somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাস্তবতার অনুভূতি

১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি যখন খুবই হতাশাছন্ন, বিষাদগ্রস্থ অবস্থায় থাকি নিজেকে প্রশ্ন করি আমার ভাগ্য টা কেন এমন হল? সব দুঃখ মনে হয় আমারই জন্য :( ঈশ্বর আমাকে ছাড়া সবাইকে পৃথিবীতে সুখি রেখেছে। এসব আজগুবি প্রলাপ নিজের মনে মাঝে প্রায়শ দোলা দেয়। তবে মন যতই দোদুল্যমান হোক না কেন এক সময় না এক সময় কোন কোন পরিস্থিতির বাস্তবতা আমার চোখে ধরা দেয়।

এজন্য রাস্তায় বা যেকোন স্থানে থাকলে মানুষকে যতটা পারি বুঝতে পারার ব্যর্থ চেষ্টা করি। পরিস্থিতি বোঝার অপপ্রয়াস করি। কেন, কি জন্য, কি কারণে ইত্যাদি নিয়ে বাস্তবতায় থেকে ও অবাস্তবতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে ফেলি নিজেকে, গুলিয়ে ফেলি বাস্তবতা আর অবাস্তবতার সংমিশ্রণ। কিন্তু পরিশেষে সেই বাস্তবতা কেই নিয়েই তো আমাদের জীবন :)

গত বৃহস্পতিবার, নীলক্ষেত যাব বই কিনব বলে। তবে বনানী থেকে নিউমার্কেটের বাসের বেহাল দশা দেখে আমরা বাপ ছেলে বিআরটিসি তে করে স্টেডিয়াম মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে সেই একটা ঘুম দিয়ে দিলাম। উঠেই দেখি যে পল্টন মোড় এসে পরেছি। যাক বাস থেকে নেমে স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে একটা ক্যালকুলেটর কিনে উঠলাম নীলক্ষেত যাবে সেই টেম্পুতে।

আমাদের সাথে আরো দুটো ছেলে ও উঠেছিল। পথে অনেক যানজট থাকায় টেম্পু কোন রকমে টি&টি বিল্ডিং ক্রস করার পর আর এগুতে পারছিল না। তখন প্রথম ছেলেটির প্রশ্ন টেম্পুর একজন যাত্রীকে।

ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদ টা কোথায়? বলবেন কি? সেই ভদ্রলোক হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে মুখে মুখে রাস্তা চিনিয়ে দিলো। ছেলেটির মুখে ছিল কেমন যেন বিষণ্ণতার ছাপ দেখতে পেলাম। সম্ভবত চিনতে পারেনি। এরপর তারই পাশে অপর ছেলেটি ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করল জগন্নাথ হল কোথায়? লোক ও সেও মুখে মুখে বলে। ছেলে গুলোর থেকে প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর লোকটির প্রশ্নবান শুরু হল।

সেই ভদ্রলোকঃ তা ছোট ভাই, তোমরা এসবের ঠিকানা কেন জানতে চাইছো?
প্রথম ছেলেটিঃ আমরা দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিবো। এজন্য জায়গা গুলো চিনে রাখার চেষ্টা করছি। কারণ আমরা এখানের কিছুই চিনি না।
সেই ভদ্রলোকঃ ও ভালো কথা। তা কবে ইন্টার পাশ করলে? কোন কলেজ থেকে?

হঠাৎ ওদের মুখ টা আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কেমন যেন ওদের মুখে কালো মেঘের ছায়া পরে গেল। এক বুক ফাটা কষ্ট যে ওদের ভিতরে ছিল কেই বা জানত। কিন্তু প্রকাশ করার মত ভাষা ছিলো না, তবে সেটা ওদের চেহারার মাঝে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল।

দ্বিতীয় ছেলেটিঃ অনেকটা ইতস্তত হয়েই বলল, আমরা কোন কলেজ থেকে নই আমরা "উন্মুক্ত" থেকে পাশ করেছি। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবো এজন্য আমাদের এখানে আসা।

আমি ওদের কাছে থাকে হ্যান্ড ফাইল ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। দেখি বাংলাদেশ ওপেন ইউনি ভার্সিটি লেখা একটা ফটোকপি। আর অন্যান্য কাগজের জন্য পুরোটা দেখতে পারি নাই। এরপর লোকটি ওদের বিস্তারিত জানার আগ্রহ প্রকাশ করল। যা ছিল শুনেই অনেকটা নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।

যে দুই ছেলে টেম্পুতে উঠেছিল ওদের বাসা উন্মুক্ত ইউনিভার্সিটি থেকে খানিকটা দূরে একটা গ্রাম এলাকার ভিতরে পরেছে। ওদের অভাব অনটনের সংসার। ঠিকমত দু'বেলা খাবার জুটানো কষ্ট বিধায় ওরা কাজ করত। ওদের একজনের বাবা রিকশা চালায় আর আরেকজনের বাবা দিনমজুর। যার বাবা রিকশা চালায় ঐ ছেলেটির বাবার বয়স বেশি। তাই প্রায়শই বাসাতেই থাকে। আর দ্বিতীয় ছেলেটির বাবা যিনি দিনমজুর, উনারও কাজ থাকলে ওদের চুলায় আগুন জ্বলে নইলে অনেকটা উপোস করেই নাকি থাকতে হয়। মোট কথা দুজনেরই এই অবস্থার কারণে ওদের মধ্যে একজন একটি রেষ্টুরেন্টে এবং আরেকজন একটি গাড়ির গ্যারাজে কাজ নেয়।

তারা দুজনই বাল্য কালের বন্ধু। তবে এদের দুজনের পরিবার নাকি ওদের বেশিদূর পড়ালেখা করাতে পারে নি। এরপর নিজেরা নিজেরাই যুদ্ধ করে এইচএসসি পাশ করেছে। এদের মধ্যে প্রথম জন একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ নেয়। তার জীবনের প্রথম বেতন নাকি ছিলো ৫০০ টাকা। তবে সে কাজটি ছেড়ে দিয়ে পরে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ নেয় যাতে সে কম্পিউটার শিখতে পারে। সে বলল এখন কেউ কম্পিউটার জানা ছাড়া লোক নিতে চায় না এজন্য আমি রেষ্টুরেন্টের কাজ ছেড়ে কম্পিউটারের দোকানে কাজ নেই। কারণ কেনার তো সামর্থ্য নেই আমার।
অপরজন গাড়ির গ্যারেজে কাজ নিলেও লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকায় সেও পিছিয়ে যায় নি। সেও গাড়ির গ্যারাজে সকাল থেকে রাত অব্দি কাজ করে পড়ালেখা করত। পরের দিন আবার কাজে যেত নইলে দুইদিনের বেতন কাটা যাবে। ওদের এমনও দিন গিয়েছে যে ওরা পরীক্ষার সময় ঠিকমত খেতে পর্যন্ত পারে নি। কোন রকমে আধ পেট খেয়ে ওরা আজ একটা ভালো রেজাল্ট করেছে।

লোকটি জানতে চাইলো এখান কোথায় থাকবে তোমরা??? এই কথাটি শুনে আরো শিহরিত হয়েছিলাম। ছেলে দুটো বলল, যদি পারি ঢাবির আশে পাশে নইলে মসজিদে আজকের রাত টা কাটিয়ে সকালে পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে চলে যাবো। কারণ ঢাকাতে আমাদের কেউ পরিচিত নেই এজন্য এটাই করব ভাবছি। আর আগামীকাল কে গিয়ে কাজে যেতে হবে।

দুজন ছেলেই অবলীলায় বলে গেল তাদের কথা গুলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছিলাম। কিছু বলব কি চোখের কোণে জল এসে পরছিল বার বার ওদের কথা গুলো শুনে। সবাই ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আসলে জীবনের প্রকৃত যোদ্ধা এরাই। এরাই অদম্য কে দমন করার প্রয়াস এরাই। এদের দ্বারাই সম্ভবপর হয় ইতিহাস রচিত করা।

উনাদের কথা শুনতে শুনতে নিজেকে আবারো হারিয়ে ফেললাম বার বার হিসেব কষতে থাকলাম ওদের জীবনে এত কষ্ট কেন? কিভাবে ওরা এত প্রতিকূলতার মাঝে নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রেখেছে? এখনও ওরা অদম্য নির্ভীক হয়ে বাস্তবতার সাথে লড়াই করে যাচ্ছে???

এ সবের হিসেবে মিলাতে মিলাতে দেখি টেম্পু নীলক্ষেত মোড় এসে গেল। জ্যাম থাকায় পেট্রোল পাম্পের মোড়ে। টেম্পু থেকে ছেলে দুটো দ্রুত নেমে ভাড়া দিয়ে ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। চারিদিকে খানিক দেখলাম না পেয়ে আমি ও সে স্থান ত্যাগ করলাম।

নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে প্রবেশের সময় মনে মনে ওদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম। আর মনে মনে বলছিলাম যে, "আজকে আমাকে আপনারা একটি মহৎ শিক্ষা তথা উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন। যে জীবনে যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন নির্ভীক অদম্য হলে সব কিছুই বিজয় করা সম্ভব। যার বাস্তব উদাহরণ ছিলেন আপনারা দুজন। হয়ত বা কথা বলতে পারি নি আপনাদের সাথে তবুও দূর থেকে জানাই লাল সালাম তোমাদের হে অদম্য বীর যোদ্ধা। যেখানে থাকো, ভালো থেকো।"

ওদের থেকে এটাই শিক্ষা পেলাম যে, অদম্য ইচ্ছা আর আত্মবিশ্বাসই হল বাস্তবতার যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াইয়ের মূল চাবিকাঠি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×