আমি ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামের সরকারী প্রাইমারী স্কুলে পড়েছি, তখন সেখানে চারজন শিক্ষকের মধ্যে তিনজন হিন্দু আর একজন মুসলমান শিক্ষক ছিলেন- রশীদ স্যার। রশিদ স্যারের অবসরের পর তার মেয়ে রোজিনা ম্যাডাম আমাদের স্কুলে জয়েন করেন। পরিসংখ্যান একই থাকে, তিনজন হিন্দু এবং একজন মুসলমান। হাইস্কুল ছিল পাশের গ্রামে, সেখানে দশজন শিক্ষকের মধ্যে নয়জন হিন্দু আর একজন মুসলমান ছিলেন, মুসলমান শিক্ষক ইসলাম ধর্ম পড়াতেন। বাংলা, ইংরেজী, অংক, বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ এবং কাজের বিষয়গুলো পড়াতেন হিন্দু শিক্ষকগণ। আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মেরই ছিলাম, হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি ছিল। আমাদের স্কুলের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেইসব ছাত্ররা, অর্থাৎ আজ আমরা যারা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, বলা যায় হিন্দু শিক্ষকগণই আমাদের তৈরি করেছেন। শুধু ইসলাম ধর্ম শিক্ষা বা হিন্দু ধর্মশিক্ষা পড়ে আজ আমরা এই জায়গায় আসিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে রয়েছে সেইসব হিন্দু শিক্ষকদের বাংলা, ইংরেজী, অংক, বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস জ্ঞানের শিক্ষা।
আমি ন’য়ের দশকের কথা বলছি; এবার আরো তিন-চার-পাঁচ দশক পিছিয়ে গিয়ে স্কুলের পুরোনো খাতাপত্র ঘেঁটে দেখুন, অধিকাংশ স্কুলে দেখতে পাবেন যে একজন মুসলমান শিক্ষকও নেই! হ্যাঁ, এটাই বাস্তব ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের শিক্ষাব্যবস্থায় আস্থা রাখেনি মুসলমানরা কাফের শিক্ষা আখ্যা দিয়ে, কাফেরদের শিক্ষা গ্রহণ করলে তাদের ইহকাল-পরকাল দুই-ই নাশ হবে এই ভয়ে! কিন্তু হিন্দুরা ব্রিটিশদের শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক এগিয়ে যায়। শুধু তো শিক্ষা নয়; সংগীত, নৃত্য, বাঙালী সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষায় হাল ধরে ছিল হিন্দুরা। অবশ্য অল্প সংখ্যক মুসলমানও ব্রিটিশের শিক্ষা গ্রহণ করে।
ভারতবর্ষ দুইভাগ হয়ে যায় ১৯৪৭ সালে; তার আগেই ১৯৪৬ এবং পরে ১৯৪৮, ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু মুসলমানদের পেয়ারের পাকিস্তান ছেড়ে ভিটে-মাটি ফেলে ভারতে যেতে বাধ্য হয়। সে-সময় অনেক স্কুল সাময়িকভাবে বন্ধই হয়ে যায় শিক্ষকের অভাবে। তারপরও সেই সময়ের স্কুল-কলেজে অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু, কোথাও কোথাও শতভাগ। এই হিন্দু শিক্ষকেরাই পূর্ব-পাকিস্তান, অতঃপর বাংলাদেশের দুই-তিন প্রজন্মের মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে। হিন্দু শিক্ষকদের হাতে গড়া শিক্ষিত মুসলমানরা স্কুল-কলেজের শিক্ষকতায় প্রবেশ করতে থাকে, ক্রমশ বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। পঁচাত্তর বছরের ব্যবধানে আজ ২০২২ সালে অধিকাংশ স্কুলে মুসলমান শিক্ষকই বেশি, ঠিক আমার কৈশোরের উল্টো চিত্র এখন। হয়ত হিন্দু অধ্যুষিত কিছু অঞ্চলে ব্যতিক্রম আছে। মুসলমান শিক্ষকরা এখন কেবল ধর্মশিক্ষার শিক্ষকে আটকে নেই, সব বিষয়ই তারা পড়াতে জানেন, সব ক্ষেত্রেই তারা প্রতিষ্ঠিত। হিন্দু শিক্ষকদের তাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই, বরং হিন্দু শিক্ষকরা শিক্ষিত মুসলমানদের রুটি-রুজিতে ভাগ বসাচ্ছে! ফলে মুসলমানদের একটা অংশ এখন হিন্দু শিক্ষকদের উৎখাত করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। কিভাবে উৎখাত করা যায়? সেক্ষেত্রে ধর্মের ব্যবহার হতে পারে মোক্ষম হাতিয়ার! সেটাই তারা ব্যবহার করছে। বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে তাদেরকে অপমান-অপদস্ত করা হচ্ছে, জেলে ঢোকানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পুলিশ নির্বিকার। রাজনীতিকরাও ভোটের অংকের হিসাব মাথায় রেখে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে একের পর এক হিন্দু শিক্ষকরা মুসলমানদের একটি চক্রের চক্রান্তের শিকার হয়ে অপমানিত হচ্ছে। সর্বশেষ এই চক্রান্তের শিকার নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। ঘটনা কী? এই কলেজের ছাত্র রাহুল দেব রায় তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়- ‘প্রণাম নিও বস নূপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম!’
নূপুর শর্মার বিষয়টি সকলেরই জানা, তাই সে-বিষয়ে লিখে লেখা দীর্ঘ করলাম না। রাহুল দেব রায়ের এই স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে মুসলমান ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে। অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস তাৎক্ষণিক অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে রাহুলকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। এরই মধ্যে রটে যায় স্বপন কুমার বিশ্বাস রাহুলকে বাঁচাতে পুলিশকে খবর দিয়েছেন! তার বিরুদ্ধেও ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়, পুলিশের সামনেই রাহুলের সঙ্গে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকেও জুতার মালা পরিয়ে অপদস্ত করা হয়!
কিন্তু এসবই যে অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত তা বেরিয়ে আসতে সময় লাগে না। অধ্যক্ষকে সরিয়ে দিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে ৫ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দিতে তৎপর একটি চক্র, তারাই রাহুলের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তোলে এবং স্বপন কুমারের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনে যাতে তাকে অধ্যক্ষের পদ তেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। সেই পুরোনো কৌশল!
পৃথিবীতে ৫৭ টি মুসলিম দেশ, এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই এত সংখ্যক অমুসলিম নাগরিক রয়েছে। বাকি সব দেশ থেকে অমুসলিমদের হয় জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, নয়তো হত্যা কিংবা নির্যাতনের মাধ্যমে দেশছাড়া করা হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় এখনো এত অমুসলিম মানুষ থাকার কারণ- দেশ দুটির শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ৭৫ বছর ধরে এই বঙ্গের হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে দেশত্যাগ করতে করতে এখন ৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ৮ শতাংশ এখনো টিকে আছে ধুঁকতে থাকা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বঙ্গের বহু মত বহু পথের কারণেই। কিন্তু সেই শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখন পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে, ফলে এই ৮ শতাংশের ওপর জুলুম চলছে। এই ৮ শতাংশ এখন এই দেশে উদ্বৃত্ত, এদের যা কাজ, অশিক্ষিত মুসলমানদের শিক্ষিত করে তোলা, তা এখন শেষ হয়েছে। সুতরাং স্বপন কুমার বিশ্বাসদের এখন এই দেশের মুসলমানদের আর কোনো প্রয়োজন নেই, এখন প্রয়োজন তাদের দখলে থাকা চাকরি এবং জমিজমার, তাই এবার তাদের দেশ ছাড়তে হবে! এরা দেশ ছাড়লেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরাক প্রভৃতি দেশের মতো খাঁটি মুসলমানের দেশ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ; যা অধিকাংশ মুসলমানের স্বপ্ন!
যে ছাত্ররা অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়েছে, তাদেরকে কিংবা তাদের কয়েক প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলেছেন স্বপন কুমারের মতো হিন্দু শিক্ষকেরা! স্বপন কুমার বিশ্বাসদের শিক্ষাদানের প্রতিদান জুতার মালা!
জুন, ২০২২ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২২ দুপুর ২:৩৯