৬ এপ্রিল, ১৯৭৫, সকালবেলা। রাজা পালডেন থনডুপ নামগয়াল সবে নাশতা শেষ করেছেন। তখনি শুনলেন রাজপ্রাসাদ অঙ্গনে গোলাগুলির আওয়াজ। দৌড়ে গেলেন জানালার ধারে। যা দেখলেন, তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ভারতীয় সৈন্যরা তার প্রাসাদরীদের আক্রমণ করেছে। তার চোখের সামনে মাত্র ৩০ মিনিটের নাটকীয় অপারেশনে তার এক ১৯ বছরের রীর জীবনের বিনিময়ে রাজা পালডেন সিংহাসন হারালেন। সেই সাথে অবসান হলো ৪০০ বছরের রাজতন্ত্র এবং হারিয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আর তা পরিণত হলো প্রতিবেশী ভারতের একটি প্রদেশে। জাতিসংঘে একটু গুঞ্জন হলো। বিশ্বের কেউ একটু টু শব্দও করল না। কারণ হিসেবে বলা হলো, দেশটি গণতন্ত্র পেয়েছে, যদিও তা আর একটি দেশের অঙ্গ হিসেবে। তা ছাড়া আরো যুক্তি দেখানো হলো, দেশটির জনগণই স্বাধীনতা চায়নি, চেয়েছে ভারতের সাথে মিশে যেতে।
কোনো রাষ্ট্র প্রশ্ন না তুললেও বিশ্লেষক, গবেষক ও বিদগ্ধজনরা তখন এবং এখনো অনেক প্রশ্ন তুলেছেন যার সঠিক জবাব কখনো মেলেনি। এমন বিশ্লেষকদের মধ্যে রয়েছেন এক ভারতীয় সাংবাদিক সুধীর শর্মা। ''একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা'' শিরোনামে এক চমৎকার প্রতিবেদনে সিকিমে ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা ও হঠকারিতার ইতিহাস বর্ণনা করে সিকিমের বিদায়ের কাহিনী লিখেছেন। মন্তব্য করেছেন, এমনটি যে হবে, তার চেষ্টা শুরু হয়েছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিদায়ের লগ্ন থেকেই। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু এক কথোপকথনে সাংবাদিক, কূটনীতিবিদ কুলদীপ নায়ারকে এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মিলেছিল মীরজাফররূপী কাজী লেনডুপ দরজি। ভারতের নেতৃবৃন্দ কাইভের ভূমিকায় ছিলেন। তবে এখানে স্লোগান ছিল গণতন্ত্রায়ন, সংখ্যালঘুর মতায়ন এবং রাজতন্ত্রের অবসান। তবে ফলাফল সেই একই। প্রভুর পরিবর্তন। গণতন্ত্র, মতায়ন সবই হলো, শুধু জনগণ তার স্বাদ অনুভব করতে পারল না। আসলে সব কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল নিয়ন্ত্রণ ও দখল। গদিচ্যুত হওয়ার তিন দিন পর রাজা পালডেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়েছি তখনি যখন ভারতীয় বাহিনী সিকিম আক্রমণ করল। (প্রাসাদের) ৩০০-এর কম গার্ডের ওপর এ আক্রমণ চালানো হলো। অথচ এরা ভারতীয় দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং তারা ভারতীয় অস্ত্রে সজ্জিত ও ভারতীয় অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত। সিকিমিরা ভারতীয়দের কমরেড ভাবে। এ আক্রমণ গণতান্ত্রিক ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক দিন’, তিনি বড় দুঃখে লিখলেন। রাজা পালডেন হয়তো এমন করুণ পরিণতি অন্য দিকে মোড় দেয়াতে পারতেন যদি তিনি আর একটু স্মার্ট হতেন, লিখেছেন বিএস দাশ। তার সিকিম সাগা বইতে মি. দাশ লিখেছেন, যদি রাজা আর একটু বুদ্ধির সাথে তার কার্ডটি খেলতেন তাহলে অবস্থা অন্য রকম হতো। দাশ সিকিমে ভারতীয় পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন যখন গ্যাংটকের পতন ঘটে। ভারতীয় পলিটিক্যাল অফিসার অর্থ তিনিই প্রকৃত মতাধারী ব্যক্তি ছিলেন ১৯৫০ সালের সিকিম-ভারত চুক্তি অনুযায়ী। দাশ লিখেছেন, সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ভারতের প্রতিরক্ষার খাতিরে। আমরা সে লক্ষেই কাজ করে যাচ্ছিলাম।
অথচ রাজা পালডেন বুঝতেই পারেননি ভারতীয় উদ্দেশ্য। তিনি ভাবতেন, জওয়াহেরালাল নেহরু, এমকে গান্ধীসহ সব বড় নেতা তার পরম শুভানুধ্যায়ী। পালডেনের সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন সোনম ইয়ংডা লিখেছেন, ''রাজা তার ভয়ঙ্কর স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, ভারত কখনো তার ছোট্ট রাজ্যটি দখল করে নেবে। অথচ এমনটি হবে এবং এর জন্য একটি মাস্টার প্লান প্রস্তুত, সে কথা চীন ও নেপাল সিকিমের রাজাকে জানিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে নেপালের রাজার অভিষেকের সময় রাজা পালডেন কাঠমান্ডুতে যান। সেখানে নেপাল, চীন ও পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ রাজা পালডেনকে তিনটি হিমালয়ান রাজাকে নিয়ে ভারতের মাস্টার প্লানের কথা বলেছিলেন। সুধীর শর্মা লিখেছেন, চীনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী রাজা পালডেনকে গ্যাংটকে না ফেরার পরামর্শ দেন এ জন্য যে, এ মাস্টার প্লানের প্রথম শিকার হবে সিকিম। অন্য দু’টির জন্য রয়েছে আরো জটিল পরিকল্পনা। পালডেন এ কথা বিশ্বাস করতে পারেননি।'' শর্মা লিখেছেন, রাজা পালডেন ভারতকে তার সবচেয়ে বড় সুহৃদ মনে করতেন। কেননা তার সৈন্যবাহিনী, প্রাসাদরী এবং তার শাসনযন্ত্র নির্মাণ ও পরিচালনা ভারতই করত। তিনি তাদের বললেন, আমার সৈন্যবাহিনী কেমন করে আমার বিরুদ্ধে লড়বে? তাছাড়া রাজা পালডেনকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর অনারারি মেজর জেনারেলের পদমর্যাদা দেয়া হতো। নেহরুও বলেছিলেন, এমন ছোট্ট দেশ দখল করার প্রয়োজন নেই। (১৯৬০ সালে কুলদীপকে নেহরু বলেছিলেন- ঞধশরহম ধ ংসধষষ পড়ঁহঃৎু ষরশব ঝরশরস নু ভড়ৎপব ড়িঁষফ নব ষরশব ংযড়ড়ঃরহম ধ ভষু রিঃয ধ ৎরভষব.) অথচ তার কন্যা মাত্র ১৫ বছর পর জাতীয় স্বার্থের কথা বলে সত্যি সেই মাছিকে হত্যা করলেন। তবে দখলের বীজ নেহরুই বুনেছিলেন। সিকিমের রাজতন্ত্রের পতনের লক্ষে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) গঠনে তিনিই উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। এসএনসি’র নেতা লেনদুপ দরজির গণতন্ত্রের সংগ্রামকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রথমত, নামগয়াল পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। আসলে কাজী ও নামগয়াল পরিবার ছিল একে অন্যের শত্র“। এই বিভেদকে ভারত কাজে লাগায় তার মাস্টার প্লানের অংশ হিসেবে। ক্যাপ্টেন ইয়াংজু লিখেছেন, ''ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক পোশাকে রাজার বিরুদ্ধে গ্যাংটকের রাস্তায় মিছিল, আন্দোলন ও সন্ত্রাস করত।'' এমনকি লেনদুপ দরজি নিজেই শর্মাকে বলেছেন, ''ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর লোকরা বছরে দু-তিনবার আমার সাথে দেখা করত কিভাবে আন্দালন পরিচালনা করা যাবে। তাদের একজন এজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অর্থ দিয়ে যেত এ আন্দোলন পরিচালনা জন্য।'' এ অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালিত হতো। শর্মা লিখেছেন, এই ‘সিকিম মিশনের’ প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতের ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (সংক্ষেপে ' র')। এর ডাইরেক্টর অশোক রায়না। তার বই ইনসাইডর : দি স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস। এখানে বাংলাদেশ অধ্যায়সহ সিকিমের বিষয় বিস্তারিত আছে। বায়না লিখেছেন, ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করে নেয়া হবে। সে লক্ষে সিকিমে প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির জন্য আন্দোলন, হত্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি ইত্যাদি করা হচ্ছিল। এখানে হিন্দু নেপালি ইস্যুকে বড় করে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টায় সফলতা আসে। গ্যাংটক পোস্টের সম্পাদক সিডি রাই বলেছেন, সিকিমের নেপালি বংশোদ্ভূত নেপালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এটা দৃঢ়ভাবে ছড়ানো গেল যে, সিকিমের বৌদ্ধ রাজা তাদের নির্যাতন, নিষ্পেষণ করছেন এবং সুশীল ও এলিটরা এক হয়ে ভাবতে শুরু করল, ''আমাদের ভারতীয় হয়ে যাওয়াই ভালো বৌদ্ধ রাজার নির্যাতনের চেয়ে।''
ক্যাপ্টেন সোনম ইয়ংডা দাবি করেছেন, সিকিমে রাজার বিরুদ্ধে লেনদুপের আন্দোলন ছোট ছিল এবং তা হয়েছে স্পূর্ণভাবে ভারতের অর্থানুকূল্যে। তার মতে, ভারত ডাবল গেম খেলছিল। এক দিকে রাজাকে আশ্বস্ত করছিল তার সিংহাসন নিরাপদ এবং তিনি সঠিক পথে আছেন। অপর দিকে লেনদুপকে অর্থ ও লোকবল নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলে, যাতে দেশের অধিকাংশ লোককে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে এক সারিতে আনা যায় এর ফলে ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে লেনদুপের এস.এন.সি পার্টি ৩২ সিটের ৩১টিই লাভ করেছিল। এর আগে দিল্লির চাপে রাজা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় একটি সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন। ৮ মে, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এ মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব চেওয়াল সিংহ এবং ভারত-সমর্থিত তিনটি পার্টি সিকিম ন্যাশনাল পার্টি, সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেস। রাজা এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এর আগের মাসে এক-নাগাড়ে দশ দিন আন্দোলন চললে গণতন্ত্রের সপক্ষে। মজার কথা, এই হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্যাংটকের পালজোর স্টেডিয়ামে আটকে রেখে ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ স্লোগান উঠাতে বাধ্য করা হয়। এ আন্দোলনের শেষ দিন ভারত বিএস দাশকে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে নিযুক্তি দিলে সিকিমের তিন পার্টি আন্দোলন উঠিয়ে নেয়। এর কয়েক দিন আগে রাজার কাছে খবর এসেছিল, এ তিন পার্টির জয়েন্ট অ্যাকশন (জেএসি) কমিটি ১৫ হাজার মানুষের এক কর্মী বাহিনী নিয়ে সংখোলা থেকে গ্যাংটকের দিকে এগোচ্ছে। ভীত রাজা ভারতের সাহায্য চাইলেন। এ দিকে জেএসিও ইন্দিরা গান্ধীর কাছে টেলিগ্রাম পাঠাল তাদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিয়ে এবং এর সাথে সিকিমে হস্তক্ষেপের আবেদন জানাল। এর পর ভারতের জন্য সিকিমে হস্তপে করার বিরুদ্ধে কোনো বাধাই রইল না।
অর্থাৎ ভারতের তিন দশকের পরিকল্পনা, অর্থ ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড সার্থক হলো, লিখেছেন সিকিম ও ভারত বইয়ের লেখক।
নির্বাচনে জিতে ২৭ মার্চ, ১৯৭৫ প্রথম কেবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী লেনদুপ দরজি রাজতন্ত্র বিলোপের সিদ্ধান্ত এবং এক রেফারেন্ডামের সিদ্ধান্তও নিলেন। চার দিন পর সারাদেশের ৫৭টি স্থান থেকে ফলাফল এলো, জনগণ রাজতন্ত্র বিলোপের পক্ষে। কৃষিমন্ত্রী কেসি প্রধান অবশ্য বলেছেন, পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বন্দুকের মুখে ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে বাধ্য করেছিল। অনেক লেখক বলেছেন, রাজা পালডেন তার রাজত্বের প্রথম দিকে যখন নেহরুর নির্দেশে রাজতন্ত্র বিলোপের লক্ষ্যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা দিল্লির সহায়তায় উৎরে গেলেন, তখন দিল্লিকে পরম সুহৃদ ভাবতে থাকলেন। তাই চীন বলল, ‘যদি ভারতীয় বাহিনী তাকে আক্রমণ করে, তাদের সাহায্য চাইলে ভারত সীমান্তে চীন ও পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধ করা যাবে’। সুধির শর্মা লিখেছেন। রাজা পালডেন যখন বুঝতে পারলেন, তখন আর কিছুই করার ছিল না।
অবশ্য অনেকেই সিকিমের এই বিপর্যয়ের জন্য রানী এবং লেনদুপের স্ত্রীকে খানিকাংশ দায়ী করে থাকে। তবে বিশ্লেষকরা এ মতকে আমলে নেননি। হিমালয়ের পাদদেশের তিনটি রাজ্যের ‘প্রটেকটরেট’ অবস্থানকে সে দেশের মতাবানরা মেনে নিয়েছিল। তবে ভারতের ক্রমবর্ধমান চাপ তিনটি দেশকে ক্রমেই একে অন্যের কাছে নিয়ে আসতে থাকলে ইন্দিরা গান্ধী প্রমাদ গোনেন। তাই পরিকল্পনাকে একটু পরিবর্তন করেন। কাঠমান্ডু পোস্টে ৩ জুন, ১৯৯৭ ‘ভুটানিজ সিনড্রোম’ নামে এক নিবন্ধে প্রচলিত ধারণা যে, সিকিমে নেপালি ভাষাভাষীরা সব ঘটনার জন্য দায়ী, তা সত্য নয় বলতে গিয়ে দাবি করা হয়, তিনটি দেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এবং তাদের অর্থ ও তাদের কিছু বশংবদ দায়ী। কাজী লেনদুপ দরজির নেতৃত্বে এ বশংবদরা পরবর্তীকালে ঘটনা বিপরীতমুখী করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। লেনদুপ দরজি ও তার বিদেশী স্ত্রীকে কালিমপং-এ অবশিষ্ট জীবনের তিন দশক দেশবাসীর নিন্দা ও ঘৃণা এবং ভারতের অবহেলার বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। কাজী লেনদুপ এক সাক্ষাৎকারে সুধীর শর্মাকে বলেন, আমি ভারতের জন্য এত করলাম, এমনকি দেশটিও দিয়ে দিলাম, তার প্রতিদানে তারা আমায় এত অবহেলা করল। অবশ্য সিকিম দিয়ে দেয়ার ২৭ বছর পর ভারত সরকার লেনদুপ দরজিকে ''পদ্মভূষণ'' পদবি দেয় এক অনাড়ম্বর পরিবেশে সান্ত্বনা হিসেবে।
অনেকেই বলেছেন, সিকিমের ব্যাপারে ভারত ১৯৭১ সালের লক্ষ্য পরিবর্তনের কারণ বিশ্বপরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশের চলমান ঘটনাবলি। তাই তাকে সিকিমে আন্দোলনের ধারাকে বেগবান রাখতে হয়েছে শুধু। সুধীর শর্মার মতে, বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ১৯৭৪ সালে ভারতে পারমাণবিক অস্ত্রের সাফল্যের কারণে দিল্লিকে আর তার ইমেজের ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়নি। সে সিকিম দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। বিশেষ করে ভুটানের জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তি এ সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করতে সাহার্য করে। ভারত ভুটানের জাতিসংঘের সদস্য প্রাপ্তিকে সহজভাবে না নিয়ে উপায় ছিল না। স্বাধীন বিশ্বে, বিশেষ করে নিরপেক্ষ বলয়ের নেতৃত্বে, এমনকি তার গণতান্ত্রিকতার দাবিতে চিড় ধরত। বাংলাদেশকেও তাকে সাহায্য করতে হয় স্বাধীনতাকামী হিসেবে। তার একটিই ভয় ছিল, বাংলাদেশ ও ভুটানকে অনুসরণ করে যদি সিকিম জাতিসংঘের সদস্যপদ দাবি করে।
এ দিকে নেপালেও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে ঠিক একই পদ্ধতিতে, যদিও দেশটি টেকনিক্যালি এখনো স্বাধীন। তবে এখানে সাত পার্টির জোট ও মাওবাদীরা সর্বতোভাবে দিল্লির ওপর নির্ভরশীল। ইংরেজি আদ্যক্ষর হিসেবে অনেকে এর নাম দিয়ে ‘স্প্যাম’ (সেভেন পার্টি অ্যালায়েন্স অ্যান্ড মাওইস্ট)। গত নির্বাচনের আগে গিরিজা প্রসাদ কৈরালার নেপাল কংগ্রেস ও সিপিএম-ইউএমএল দিল্লিতে গিয়ে তাদের কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করলে বিশ্লেষকরা বলেন, এটা আর একটি সিকিম সিনড্রোম, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মপদ্ধতির সিদ্ধান্ত নিতে স্বদেশভূমিকে ব্যবহার করে না। এঁরা বলেন, এই ‘স্প্যাম’ পলিটিক্যাল অলিগার্কি বা রাজনৈতিক অভিজাততন্ত্র পছন্দ করে, জনগণের গণতন্ত্র নয়। ঠিক একই লক্ষ্য দিল্লিরও। তারা জনগণ নয়, রাজনৈতিক দলের আনুগত্য কামনা করে। তারা প্রতিটি রাজনৈতিক দলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইন অব ইনহেরিটেন্স রাখে। একটির পতন হলে অপরটি সে স্থান পূরণ করে।
একজন ভুটানি বিশ্লেষক কাঠমন্ডু পোস্টে সম্প্রতি এক নিবন্ধে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, বর্তমানের ভুটানি-নেপালের রাজনৈতিক গোলযোগ যদি ঠাণ্ডা মাথায় সমাধানের চেষ্টা না করে, তাহলে এটি ‘ভুটানিজ সিনড্রোম’ হবে এবং এর পরিণতি হবে সিকিমের মতো। লেখক আরো বলেছেন, গত ছয় দশকের নানা কর্মপন্থায় আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র ও হঠকারিতার যে কর্মকাণ্ড চলছে, তা বিরতিহীন। এসব কর্মকাণ্ড সমগ্র অঞ্চলকেই এক কাতারে আনবে যদি এখনি এসব কর্মপন্থায় সংযুক্ত নট-নটীরা সতর্ক না হয়। পরিণামে সবাই হবে কাজী লেনদুপ দরজি, যার পার্টি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে একটি সিটও পায়নি, যদিও মাত্র পাঁচ বছর আগে পার্লামেন্টে ৩২ সিটের ৩১টি সে দখল করেছিল। ইতিহাস তাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিলো। ভুটানিজ সিনড্রোমের লেখক সতর্ক করে দিলেন। (আলমগীর মহিউদ্দিন, নয়া দিগন্ত-২০ মে-২০০৯)
সম্মানিত পাঠক! মনে হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমাদেরকে সদা প্রহরীর ভুমিকায় থাকতে হবে। আমাদের চিন্তায় কোন ভুল থাকলে শুধরাতে হবে। দল মত যাই হোক সবার আগে তো দেশ তাই নয় কি?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০০৯ সকাল ১১:১৭