মমতা অপরিসীম। কাউকে দেবজ্ঞান করে না, আবার বিদ্বেষও পুষে রাখে না। এরা সৃষ্টিশীল। দরদী। আত্মবিশ্বাসী ও উদার।
আজ আমার ছেলেটার জন্মদিন। ওর মতো উদার মনের ছেলে না থাকলে আমার নাম এতোদিনে খরচার খাতায় উঠে যেতো।
শুভ জন্মদিন ব্যাটা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৩