বাবা-মা। দুই ভাই-বোন। আট এবং পাঁচ বছরের। এই নিয়ে বেশ সুখেরই সংসার ছিল ওদের। শহরের একটি নোংরা বস্তির একেবারে কোনের দিকে জলার উপর টং এর ঘর ছিল। ছোট্ট চিকন ঝাল চানাচুরের ঠেলার আকারের ঘরটিতে গাদাগাদি করে থাকতো। গরমে জলা থেকে ওঠা ভ্যাপসা ভাপ, মশা আর শীতে হাড় কাঁপানো মরণ কামড়। সাথে উভয় ঋতুর বোনাস দুর্গন্ধ তো আছেই। দু’বেলা খাবার নেই, কখনো সারাদিন ঘরে ফেরা নেই। সেই সাথে নেই স্কুল গোসলও। ভ্যান চালক বাবা আর দালান বাড়িতে কাজ করা মায়ের সাথে দিনগুলি কাটছিল বেশ। অনেকটা মাঘ মাসের আকাশের মত নিরুত্তাপ এই সূর্য এই মেঘ সুখে। সারাদিন ছুটোছুটি হুটোপুটি। পুরোনো ছাট কাপড়ে প্যাঁচানো ডিম্বাকার একটা বলে সজোর পদাঘাতই ছিল নিত্য রুটিন। কখনো কাগজ কুড়িয়ে কখনো বোতল জমিয়ে দূর হত দৈনন্দিন একবেলা খাবারের চাহিদা। কোনদিন তাও জুটতো না। তবু চলতো নিরন্তর দাপাদাপি। অনেকটা প্রজাতন্ত্রীয় মহানন্দেই চলছিল দিনগুলি।
কিন্তু সদ্য আটের নীবিড়ের জীবনে মাঝরাত্রি তুল্য চরম নীরবতা আনার জন্য যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল জীবন নামের খেয়ালী পসরা। অনেকটা হরতালের দিনের রাজপথের মত শুনশান ফাঁকা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। সেখানে বিচিত্র রকমের মানুষ আপন গন্তব্যে ছুটছে তো ঠিকই কিন্তু বিরস মুখে। কখন যেন কোন দিক হতে মাথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জীবন নামের বোঝাটা। এক সময় সত্যি মাথার উপর আচমকা ভেঙ্গে পড়ল ক্ষুধা নামের অপয়া জীবনটা। এজন্য বাবাকে গালি দেয়ার সময় পর্যন্তও পায় না। তার আগেই একদিন আচমকা ঘোষণাহীনভাবে জীবন থেকে উধাও হয়ে যায় বাবা। বাবা নামের আজব খাদ্য যন্ত্রটি।
মা শুধু কাজে যায় আর ঘরে ফিরে মুখ ঢেকে বসে থাকে। মাঝে মাঝে দু’একবার চোখ মুছে। নাক টেনে এদিক ওদিক মাথা দোলায়। কিন্তু বলতে পারে না বাবা গেল কোথায়। কেনইবা আসে না। বেশ কয়েকদিন পর ভ্যান মালিকের গ্যারাজে খোঁজ নিতে গেলেন মা। কিন্তু পরিচয় দেয়ার সাহস পর্যন্ত পায়নি। পিছে আটকে রেখে ভ্যানের ক্ষতিপূরণ চেয়ে বসে মালিক। মালিকপক্ষ যে বরাবরই উদার হস্তের “শুধু দিনের শেষে ভ্যান এবং জমার টাকাটা নেয়ার ক্ষেত্রে” তা তো তাদের জানাই। তবে গ্যারাজের এক কর্মচারীর মুখে শুনে এসেছেন ভরসা নামের চালহীন পতিদেবতার মুখখানি বেশ কদিন হলোই নিখোঁজ। মালিক নাকি ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন আর দিচ্ছেন না ভ্যান। এমন কী ছোট ছেলেটাকে বিনে পয়সায় কাজের জন্য গ্যারাজে রেখে গেলেও নয়।
অবশেষে খাদ্য যন্ত্রের অবশিষ্ট ভরসা মা পেলেন আসল জীবনের টান। যেদিন শুনলেন তার মালিক বাসা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় যাচ্ছেন। সে অনেক দূর। দিনে একবারই পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে ফেরা আর হয় না। দীর্ঘদিন কাজের সূত্রে মালিক সদ্য নিখোঁজ স্বামী হারা ঝি’কে সাথে নিতে চাইলেন ঠিকই। তবে তার দুই ছেলেমেয়ে সহ একেবারে বাসার সন্নিকটে কোন বস্তিতে থাকার শর্তে। যাতে সঠিক সময় মত কাজে যোগদান এবং দীর্ঘ সময় সহ যখন তখন বাড়তি দায়িত্বে কাজ আদায় নিশ্চিত করা যায়। অগত্যা কী আর করার, পুরনো বস্তি ছেড়ে একটি কাপড়ের পুটলি ছেলের হাতে, মাটির হাঁড়ি কাসার পুটলিটি নিজের হাতে নিয়ে হাঁটা দিতে হয় নতুন বস্তির খোঁজে।
এভাবেই চলছিল বেশ ক’সপ্তাহ। কিন্তু পুরোনো কাপড়ের পোটলার বল বন্ধুদের ছেড়ে কী আর বেশি দিন থাকা যায়। অগত্যা মায়ের অনেক আদেশ এবং শর্ত মাথায় নিয়ে অবশেষে হাঁটা দেয় পুরোনো বন্ধুদের আড্ডায়। মা’ও বেশি বাধা দেয় না। দু’চারটা বোতল কুঁড়িয়ে যদি কিছু পায়। জীবন নামের পাপের সাথে সেঁটে চলার কায়দাটুকু যদি শেখে। তবে এ বাঁধন ছেঁড়ায় কোন ঝি-মায়েরই বা আপত্তি থাকতে পারে!
যাবার দিন মা সাথে থাকায় বুঝতে পারেনি কী জৌলুস ওর চিরচেনা বস্তির বাহিরের শহরে। নামটা সঠিক জানে না তবে ওর দলের অপোকৃত চালাক দোস্তটির মুখে শুনেছে এর নাম নাকি “ঢাহা শহর”। একবার এক লোকমুখে শোনা “ঢাহা মিথ্যা” কথাটার সাথে “ঢাহা” শব্দের মিল খুঁজেই মাথা নেড়েছিল। আর দোস্তকে বলেছিল মনে থাকবানি এর পর নামটা। তবে ওর মনে সন্দেহ ছিল দোস্তর বলা নামটাতে সামান্য ভুল ছিল। দোস্ত তাকে “মিথ্যা” শব্দটারে বলতে ভুলেই গেছিল। আসলে পুরো নামটা হবে “ঢাহা মিথ্যা শহর”। কিন্তু দলে টিকে থাকার এবং দোস্তর সুনজর পাবার জন্য দোস্তের ভুলটারে আর মুখে নেয় নাই। শুধু হু হু করে দোস্তের সাথে মাথা দুলিয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে নীবিড় যখন অতি পরিচিত জলসাখানার সন্নিকটে পৌঁছালো তখন আনন্দে তার হৃদপিন্ড দরাম দরাম করে বাজতে থাকে।
এই তো ওর চিরচেনা জায়গা। দোস্তের ভাষায় ছোরার্দীমাট, ঢাহা ভাচ্চিটি এলাকা। এইতো ইয়াং ইয়াং সব পোলা-মাইয়া। সারাদিন হাসে আর দল বাইন্দা গপ্প করে। যেন দিনডার শেষ আছে মাগার গপ্পের শেষ নাই। হারাদিনই কিছু না কিছু খায়। বাদাম, চানাচুর আরো কত কী। মাঝে মইধ্যে একজন আরেক জনেরে গুঁতা দেয়। কেউ আবার শক কইরা মাইয়াগো চুল ধইরা টানও দেয়। এই তো সব ব্যাগ আলা পোলা-মাইয়াগো দল। ঠ্যালাঠেলি কইরা নাল বাসে ওঠে। এইতো সব রোজ দিনকার দ্যাহা।
অবশেষে ভাবনার জগৎ থেকে মন ফেরে ওর। আর একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে দোস্তদের। অল্প একটু যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে। শুধু হাতের মাথায় একটু লম্বা গাছের চিকন ডাল থাকা চাই। নয়তো হাতের দৌড় যে----পর্যন্ত। দোস্তদের দেখে আচমকা যেন আওয়াজ হারিয়ে যায়। পিছে দোস্তরাই আবার আগে দেখে ফেলে ভেবে জোর গলায় চিৎকার করার চেষ্টা করতে থাকে। তবে আনন্দে আত্মহারা খুশিতে ডগমগ, হারানো দিনগুলো বাষ্প দলা হয়ে গলার কাছে আটকে থাকা, আর এক রকম অনুভূতি নিয়ে খিচুড়ি পাকানো নীবিড়ের মুখ থেকে শুধু বাবুই পাখির মত চিঁ চিঁ চিঁ আওয়াজই বেরোতে লাগলো। এবং তার আশংকা সত্যি করে দিয়ে পরানের দোস্তই আগে বলে উঠলো।
ঐ আমাগো নীবিড় না? দ্যাখ ঐ দ্যাখ। কই ছিলি, কেমন ছিলি, জায়গা কেমন, পোলারা কেমন, এমন অনেক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে শুধু এতটুকুই বলতে পারলো দোস্ত আজ থাইকা আমি তগো লগে এইহানেই থাকুম।
আর কিছু বলার আগে, কেই কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সকল শুকনো হাড় জিরানো দল হই হই করে ওঠে। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে ওঠে ঐ বল কই, বল দেখছস নি কেউ।
আবার শুরু হয়ে গেল চিরচেনা সে পদলুন্ঠনের কর্মযজ্ঞ। আর তার সমাপ্তি পর্ব চললো রোকেয়া হলের আড়ালে সূর্যেও সমস্ত তেজদীপ্ততা হারিয়ে নিভে যাওয়ার আগে অসীম আকাশ জুড়ে গোধূলী লগ্নের রক্তিম আভা ছড়িয়ে দেয়া পর্যন্ত।
অবশেষে সোহরাওয়ার্দী ময়দানে একসময় গাছের ছায়া ধীরে সর্ন্তপণে নেমে আসতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আলো জ্বলার সাথে সাথে বাড়তে লাগলো সোহরাওয়ার্দী ময়দানের নীরবতা। বাড়তে থাকে তীব্র সুগন্ধিযুক্ত রঙ্গিন পোশাকের বাহারী কাঁচের চুড়ির মহিলাদের আনাগোনা। নিরাপত্তারক্ষীদের হাঁক-ডাক। আর বাড়তে থাকে সোহরাওয়ার্দী’র পাশের ফুটপাতটাতে নানা বয়সী কৃষ্ণ বর্ণের নানা কর্মের ঘরহীন অভুক্ত মানুষের ভিড়। একদা বাড়ন্ত ভিড়ে থেমে আসে গুঞ্জন। অনাহারীদের দীর্ঘশ্বাসে গুমোট পাকিয়ে ভারী হয়ে আসে চারপাশের বাতাস। সেই সাথে নেমে আসে ফুটপাতের স্বাধীনতা।
নীবিড়ের ভাষায় “ঢাহা মিথ্যা শহরের” ঘুম।
এ যাত্রায় না খেয়েই নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হয় ওর। সেই বেলা যখন মাথার উপর বর্শীর মত হানতে শুরু করেছিল মা খাইয়ে দিয়েছিল দু’নলা ভাত আর একটা আধা পোড়া আলু। তবে দোস্তদের সাথে দেখা হওয়ার আগেই খেয়ে নিয়েছিল মায়ের দেওয়া শক্ত বিস্কুটটা। পাছে আবার দোস্তরা ভাগ বসায় এই আশঙ্কাতেই তড়িৎ ভোজন। খেলা শেষে পানি খাওয়া, অতঃপর সম্পূর্ণ অনাহরেই ঘুমিয়ে পরা। সদ্য আটের বালক বুঝতেই পারলোনা ঠিক যে সময় ওর পেটে চিড়িয়াখানার কুমিরটা কামড় দিয়ে উঠেছিল ঠিক ঐ সময়ই তার স্নেহময়ী হতভাগী মা ডুকড়ে ওঠার শব্দ চেপে রেখেছিল ছেঁড়া আঁচল খানা দিয়ে। পাশ ফিরানোর সময় মনের অজান্তেই বেড়ে উঠেছিল গলার সন্নিকটে আটকে থাকা বাষ্প দলার চাপ। আর অস্ফুট বচন “খোদা পোলাডারে দেইখ্যা রাইখো”।
হায়রে জীবন কারো রাখার জায়গা নেই। আবার কারও সোহরাওয়ার্দীর মত বিশাল জায়গা থাকার পরও রাখার জিনিসই নেই!!
সৃষ্টিকর্তা? গরীব গরীব খেলার ফল ঘোষণাতে আর কতটা সময় তুমি নেবে? কতটা সময় পর তুমি ধনী ম্যাচের শেষের বাঁশি বাজাবে। আর কতবার তুমি একই আংড়া তার ঘুমন্ত আগুনেই জ্বালাবে।
স্বপ্ন যে এমন হতে পারে তা একজন মায়েরই পক্ষে বোঝা সম্ভব। কী তীব্র সে স্বপ্নের যন্ত্রণা। কী ভীষণ মাথা ধরা সে অভিজ্ঞতা। সর্বহারা অক্ষরজ্ঞানহীন কোন মায়ের পক্ষে যার তীব্রতাও সঠিকভাবে অনুভবে অনূদিত হয় না। একটা ট্রেনের পিছু ছুটছে মা। কিসের টানে কিসের পিছু তা অজানা। যে কোন মূল্যেই যেন ট্রেনটাকে ধরতেই হবে। গা ঘেমে দরদরিয়ে পড়তে থাকে, সমস্ত শরীর যেন জ্বালা করে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে। গলার কাছে শ্বাস আটকে আসছে। যেন বুকের উপর কেউ একমন পাথর বসিয়ে দিয়েছে। তবু চলছে ট্রেনের পিছু ছুটে চলা। ধরা তার চাই-ই-চাই। আচমকা নীবিড় নীবিড় করে চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে যায় মায়ের। আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে আগ্নেয়গীরির লাভা। জ্বলন্ত ঘামে পড়ে তা যেন জ্বলন্ত লৌহ দন্ডকেই পেয়ে বসে।
স্নেহময়ী বুঝতে পারলেনও না ঠিক ঐ সময়ই তার নীবিড় মা মা করে ঝাপিয়ে উঠে বসেছে। কী আজব স্বপ্ন ছিল চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যাচ্ছে ও। পড়ে যাচ্ছে তো পড়ে যাচ্ছেই! তাকে ধরার কেউ নেই। আচমকা নগর পরিচ্ছন্ন কর্মীর ঝাঁটার খোঁচায় ঘুম ভেঙ্গে যায় নীবিড়ের।
একী, আশেপাশে কেউ নেই। দোস্তরা সব উধাও। নীবিড় এতটুকু বোঝার অভিজ্ঞতা অর্জন করে যে সকালটা সবার ময়লার ডাস্টবিনে হুমড়ি খেয়ে পরার জন্য। সারাদিনের কুড়ানো টোকানো সে এখান থেকেই শুরু। উদাস চোখে শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকলো যতক্ষণ পর্যন্ত না ওর পেটে আবার চিড়িয়াখানার কুমিড়টা নাড়া দিয়ে ওঠে।
স্পষ্ট করেই বলছি, আসলে নীবিড় কিন্তু পথ শিশু নয়। পথশিশুদের সাথে বেড়ে ওঠায় ওর মাঝে পথ শিশুদের বৈশিষ্ট্যগুলো পূর্ণতা পেয়েছে মাত্র। বস্তিবাসী হলেও আসলে অনাহারী নয়। নিতান্তই ভাগ্য পরিহাসে ওর আজ এই অবস্থা, নয়তো মোটামুটি স্বাচ্ছন্দের বস্তি পরিবারই ছিল ওদের। মা বাসায় কাজের পরে বস্তির অন্য সকল মহিলাদের সাথে গল্প- গুজব করে কিংবা অযথা সেজেগুজে সময় নষ্ট করতো না। সামান্য পড়াশুনা জানতো মা। তাই অবসর সময়টা ওকে দু’একটা অক্ষর শিখিয়ে বা ছড়া পড়িয়ে সময় পার করতো। সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড়, নতুন বই বা বাক্স ভর্তি খেলনা হয়তো দিতে পারতো না। তবে শিক্ষার গুরুত্ব এবং বড় হবার স্বপ্নবীজ সামান্য হলেও নিজ ভাষাতে বুঝিয়ে দিত ঠিকই। অনেক রাতে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিতান্তই কুপি জ্বালিয়ে অপেক্ষা এবং অপচয় না করে নানা রূপকথার কাহিনী শোনাত। কখনোই হয়তো পুরো কাহিনী বর্ণনা করতে পারতো না, আবার কখনো এক কাহিনীর সাথে আরেক কাহিনী মিশিয়ে ফেলতো। আবার কখনো নিজের পছন্দের মত করে নিজের অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর সাথে মিলিয়ে নিজেই কাহিনীর গতি পাল্টিয়ে দিত।
তখন অন্ধকারে মায়ের কোলে মাথা রেখে কখনোও দু’একটা প্রশ্ন করে নিশ্চুপ শুনে যেত ও। অথচ ভাগ্য আজ কুড়ে বস্তিতেও ঠাঁই দিল না। পরিহাসের অট্টহাসিতে আজ পথশিশু। বাধ্য হলো সম্পূর্ন ভিন্ন জীবন যাপন করতে। কেননা হঠাৎ করেই এসেছিল ওর জীবনের ভয়ংকর পট পরিবর্তন। জীবনে একবারই বাবার কাছ থেকে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের গাড়ি উপহার পেয়েছে। অথচ সেই খুশির আয়ুও গতকাল শেষ হয়েছে। সামান্য কেঁদে, অনেক বলে কয়েও মাকে বোঝাতে পারেনি গাড়িটা ওর কত প্রিয়। শেষ অবধি সাথে আনা হয়নি সেটিও। রোজকার মত আজও ঘুম ভেঙ্গে মাথার কাছে খুঁজেছিল সেটি। বুকটাতে একবার দরাম করে উঠেছিল হারানোর ভয়ে। ভাগ্যিস মনে পড়েছিল আনা হয়নি গাড়িটি। নয়তো আজ অন্য কিছুও ঘটতে পারতো। একদিক থেকে ভালো হতো নিখোঁজ হয়ে যেতে পারতো অভিশপ্ত এ জীবন থেকে।
পেটে হাত বুলাতে বুলাতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল শুধু। এর মধ্যেই এক মাঝ বয়সী লোকের ডাক শুনে উঠ দাঁড়ায়। ছোট-বড় ভারী-হালকা চকচকে মালে বোঝাই ভ্যানটার দিকে হাঁটা দেয় লোকটির উদ্দেশ্যে। এত বোঝার মধ্যে শুধু বাঁশের বোঝাটাই ওর দ্বারা নির্নীত হয়। বাকি সবই অচেনা থেকে গেলো অচেনা জীবনের মতই।
এই ছেলে কাজ করবি এখানে? সকালে নাশ্তা, দুপুরে ভাত পাবি। হাঁক ছাড়ে মাঝ বয়সী লোকটি।
শুধু খাবার এবং বোঝাই ভ্যান থেকে খেলার সরঞ্জাম কিছু পাবার আশাতে না ভেবেই হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায়। এমন মোচড় যার পেটে দেয়, তার আবার ভাবনা-টাবনা কিসে।
আজকের খুশিটা কাউকে জানায় না। দোস্তরা বারবার জানতে চাওয়ার পরও শুধু বলল ঐ ওদিকে। কিন্তু অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাউকে কিছুই বলতে চায় না। পিছে ওর আবার খাবারের রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যায়।
সারাদিন অনেক খেটেছে। খাওয়াটাও মন্দ হয়নি। যদিও সকালে শুধু একটা রুটি দিয়েছে। তবে দুপুরের খারারটা ছিল বেশ। পেট ভর্তি ভাত, আলুভর্তা, ডাল আর ডিমের ছেড়া অংশটুকু!
কে বলবে সে কথা।
বাব্বা আস্ত একটা ডিমের থেকে খাবলে দেয়া হয়েছে ওকে। কাল আরও বেশি কাজ করবে। সকালের নাশতার পরে ওর কাজের জোরতৎপরতা দেখেই না এতগুলো ভাত দেয়া হলো। যদিও মালিক মতন লোকটি চেয়ারে বসে খেয়েছিল। নিচে মাটিতে বসে মালিকের প্যাকেটটা ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। তবে আশেপাশে কেমন জানি একটা বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে মালিকের চোখের আড়ালে প্যাকেটটা ফেলে আসার সময় হাত দিয়ে, চোখের কাছে নিয়ে দেখেছে চিকন একটা সাদা ভাত। কী সুন্দর গন্ধ প্যাকেটটাতে। প্যাকেটের মাঝে তেলতেলে পিচ্ছিল একটা পরিথিনও ছিল। কয়েক পা হাঁটার পরও ফিরে যেয়ে পিচ্ছিল পলিথিনটাতে বার কয়েক হাত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ঘষে শেষ অবধি হাতখানা কব্জি পর্যন্ত চেটেছিল।
বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি গন্ধটাতে চাটার সময় ওর চোখ কেন জানি বন্ধ হয়ে এসেছিল। অনেক ভাবনার পরও সে রহস্যের কোন কুলকিনারা করতে না পেরে অবশেষে ভাবনাতেই ক্ষ্যান্ত দিয়েছে। থাকনা বাকি জীবনটা তা রহস্য হয়ে। খাওয়াতো হয়েছে!!
আজ আর খেলা হয়নি ওর। সামান্য মন খারাপ না করে, হইচই না করে চটজলদি ঘুমিয়ে পড়ে। তবে একটা বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে নামাতে পারে না- আচ্ছা কিসের জন্য এত সাজিয়ে ছোট ছোট এতগুলো ঘর বানানো হচ্ছে। লাইন করে মাঠের চারপাশ দিয়ে কত্তোগুলো ঘর। আগের বস্তির সামনের চানাচুরের দোকানটার মত ছোট ছোট ঘরগুলা। দু’একটা অবশ্য সামান্য বড়। শুধু মনে মনে ভাবতে লাগলো আচ্ছা এতগুলো ঘরে একসাথে চানাচুর বিক্রি করার কী দরকার! কালকে মালিককে সাহস করে একবার বলেই দেখবে। আচ্ছা কত মানুষ আসবে চানাচুর খেতে? মালিক কী তাকে একটু দেবে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ? ভাবতে ভাবতে অতল ঘুমে হারিয়ে যায় ক্লান্তি ভরা রুগ্ন ছোট দেহটি।
পরদিন যথারীতি ঘুম ভাঙ্গে। নগর পরিচ্ছন্ন কর্মীর খোঁচাতে নয়। বার কয়েক কালকের দোকান ঘরটাতে যাবার চেষ্ট করেও ব্যর্থ হয়। ইয়া বড় একটা লোহার গেট আটকানো। অবশেষে গেটের পাশে বসে মালিকের অপেক্ষায় কারেন্ট তারের উপরের কাক গুনতে থাকে। দম ফাটানো অস্থিরতায় ভরা অপেক্ষা আর যাবতীয় সংশয় দূর করে মালিক লোকটির যখন দেখা মেলে খিদেয় ততক্ষণে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মালিক লোকটি পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায়। যেন চিনতেই পারেনি।
আরে এটা কী করে হয়? নিজেকে প্রশ্ন করে ও। মালিক নিশ্চয় ফোনে কথা বলছিলেন জন্য ওকে দেখেনি। কিন্তু লোহার গেটটার সামনে দাঁড়ানো পুলিশের কাপড়ের লোকটি যে ওকে ঢুকতে দিবে না এটাও কী মালিকের একবার খেয়াল হলোনা। মানুষ এত ভুলো মনা হয়? নাহ্, নিশ্চই মালিক ওকে ভেতরে ঢুকতে দিতে বলেছেন। পুলিশের কাপড়ের ব্যাটাই তা খেয়াল করেনি।
চোখের আড়াল হতে হতে মালিক যখন পিছনে ফিরে তাকালো ততক্ষণে অবস্থা যুদ্ধ যুদ্ধ প্রায়। শুধু পুলিশ ব্যাটার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টায় শরীরের শক্তিটুকু নিঃশেষ। আর হতের ধরা জায়গাটুকু ব্যাথায় লাল হয়ে উঠেছে। যদিও ওর আশঙ্কা ছিল আর একটু হলেই হাতটা গেছিল প্রায়।
এক ছুটে যখন মালিকের কাছে পৌঁছায় মালিক তখন অন্য সবার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। অযথা সময় নষ্ট না করে কাজে হাত লাগায়। কিন্তু ততক্ষণে পেটের কুমিড়টা কামরানো বন্ধ করে আস্ত দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে ওর প্রতি খেয়াল হারালো সবাই। যেন অদৃশ্য কেউ। তবুও ছোট হাত দুটো ব্যস্ত থাকে । রুটি দেয়নি তো কি হয়েছে? দুপুরে নিশ্চয় আস্ত একটা ডিম দিবে। তাই হয়তো এবেলায়------!
হ্যাঁ দুপুরে ভাত দিয়েছিল ঠিকই তবে ডিম নয় শুধু ডাল দিয়ে। তাও আবার গতকালের চেয়ে কম। আর মালিকতো আজকে খায়ই নাই। চোখ বন্ধ করে তাই হাতও চাটা হলো না। তবু শ্রম চললোই কালকের আশায়।
যথারীতি আর একটি রাত গড়িয়ে ভোর হয়। কিন্তু আজ আর লোহার গেটের পাশে অপেক্ষা না করে ফুলের বাগানের পাশে প্রাচীরের ভাঙ্গা অংশটা দিয়ে ভিতরে যায়। কাল রাতে ফেরার পথে ভাঙ্গাটা আবিষ্কার করা। ভিতরে ঢুকেই চোখ কপালে ওঠার দশা ওর।
একি! কাল মালিককে খুশি করার নেশায় একবারও পুরো মাঠটা চক্কর দেয়া হয়নি। সব দোকান তো প্রায় বানানো হয়ে গেছে। খুব জলদি বুঝি চানাচুরও আনা হবে। কত লোক যে তা খেতে আসবে। সেই সাথে অজানা এক আশঙ্কাতে ভরে ওঠে চোখ দুটো। একবেলা খাবারের ব্যবস্থাটিও যে বন্ধ হয়ে যাবে। উদাস মনে সদ্য তোলা ঘরটির মাঝে মাটির উপর বসে থাকে। এই প্রথম অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বুঝতে পারা সদ্য আটের কঙ্গালটা।
সেদিন কাজ শুরু হয় অনেক বেলা করে। ওর কাজ করার মত সুযোগ মেলেই না বলতে গেলে। মাঝে মধ্যে গজালের বাক্স, হাতুরিটা টেনে দেয়া ছাড়া। একবার মালিকের চেয়ারটা সরিয়ে দিতেই ক্ষুধার সাথেই বেড়ে যেতে লাগে বেলার তেজ। যখনই আজ আর খাবার পাবার আশা ছাড়তে যাচ্ছিল মালিকের ডাকে মুখ ঘুরে তাকায়।
আর খাবার দেখে দু’পাটি দাঁতের গজানো সবগুলো বের করে আলেকজান্ডারের রাজ্য জয়ের হাসিতে ভরিয়ে দেয় চারপাশ।
খেতে খেতে কথা বলতে থাকে মালিক। প্রথম দিনের পর এই প্রথম কথা বলে ওর সাথে। খাবারের কৃতজ্ঞতায় হাসি হাসি মুখে শুনতে থাকে সেগুলো। কাল থেকে আর কাজ হবে না। আর সবার সাথে ওর প্রয়োজন শেষ। ফেরার সময় বেঁচে যাওয়া দুটি গজাল ডান-হাত বাম-হাত করতে করতে ফিরে আসে শোবার জায়গাটিতে। সিদ্ধান্ত নেয় আজ সবাইকে খুলে বলবে গত কয়েকদিনের সকল ঘটনা।
কিন্তু সন্ধ্যার পর অনেকগুলো পুলিশ গাড়ি থামিয়ে থেকে যায়। ওদের শোবার জায়গাগুলোতে। এক সময় ভিড় বাড়তে থাকে। বড় মোঁচওয়ালা একজন পুলিশ জানিয়ে দেয় আজ আর আশপাশের একশো হাতের মধ্যে শোয়া হবে না কারো। কী জন্য তা কেউ জানতেও চায় না। তবে পুলিশের হাতে ধরা শিকলে বাঁধানো কুকুরগুলো আর দু’একটা ধমক খেয়ে ঘটনাটা দেখার চিন্তাও বাদ দেয় সবাই। সে রাতে সোহরাওয়ার্দীর শেষ মাথায় গাছের নিচে কুয়াশা ভেজা ঘাসের উপরই শুয়ে পড়ে।
যথারীতি আরোও একটি নতুনি দিনের সূর্য ওঠে। নতুন রীতিতে খাবার জোগানোর জন্য আজ নীবিড়কে দোস্তদের সাথে একটা ছালা হাতে বেরিয়ে পড়তে হয়। কাগজ আর বোতল জমাতে জমাতে যখন রাষ্ট্রের এই স্বেচ্ছাসেবী পরিচ্ছন্ন কর্মীরা পেটে কুমিরের কামড় অনুভব করে ততক্ষণে বেলা পশ্চিমে হেলে পড়েছে।
সারাবেলার জমানো নিয়ে যখন মাঠে ফেরে রাস্তার চারপাশে তখন শত শত পুলিশ। ওদের শোবার জায়গাটার সামনে কোথা থেকে যেন রং-বেরং এর নতুন অনেকগুলো ফুলের গাছ হঠাৎ করেই গজিয়ে উঠেছে। দুই পাশের মোড়ে অনেক মানুষের জটলা। সব বয়সেরই মানুষ দেখা যায়।
এত মানুষ চানাচুর খাবে? বিস্ময়ে ভরে যায় ছোট চোখ দুটো।
হঠাৎ করে অনেকগুলো গাড়ির একসাথে আসতে দেখে একটু এগিয়ে যায়। পুলিশগুলো যেন হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ও যে গাড়িগুলোর অনেক কাছে চলে এসেছে তাতে যেন পুলিশগুলোর হুশই নেই। সবাই যে গাড়িগুলো নিয়ে ব্যস্ত। বুঝতে পারে না যদি এত কাছেই আসতে দেবে তাহলে খামোকা এত হাবভাব নিয়ে আগে তাড়িয়ে দিচ্ছিল কেন। বলতো গাড়িগুলো আসলে এত কাছে আসতে দেবে তাহলে সব দোস্তদের নিয়েই আসতো। দৃশ্যটা সবাই মিলে একসাথে দেখলে ভালো হতো না!
গাড়ি থেকে অনেকগুলো স্যুট-প্যান্ট পড়া লোক নামতে থাকে। এদের একজনকে ওর চেনা চেনাও লাগলো। টিভির দোকানের বড় টিভিটাতে বুঝি কয়েকদিন দেখাইছিল। ওর মনে হয় বুঝি কোন সিনেমার নায়ক। রাস্তার পাশে থেকে তো আর চানাচুর খাইতে পারে না তাই আসছেন এখানে চানাচুর খাইতে। নিশ্চয় এখানকার চানাচুর অনেক ভালো।
কিন্তু পিছন পিছন এত ক্যামেরা ক্যান?
বুঝছি। বুঝি শুটিং ফুটিং হইবো! নিজেই নিজের কথার উত্তর দেয়।
এবার আর কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে যেই আর একটু সামনে এগোতে যায় সঙ্গে সঙ্গে ইয়া মোটা একটা কালো বন্দুক তুলে ধমক দেয় একজন পুলিশ। সুতরাং পিছিয়ে আসতে হয় ওকে।
মাইকে জোরে জোরে বলা কথাগুলো থেকে শুধু এতটুকুই বুঝতে পারে আসলে চানাচুর খাওয়া শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তিনি কিছু বলে চলে গেলে পরে সবাইকে ঢুকতে দেবে।
একসময় সবগুলো গাড়ি যে দিক দিয়ে আসছিল তার উল্টোদিক দিয়ে চলে যায়। সবাই হই হই করে চানাচুর খাওয়ার জন্য ছোটে।
কিন্তু একি! আবার লাইন করে ঢুকতে হয়। যে চানাচুর ওদের মোড়েই পাওয়া যেত তার জন্য কত ঢং’রে বাবা!
অগত্যা একটু ঘুর ঘুর করে দেয়ালের ভাঙ্গা জায়গাটার কাছে যায়। কিন্তু একি। আরো অনেকখানি দেয়াল ভেঙ্গে গেট বানানো হয়েছে। অনেক বড়। তবুও কেউ এদিক দিয়ে ঢুকছে না। মনে হয় কেউ খেয়াল করেনি। কী বোকারে বাবা। ভাবতে ভাবতে যেই ঢোকার জন্য পা বাড়ায় অমনি দু’জন পুলিশ খেঁকিয়ে ওঠে।
এ্যাই ব্যাটা, ভাগ। ভাগ্লি।
অগত্যা লাইনের আশপাশ দিয়ে দু’একবার ঘুর ঘুর করে একটু ঢোকার চেষ্ট করতে থাকে আর মনে মনে বলতে থাকে আল্লা একটু মালিকের সাথে দ্যাখা কেন হয় না। তাইলেই তো হগল ঝামেলা মিইট্যা যায়।
কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোও যখন ওকে দূর-দূর করে তাড়াতে লাগে তখন সহ্যের সীমা ছেড়ে যায়। আর একটু হলেই তো মেরে দিয়েছিল একজনকে। শেষে বার কতক লাইন থেকে ধাক্কা খেয়ে এক শাড়ী পড়া মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মহিলাকে এমনি মায়ের মত মনে হয়েছিল। আরও ধাক্কা দিয়ে বের করে না দেয়াতে বিশ্বাস যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ভাবখানা এমন যে এবার কেউ লাইন থেকে বের করে দিতে আসুক তবে দেখিয়ে দেবে। মা গোত্রীয় যে তার পিছেই আছে।
দেখতে দেখতে লাইনটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। আর বিস্ময়ে ওর মুখটা একেবারে হা হয়ে যায়। ওমা একচানাচুর খাওয়ার জন্য এত আয়োজন। লাইনে দাঁড়ানোর পরেও আবার লাল পুত্ পুত্ করা দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়?
ভেতরে আর ঢোকা হয় না ওর। এবার হতে ইয়া বড় একটা টেলিফোন ধরে থাকা একজন পুলিশ স্বয়ং ওকে ধাক্কা দিয়ে লাইন থেকে বের করে দেয়। আরও বার দুয়েক এভাবেই চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দেয় সেদিনের মত। পিছনে ফিরে লাইনের মাথাটা দেখার দেখার চেষ্টা করে শেষ অবধি নাগাল না পেয়ে একেবারেই হাল ছেড়ে দেয়। রাস্তা থেকে একটি কাগজের টুকরো কুঁড়িয়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে ময়দানের দিকে হাঁটতে থাকে।
সে রাতে ময়দানের ঠান্ডা মাটির উপর শুয়ে শুয়ে চানাচুরের দোকানের মাথাগুলোর লাল নীল আলো দেখতে দেখতে ডুবে যায় লাল নীল স্বপ্নীল ঘুমের রাজ্যে। ওরা সব দোস্তরা চানাচুর খেতে যাচ্ছে। সবার জন্য একটা করে গাড়ী! দোকানীরা সব হুজুর হুজুর করছে! বিনে পয়সায় সব চানাচুর দিতে চাচ্ছে! দোস্তরা সবাই হই হই করে চানাচুর খাচ্ছে! এত চানাচুর কী খেয়ে শেষ করা যায়!
সুমিষ্ট চানাচুর যখন স্বপ্নীল খাদ্য হয়ে অভুক্তরে ছলনার তৃপ্তি দিয়ে যায়, ঠিক তখনই ময়দানের বুড়ো ইঁদুরটিও পড়ে থাকা কাঠ শুকনো এ হাঁড়-চামড়া পাশ কাটিয়ে ছোটে নতুন চর্বনে।
দোস্তেও কাছে শুনেছে এ চানাচুর খাওয়া নাকি সারা মাস ধরেই চলবে। তাই রোজ এপার রাস্তা থেকে নজর রাখে মালিক হয়তো অন্য গেট দিয়ে চানাচুর বেঁচতে ঢোকে। এ আশ্বাস নিয়েই রোজ ফিরে আসে।
অবশেষে একদিন সুযোগ মেলে। একদল হলুদ গেঞ্জি পড়া ছেলেমেয়ে সারি বেঁধে চানাচুর খেতে ঢুকছে। সুযোগ বুঝে এক দৌড়ে ওর হলুদ গেঞ্জিটার জোরেই লাইনে ঢুকে পড়ে। কী তাজ্জব ব্যাপার’রে বাবা। হলুদ গেঞ্জির এত্তো জোর! আজ পুলিশ পর্যন্ত কিছু বলে না। সিদ্ধান্ত নেয় সামনের একমাস হলুদ গেঞ্জিটাই পরে থাকবে। ভিতরে ঢুকে সব আজব মনে হয়। একী! কোথায় চানাচুর! আর মালিকের দোকানটাই বা কোথায়। ওর চোখের সামনেই বানানো মালিকের দোকানটা যেন মায়ের বলার কোন রূপকথার জিন এসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। যেদিকে তাকায় সব একই রকম মনে হয়। সব দোকানে শুধু বই আর বই। আস্ত মোটা আর রং-বেরং এর বই এতগুলো একসাথে এর আগে কখনই দেখেনি।
দোকানটা সেদিন খুঁজে না পেয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে দুই একটা বইয়ের উপরের ছবির দিকে তাকায়। কত রকম কত রং-এর ছবি। জিনের বাদশার ছবিও দেখা যায়। কিন্তু ভুলেও হাত দেয়ার সাহস করে না। তবে বইয়ের খুব কাছে গেলে একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। বুঝতে পারে না কিসের গন্ধ এটা। গন্ধটাকে খুব মিষ্টি লাগে ওর। চাটতেও ইচ্ছা করে। নোনা গন্ধে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। মালিকের খাবারের প্যাকেটের কথা মনে পড়ে যায়। খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হাত দিয়ে দেখা হয়না একটি বইও। দোকানদাররা যেন কী রকম করে তাকায়। প্রথম দিনের পুলিশ গুলোর মত। অথচ অন্য সবাই চাইলেই হাত দিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে পারে যে কোন বই। অনেকে আবার দাম করে, কেউ আবার কেনেও। তবে শুধু দেখে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি বলে মনে হয় ওর কাছে! নিজেকে বলে এই দেখা শ্রেনীর লোকগুলোও বুঝি ওর মতই টাকাহীন।
মাঝে মাঝে চকচকে ভূতের মলাটের খুব চিকন কোন একটা বইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত নেয় একদিন সে এমন একটা বইয়ের মালিক হবেই হবে। এর জন্য যদি সারাদিন রাতও বোতল কুঁড়াতে হয় তবে তাই সই।
বুঝে গিয়েছে এটা বইয়ের মেলা। আর হলুদ গেঞ্জিটার বইয়ের ছবি দেখা আর উদ্দেশ্যহীনভাবে আজব আজব সব মানুষের আজব কান্ডকারখানা দেখাই এখন ওর নিত্য সন্ধ্যার কাজ।
প্রতিদিনের মত আজও উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছিল। কিন্তু গতকালের দেখা সেই জিনের বাদশার ছবির চিকন বইটাতে আবারও চোখ আটকে যায়। খুব নেড়ে দেখতে ইচ্ছে জাগে। আজও সাহস হয় না। যে জায়গায় গতকাল বইটা ছিল ঠিক সেখানটাতেই আজও আছে। হঠাৎ নিজের মাঝে খেলে যাওয়া বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনাটাতে নিজেকে সাবাশ না দিয়ে পারে না। আচ্ছা বইটা যখন একই জায়গায় আছে, রাত্রেও নিশ্চয় এ জায়গাতেই থাকে। রাতে একবারও কী মালিক ঘুমিয়ে পড়বে না! আজ রাতে বইটা নেড়ে দেখার এ উত্তম সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না।
একছুটে মেলার বাইরে এসে দুটো শক্ত বিস্কুট কিনে আবার মেলায় ঢুকে পড়ে।
মাইকে যখন মেলা বন্ধ হওয়ার ঘোষনা দেয়া হচ্ছিল বাংলা একাডেমীর মূল ভবনের পাশের স্টলটির পিছনে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা অবয়বটি শক্ত বিস্কুট দুটি পকেটে নিয়েই হারিয়ে যায় অতল ঘুমের রাজ্যে।
পেটে কুমিরের কামড়ে যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় বুঝতে বাকি থাকে না অনেক দেরী হয়ে গেছে। গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বিস্কুট দুটি খেতে খেতে নিজের বোকামীর জন্য ধিক্কার দিতে থাকে নিজেকে।
আজ ছুটির দিন। অনেক লোকের সমাগম হয়েছে মেলায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ভিড় বাড়ছেই। ওর পরিচিত দোকানটার পাশে ছোট বড় কত মানুষের ভিড়। বেশির ভাগই ওর কাছাকাছি বয়সের। কত লোক বই নিয়ে ভিড় থেকে সরে এসে বই দেখছে। ঐ তো ওর বইটা সেই জাযগাটাতেই আছে।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নাহ্ কেউ খেয়াল করছে না। একটু দূরে লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা একজনকে ঘিরে কত মানুষের ভিড়। সবার হাতেই একটা করে বই। বাকি সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অগত্যা একটু সাহস করে ভিড় ঠেলে নিজের পছন্দের বইটার কাছে যেতেই মাথার উপর দিয়ে কে যেন বইটা নিয়ে নেয়। মনটা খারাপ হয়ে যায়্ হঠাৎই খেয়াল করে বইটার উপরের জিন যেন ওর মনের খবর জানতে পেরেছে। ঠিক একই মত আর একটা বই এখন সেখানে। দু’একবার ইতস্তত করে কয়েকবার মালিকের দিকে তাকিয়ে বইটা হাতে তুলে নেয়। মালিক যেন খেয়ালই করে না। হয়তো ভিড়ের জন্য বুঝতেই পারেনি এমনভাবে। তারপরও বইটা একবারের বেশি খুলে দেখার সাহস হয় না। পিছে আবার চোর ভেবে বসে।
কী রকম রং-বেরং এর ডাইনীর ছবি বইটার মাঝে। একেবারে তার মায়ের বলা গল্পের মতই। খুশি মনে নাচতে নাচতে ফেরে সেরাতে।
পরদিন ভিড় একটু কম। তবুও সাহস করে বইটা হাতে নেয়। একবারে তাজ্জব লাগে, আরে মালিক তো দেখি কিছুই বলে না। আজ আগের দিনের পৃষ্ঠা সহ আরও নতুন দুইটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখে। যদিও কেউ কিছু বলেনি তবুও বেশি দেখার সাহস করে না। তবে বইটা যে ওর হবে না তা বেশ বুঝতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নেয় যে কয়দিন মেলা আছে রোজ দুইটা করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখবে।
পরদিন তর সয় না। কিন্তু গেট বন্ধ। মানুষ জনও আসছে না। সন্দেহ হতে থকে মেলা বন্ধ কী না। কিন্তু দুপুরের পর মানুষের ঢল দেখে অজানা আশংকা দূর হয়ে যায়। আজ আর আগের দিনের দেখা পৃষ্টাগুলোতে বেশি সময় নষ্ট না করে পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেখতে থাকে।
এভাবে কয়েকদিন চলার পর একদিন শেষ পৃষ্ঠার দেখা মেলে। সাহস করে বইটার দামও জেনে নেয়।
চল্লিশ টাকা।
এত টাকা ওর এক বছরেও জমানো সম্ভব নয় বুঝতে বাকি থাকে না। তবুও মনের মাঝে তীব্র ইচ্ছা আন্দোলিত হতে থাকে বইটা পাবার জন্য। এদিকে মাইকে বলছে মেলা নাকি আর আট দিন আছে।
বুকের মাঝের তীব্রতা নিয়ে যখন ফিরছিল ঠিক সে সময়ই প্রতিদিন ওর উপর নজর রাথা দোকান মালিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কাল যখন ছেলেটি আসবে বইটার সাথে আরও একটি বই ওকে উপহার দেবে।
মালিকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণেও পরবর্তী কয়েকদিন ছেলেটির দেখা পায় না।
ওদিকে দিন রাত না খেয়ে টাকা জমিয়ে নীবিড় ডাস্টবিন রাস্তা সব চষে বোতল-কাগজ টোকাতে থাকে। আর মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকাতে দুলতে থাকে।
কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট্ট শরীরটা তার সমস্ত কায়িক শক্তি নিঃশেষ করে ফেলে। অবশেষে মেলা একদিন বাকি থাকতে ওর বত্রিশ টাকা জমানো হয়।
এদিকে মেলার শেষ দিনের সকাল হয়েছে। আরও সাতটাকা চাই। সেদিন যেন হঠাৎ করে সূর্যটা সকাল থেকেই তীব্রতা ধারণ করে। শুধু পানি মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়ে শেষ কটা টাকার নেশায়।
সারাদিন চষে বেড়ায় অনেক এলাকা। অনেক দূর পর্যন্ত যায়। সূর্যটা ততোক্ষণে পশ্চিম দিকে অনেকটাই হেলে পড়েছে। এক সময় ফেরার চিন্তা মাথায় আসে। ভাবে এতেও যদি না হয় দোকান মালিককে বলে না হয় কয়টা টাকা কম দেয়ার চেষ্টা করে দেখবে।
কয়েকদিনের অযন্তে অনাহারী ছোট দেহটা বিশাল বস্তাটা নিয়ে গন্তব্যে ফিরতে চেষ্টা করে। পথ যেন আর শেষই হয় না। দেখতে দেখতে হাইকোর্টের মোড় চলে আসে। কিন্তু অভুক্ত দেহটা বস্তাটার ভার বহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসে। বার কয়েক চেষ্টার পরও সকল অঙ্গ প্রতঙ্গের সম্মিলিত বিদ্রোহের তোড়ে ফুটপাতেই বসে পড়ে বোঝাটিতে হেলান দিয়ে।
এদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসে। বোতলগুলো বেঁচতে হবে। শরীরটাকে উঠিয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। তীব্র ক্ষুধা আর পানি পিপাসায় সন্ধ্যাটাকে যেন দ্রুতই ধেঁয়ে আনতে থাকে। চোখের সামনে দিয়ে ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষের ঢল এক সময় ঝাঁপসা মনে হয়। হঠাৎই দুটো কাক উড়ে এসে বসে। একটি পায়ের কাছে। অপরটি বোঝার উপর ঠিক মাথার কাছে। ধীরে ধীরে উৎসুক মানুষের গলার আওয়াজ মিইয়ে আসে। যেন “ঢাহা মিথ্যা শহরের” সবগুলো নিস্তব্ধতা ওকে একাই পেয়ে বসেছে।
মহা হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে পরিশিষ্ট হয়ে যায় বইমেলা। আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হাইকোর্টের সামনের ফুটপাতে বাড়তে থাকে কাকদের বাকবিতন্ডা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১২:০০