দূর্গাপূজার অষ্টমীর রাতে সেজেগুজে পারিকের সাথে বেরিয়েছে ইমা; বাসন্তী রঙের জামদানি পরেছে, একই রঙের ব্লাউজ এবং কপালের টিপ। প্রায় কাঁধ সমান লম্বা চুলগুলো পিছনে টেনে বেঁধে বড় একটা পরচুলের খোঁপা পরেছে। বুকে ইলু ভরেছে, অর্থাৎ নকল স্তন বানিয়েছে। মুখে মেকআপ, কানে সোনালি দুল, নাকে সোনালি নাকফুল। নাকফুলের পাথরটি রাস্তার আলোয় থেকে থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আজই প্রথম সে নারীর বেশে তার পারিক রাজনের সঙ্গে বেরিয়েছে। রাজনের সঙ্গে তার প্রেমের বয়স সাত মাস, এতোদিন সে রাজনের সঙ্গে বাইরে বের হতো পুরুষের বেশে। গত কয়েকদিন যাবৎ সে রাজনের কাছে আবদার করে নারীর বেশে পূজা দেখতে যাওয়ার। রাজন শুনে প্রথমে একটু বিব্রতবোধ করলেও পরে রাজি হয়। ইমার পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত নাম ইমন। এখন সে ইমা নামেই নিজের পরিচয় দেয়। রাজন ওকে আদর করে ডাকে ইমু।
অনেক পুরুষের ভিড়ে খুঁজে খুঁজে, অনেক অপেক্ষার পর ইমা রাজনকে খুঁজে পেয়েছে। ফেসবুকে সে জলপরি নামে একটা আইডি খুলেছিল। প্রোফাইলে একটা পাখির ছবি দিয়েছিল। নিজে আড়ালে থেকে ফেসবুকে অনেক মানুষের ভিড়ে সে তার পারিককে খুঁজতো। কিন্তু ফেসবুকে যে সব সমকামী ছদ্মনামে আইডি খোলে তাদের অধিকাংশেরই কেবল শোয়ার ধান্দা, বাট্টু মারার ধান্দা! পরিচয়ের শুরুতেই তাদের প্রত্যেকের কথা বলার ধরন প্রায় একই রকম-
‘কোথায় থাকো?’
‘তোমার রোল?’ অথবা ‘তুমি টপ না বটম?’
‘তোমর বয়স?’
‘তোমার ছবি দাও।’
‘তোমার প্লেস আছে?’
‘আজ রাতে বাসা খালি, আসবে?’
কেউ কেউ আরো এক ধাপ বাড়িয়ে বলে, ‘আমার সঙ্গে হোটেলে থাকবে? সব খরচ আমার। তোমাকে টাকা দেব। আমি আসলে একজন ভাল বন্ধু খুঁজছি।’
ইমা লক্ষ্য করেছে, এই টাকা দেবার লোভ যারা দেখায় তাদের বয়স চল্লিশের উপরে। এদের ঘরে স্ত্রী-সন্তান আছে, পুরোদস্তুর সংসারী মানুষ। কিন্তু এদের ভেতরের সমকামী সত্ত্বা এদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনের পরও এদের শরীর-মন তৃপ্তি পায় না। এদের শরীর চায় কোনো ছেলের শরীর। ফেসবুকে এরা অল্প বয়সী ছেলেদের পটানোর চেষ্টা করে। কখনো ব্যর্থ হয়, কখনো সফল হয়।
ইমা কিছুতেই পারিক খুঁজে পাচ্ছিল না, তারপর সে নিজের আসল নাম ইমন ব্যবহার করে আইডি খোলে আর প্রোফাইলেও নিজের ছবি দেয়। ইমা দেখতে চিকন, ফর্সা সুন্দর মুখ। এই আইডি খুলে হয় আরেক জ্বালা! ত্রিশ, চল্লিশ, এমনকি পঞ্চাশ বছরের পুরুষরাও তাকে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকে, তার সঙ্গে শোয়ার আবদার করে!
এইসব মানুুষের ভিড়ে পারিক খুঁজতে খুঁজতে ইমা পেয়ে যায় রাজনকে। রাজন তার বয়স জানতে চায়নি, ফোন সেক্স বা ভিডিও সেক্স করতে চায়নি, প্লেস খালি থাকার কথা বলেনি, তার বাট্টু মারার কথাও বলেনি। কিন্তু অনেক কথা হয়েছে দিনের পর দিন। তারপর একদিন সে দেখা করে রাজনের সঙ্গে, রাজন কোনো প্রকার বিলন্তিস বা বাজে ঝামেলা করেনি তার সঙ্গে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুজনে একসাথে আড্ডা দেয়, এরপর দুজনে রিক্সায় যায় নীলক্ষেত, রাজন তাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়ায়। রাতে বিদায় নেবার সময় রাজন হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, সে-ই আগ বাড়িয়ে রাজনকে হাগ করে। তারপর দুজনে আরো অনেকদিন দেখা করেছে। এভাবেই একে অন্যের মনের মানুষ হয়ে গেছে তারা।
আজ বেরিয়েছে অষ্টমীর রাতে প্রতিমা দেখতে। বাহাদুর শাহ পার্ক পার হয়ে শাঁখারী বাজারে ঢোকার মুখের রাস্তায় রিক্সা থেকে নেমে পড়ে দুজন। ইমার পায়ের নিচে ছোট ছোট পিচের গুঁড়ি আর ইটের টুকরো পড়লেও বিচলিত হয় না সে। আলতারাঙা খালি পায়ে এসেছে সে।
আসার সময় ইমার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাজন। ইমাকে খালি পায়ে আসতে দেখে রাজন বলেছিল, ‘খালি পায়ে এসেছো কেন?’
‘এই প্রথম তোমার সঙ্গে মায়ের মুখ দর্শন করতে যাচ্ছি, জুতো পরে গেলে যদি তোমার অমঙ্গল হয়!’
‘আমার যাতে মঙ্গল হয় সেজন্য তুমি খালি পায়ে এসেছো?’
‘হ্যা।’
রাজন হেসেছিল, ‘বেশ, চলো।’
শাঁখারী বাজারে ঢোকার মুখে বানানো অস্থায়ী গেটে নানান রঙের মরিচবাতি জ্বলছে। ওরা দুজন গেট দিয়ে ঢুকে হাঁটতে থাকে; ওদের মাথার ওপরে এবং রাস্তার দু-পাশে জ্বলতে থাকা অসংখ্য মরিচবাতির আলোয় ওদের চেহারা আর পোশাকের রঙও বদলাচ্ছে দ্রুত। মানুষের ভিড়, কোলাহল, উচ্চ আওয়াজের মিউজিক ভেসে আসছে কানে। পারিকের সঙ্গে উৎসবে আসতে পেরে বিপুল আনন্দে উদ্বেলিত ইমার হৃদয়। হাসিমুখে ও গর্বিত বুকে সে এদিক-ওদিক চাইছে, মানুষ দেখছে। পূজা দেখে যারা বের হয়ে আসছে, তাদের অনেকেই ওদের দিকে তাকাচ্ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি গভীর চোখেই তাকাচ্ছে কেউ কেউ! হঠাৎ দর্শনাথীদের ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের একটি শব্দ ভেসে আসে ওদের কানে-‘হিজড়া।’
শব্দটি আমলে নেয় না ইমা। কেননা তার চালচলনে একটু মেয়েলি স্বভাব থাকায় সেই কৈশোর কাল থেকে এখন পর্যন্ত অনেকবার তাকে এই শব্দটি শুনতে হয়েছে, এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শব্দটি রাজনের কানে লাগে পাথরের ঢিলের মতো! কেউ যেন তার পায়ে গুলতি ছুড়ে মারে। ইমার সমান তালে পা ফেললেও তার পা কেমন যেন অসার হয়ে আসে।
ইমার পায়ের নিচে ছোট ছোট পিচের গুঁড়ো আর ইটের টুকরো পড়ছে, মাঝে মাঝে ব্যথাও লাগছে। কিন্তু ইমার কাছে সেই ব্যথা বড় মধুর, বড় সুখের মনে হচ্ছে; যেন নরম মকমলের কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে আর তার পারিক! সেই আনন্দে সে রাজনের হাত ধরে। অনেকগুলো চোখ সার্চ লাইটের মতো পড়ে ওদের ওপর, রাজন কেমন যেন বিব্রতবোধ করে, হঠাৎ সে বিরক্তির স্বরে বলে, ‘হাত ধরবা না।’
ইমার পা থমকে যায়। ওর পায়ের নিচের অনুভূতির মকমলের কার্পেট হঠাৎ যেন কাঁচের টুকরো হয়ে যায়, কিন্তু ক্ষত-বিক্ষত হয় তার হৃদয়! রাজনের বাহু আঁকড়ে থাকা তার হাত দুটো হঠাৎ যেন অসাড় হয়ে বাহু ছেড়ে ঝুলে পড়ে নিচের দিকে। জলভরা চোখে প্রিয় পারিকের চোখের দিকে তাকায় একবার, অচেনা লাগে, ভীষণ অচেনা! তারপর চুপচাপ পিছন ফিরে ডানা ভাঙা আহত পাখির মতো হাঁটতে শুরু করে।
ঢাকা।
অক্টোবর, ২০১৮