আবরার ঘরে ঢুকেই স্কুলের ব্যাগটা কাধ থেকে ধপাশ করে খাটের উপর ফেলে দেয়। রাগে মাকে শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলতে থাকে-
''আর লেখাাপড়াই করবো না। এটা একটা ফালতু কাজ যা মানুষ জীবনের অর্ধেকটা সময় করে থাকে বোকার মত। যে কাজ মানুষকে আর্থিক স্বচ্ছলতা দিতে পারে না; একটা সুখী জীবন বা কোন লক্ষ্য অর্জনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না তার পিছনে এত শ্রম দেয়ার কোন মানে হয় না। একথাগুলোই আমি মা-বাবাকে বোঝাতে পারলাম না।"
আবরারের দু'চোখে জল। মা এসে আবরারের গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন-
"আজ আবার কি হল। লেখাপড়াকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কেউ? বড় হলে বুঝবে লেখাপড়া কি জিনিস।"
এবার আবরার চেচিয়ে বলে উঠলো-
"ঠিক আছে, স্কুলের বেতন দাওনা কেন? বেতন না দিলে কাল থেকে আমি আর স্কুলে যাবনা। স্যার প্রতিদিন দাঁড় করিয়ে লজ্জা দেন। এবার সাফ বলে দিয়েছেন- বেতন বাকি থাকলে পরীক্ষা নিবেন না। বাবা বাসায় আসুক এসব আমার ভাললাগেনা।"
"আচ্ছা, তোর বাবা অফিস থেকে আসুক। যেভাবেই হোক স্কুলের বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা করতে বলবো।"
মনটা খারাপ করে বসে পড়লো আবরার।
আবরার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সবসময় লেখাপড়ার পিছনে নাছড়বান্দার মত লেগে থাকা আর বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে স্কুলে নিয়মিত ভাল ফলাফল করে সে। মাঝে মাঝে বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হয়। প্রতি বছরই বাবা বলে থাকেন- এবার ভাল রেজাল্ট করলে একটা কম্পিউটার কিনে দেব, কখনও বলেন সাইকেল কিনে দেব আবার কখনও মোবাইল কিনে দেব। আবরার অনেকবার বলেছে একটা টিয়া পাখি কিনে দিতে। পরবর্তীতে এসবকিছুই বাবা বেমালুম ভুলে যান। কোনো কিছুর মানে খুঁজে পায়না আবরার।
প্রতিদিনের মত সন্ধ্যায় আবরারের বাবা অফিস থেকে এসে বাসায় পা রাখলেন। ব্যক্তি মালিকানার একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরী। বেতনের প্রায় সব অর্থই বাসস্থান আর খাদ্যের পিছনে ব্যায় হয়। জীবনের বাকি অংশগুলোতে কেবলই অন্ধকারের ছায়া। বাসা ভাড়া কমানোর জন্য অফিস থেকে অনেক দূরে কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা বেছে নিয়েছেন। বাসভাড়া বাচাঁনোর জন্য প্রায়ই তাকে পায়ে হেঁটে অফিসে যেতে দেখা যায়; কাধে একটা ভাতের ব্যাগ- প্রতিদিনের হাজারো সাধারণ ঘটনার মত। একটাই সন্তান আবরার। ছেলের খুশির জন্য মাঝে মাঝে ঝালমুড়ি, পুরি ইত্যাদির মত সস্তা খাবার নিয়ে বাসায় ফিরেন তিনি। অতিরিক্ত অর্থ ব্যায়ে আলাদা শিক্ষকের কাছে আবরারকে পড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রতিদিন আবরারকে তিনি নিজেই পড়াতে বসেন। নিজে বুঝে আবরারকে বুঝান। অনেক জটিল অধ্যায় তার কাছে বোধগম্য না হলে আবরারকে তার বন্ধুদের কাছে বা শিক্ষকদের কাছ থেকে বুঝে নিতে বলেন। সে যাই হোক ঘরে ঢুকে জামার বুতাম খুলতে খুলতে তিনি লক্ষ্য করলেন- আজ পরিবেশটা থমথমে। প্রতিদিনের মত আজ আবরার পড়ার টেবিলে নেই। মা এসে আস্ত করে বললেন-
"তোমার ছেলে এবার ভীষণ রাগ করেছে। স্কুলের পুরো বছরের বেতন বাকি। বেতন না দিলে সে আর লেখাপড়া করবে না।"
"আচ্ছা আমি দেখছি।" বাবা আবরারের পাশে গিয়ে বসলেন। খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আবরারের শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন-
"স্কুলে বেতন বাকি - তো দিয়ে দেব। শুধু এ কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়া উচিত বলো?"
আবরার বলল-
"ক্লাশের সবাই বেতন দিয়ে দিয়েছে। শুধু আমারটাই বাকি।"
"আচ্ছা ঠিক আছে কাল আমি তোমার সাথে স্কুলে যাব। তোমার কাছে কেউ যেন টাকা না চান সে ব্যবস্থা করে আসবো, ঠিক আছে? এবার ওঠ। বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ। আজকে অল্প করে পড়, বেশি পড়তে হবে না।"
অতঃপর আবরার বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে।
পরের দিন সকালে আবরারের সাথে বাবা স্কুলে গেলেন। আবরার তার বাবাকে শ্রেণী শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন। শ্রেণী শিক্ষক সবকিছু শুনে তাদেরকে নিয়ে গেলেন প্রধান শিক্ষকের নিকট। সবকিছু শুনে প্রধান শিক্ষক কেমন যেন রুক্ষ ভাষায় বললেন-
"দেখেন আপনার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই ছেলের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছি। তারপরও সারা বছরের বেতন বাকি। বিনা পয়সায়তো কাউকে পড়ানো সম্ভব না।"
"আবরারের বাবা বিনয়ের সাথে বললেন-
"দু্ঃখিত স্যার। বিনে পয়সায় কেন পড়াবেন। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন আমি সব টাকা এক সাথে পরিশোধ করে দিব।"
প্রধান শিক্ষক এবার ভ্রু কুচকে বললেন-
"এটা কি বলেন। আসলে স্কুলের বেতন দিতে বিলম্ব করাটা আপনার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। আমার মনে আছে এর আগেও বহুবার আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেন নি।"
"এই শেষ বারের মত আমাকে একটু সময় দিন পরবর্তীতে আর এরকম হবে না।" বললেন বাবা।
প্রধান শিক্ষক সাফ জানিয়ে দিলেন-
"আর সময় দেয়া যাবে না। আপনি পরীক্ষার আগে সব টাকা পরিশোধ করবেন। আর কোনো কথা শুনতে চাই না।"
আবরারের বাবার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে সালাম জানিয়ে আবরারকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন বাবা। বাইরে এসে আবরারের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন-
"বাবা তুমি ক্লাশে যাও। চিন্তা করো না। তোমার পরীক্ষার আগেই টাকার ব্যাবস্থা হবে ইনশাল্লাহ্।
আবরার মুখে কিছু না বলে মাথা বাঁকালো। এই প্রথম বাবার অসহায় মুখটাকে ভেতর থেকে অনুভব করলো আবরার। বাবাকে বলা শিক্ষকদের রুক্ষ কথাগুলো যেন আবরারকে নিরব করে দিয়েছে। অতঃপর বাবা পকেট থেকে রুমাল বেড় করে মুখমন্ডল মূছতে মূছতে চলে গেলেন। আবরার পাথর দৃষ্টিতে বাবার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ তাকে দেখা যাচ্ছিল।
আবরার কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। বাসায় ফিরে বাবার ডায়রিটা বের করে; প্রতিদিন অন্ততঃ একবার বাবা যেটা খুলে দেখেন বা লেখালেখি করেন। ডায়ারিতে অনেক দেনা-পাওনার হিসেব, খরচের হিসেব। বাবার ঋণের হিসেব দেখে আবরারের মন আরো খারাপ হয়ে যায়। এখন সে বুঝতে পারে তার বাবা বড় অসহায়। শান্ত হয়ে যায়া আবরার। ডায়রিটা রেখে পড়ার টেবিলে বসে বই নিয়ে।
প্রতিদিনের মত সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবরারের পড়ার রুমে ঢুকলেন বাবা। আবরার তার বাবাকে দেখে আপদমস্তক, তার অসহায় চোখে তাকায়। আবরারের মন খারাপ দেখে বাবা বললেন-
"কি হয়েছে বাবা। এভাবে কি দেখছ?"
আবরার হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল-
"বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।"
বাবা আবরারকে বুকের মাঝে আগলে রাখেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন-
"কি হয়েছে বাবা। তুমি আজকে এরকম করছো কেনো?"
"বাবা তুমি না এতদিন বলতে কম্পিউটার কিনে দিবে, সাইকেল কিনে দিবে, একটা সুন্দর টিয়া পাখি কিনবে। ওগুলো আমার কিচ্ছু লাগবে না। এখন থেকে আমি এমনিতেই দিন-রাত লেখাপড়া করবো।"
এবার বাবা মুসকি হেসে বললেন-
"পাগল ছেলে। তুমি না টিয়া পাখি পছন্দ করো, সেটাতো দিবোই। ঠিক আছে এবার পড়তে বসো।"
আবরারের বাবা এখন ছেলের স্কুলের বেতন যোগাড় করার চিন্তায় নিমগ্ন। যত দিন যায় ততই তার চিন্তা আর হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে। হঠাৎ একদিন তার অফিসে খবর আসে- আবরার তার স্কুলের সামনে এক্সিডেন্ট করেছে, এখন হাসপাতালে আছে। মুহূর্তেই দিসেহারা হয়ে হাসপাতালে গিয়ে আবরারকে মৃত দেখতে পেলেন। নিমিষেই পাথর হয়ে যান আবরারের বাবা আর জীবনের সমস্ত সপ্নরা যেন পাথরের নুড়ি।
আবরারের বাবা এখন ব্যস্ততার ভীড়ে ক্লান্ত। জীবনের হিসেবটা এখন তার কাছে বড়ই জটিল। আকাশে বাতাসে কেবলই আবরারের শরীরের গন্ধ টের পান। একাকী চোখ বন্ধ করে আবরারের সাথে বিড় বিড় করে কথা বলেন। আবরারের টিয়ে পাখি পোষার বড় সখ ছিলো। তাই একদিন খাঁচায় বন্দি একটা সুন্দর টিয়াপাখি কিনে নিয়ে আসেন বাসায়। আবরারের পড়ার রুমে সযত্নে টানিয়ে রেখেছেন সেটা। এখন আবরারের বাবাকে প্রতিদিন দেখা যায় টিয়ে পাখিটাকে আদর করতে কথা বলতে। এখন অফিস থেকে ফিরে বাবা আবরারের বই নিয়ে পড়তে বসেন। প্রতিটি বইয়ের সমাপ্ত হওয়া পড়ার পরবর্তী প্বষ্ঠা কিংবা অধ্যায়ের প্রতিটি শব্দের সাথে বিলিন হয়ে যান একজন আবরারের বাবা আর তার দীর্ঘশ্বাসেরা।
===০০০===