somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-বারো)

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লম্বা দূর্বাঘাসে ছাওয়া রেললাইনের উপর দিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছে আর বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে নীলু; তার ডান কাঁধে গাঁটরি আর ডানহাতে ধরা নিজের ব্যবহারের বন্ধ ছাতা, বাঁ কাঁধের ওপর ফেলে হাতে ধরে আছে ছাতার বাঁটের বান্ডিল। সামনে থেকে আসা জোর বাতাসের কারণে হেঁটে এগোতে পারছে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গি মেঘদল উন্মাদের মতো ছুটছে, জড়ো হচ্ছে উত্তরের জমায়েতে। মেঘ ফুঁড়ে ক্ষণে ক্ষণে ঝিলিক দিয়ে উঠছে প্রাণঘাতী বজ্রচাপাতি! সন্ধ্যা হতেই এখনো অনেক দেরি, অথচ কালো মেঘের দাপটে জনপদে এরই মধ্যে যেন রাত নেমে এসেছে! এই জায়গাটা ফাঁকা, প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি-ঘর নেই। দু-পাশে ফসলি জমি, মাঝখান দিয়ে রেললাইন। রেললাইনের দুই ধারে আসশ্যাওড়া, ভেরেণ্ডা, আকন্দ, ভাঁটি, ঢোলকলমী, আলোকলতা, তেলাকুচো, তিতপল্লা, জাপানীলতা, নাম না জানা আরো অনেক বুনো লতাগুল্ম আর মাঝে মাঝে শিশু-আকাশী-মেহগনি এবং বাবলাগাছ। কোথাও কোথাও বিচি কলাগাছের ঝাড়, প্রবল বাতাসে কলাগাছের পাতা আছাড়ি-পিছাড়ি করছে আর চিরে যাচ্ছে।

গাওয়ালে বেরিয়েছিল নীলু। বন্ধু পরিমলের কুমারশালায় আজ গল্প বেশ জমে উঠেছিল। মেঘের তাড়া খেয়েই আসতে হলো। কিন্তু তখনো তো বোঝা যায়নি এতো তাড়াতাড়ি বুনো শুয়োরের মতো তেড়ে উঠবে বাতাস। দুই গ্রামের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় আসতেই আকাশের রূপ যেন বদলে গেল হঠাৎ! ছিল ঘোমটা বিহীন গ্রাম্য বধূ হঠাৎ হয়ে গেল রূপকথার ডাইনি, যেন নিমেষের ছোবলে গিলে ফেলবে তাকে! ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাতাটা ফোঁটাতেই জোড়ালো বাতাসের তোড়ে উল্টে গেল ছাতাটা। উল্টানো ছাতা বাতাসের দিকে ধরতেই সোজা হলো। দ্রুত ছাতাটা বন্ধ করে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো বাতাসের মুখোমুখি। এখন মনে হচ্ছে বন্ধু পত্নীর কথা শুনলেই ভাল হতো। আজ থেকে আসতে বলেছিল। সে জোর করেই চলে এসেছে। এখন বাতাসের তোড়ে সামনে এগোনোই দায়। আর আধা কিলোমিটার যেতে পারলেই গ্রামে ঢুকে কারো বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া যাবে। তারপর ঝড়-বৃষ্টি কমলে যখন খুশি নিজের আস্তানায় যেতে পারবে।

কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না, তার আগেই প্রবল ঝড় উঠে এলো। সামনের গ্রামের গাছপালা যেন শিকড়সহ উঠে আসতে চাইছে এদিকে; নারিকেল গাছগুলো ঝুঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে অপেক্ষাকৃত ছোটগাছগুলোকে! সেই সঙ্গে বৃষ্টি আর তীব্র বজ্রনাদ। নীলু এবং গাঁটরি ভিজে একাকার। বৃষ্টিতে ভিজে গাঁটরিটা আরো ভার হওয়ায় বইতে কষ্ট হচ্ছে। প্রবল বাতাসের ঝাঁপটায় সামনে থেকে তীরের মতো এসে গায়ে-মুখে লাগছে বৃষ্টির ফোঁটা আর গাছের ঝরাপাতা। ঝড়ের বিরুদ্ধে হেঁটে সামনে এগোতেই পারছে না সে, এক পা আগায় তো তিন পা পিছায়, মনে হচ্ছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে! দরাম করে শব্দ হতেই নীলু চমকে উঠলো। কারো চালের টিন উড়ে এসে পড়েছে রেললাইনের উপর। ভাগ্যিস তার গায়ে লাগেনি, লাগলে সে শসার মতো কেঁটে দুই ভাগ হয়ে যেতো! আরো কতো কী উড়ে আসবে কে জানে, গাছের প্রকাণ্ড ডালও উড়ে আসতে পারে। আবার তাকেও উড়িয়ে নিয়ে ফেলতে পারে মাঠের মধ্যে! আর মাথায় একটা বাজ পড়লে তো ইহলীলাই শেষ! নানান রকম নেতিবাচক চিন্তা মাথায় এলেও ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে সে। জীবনেও এমন ঝড়ের কবলে পড়েনি। কিছুটা এগোনোর পর দেখলো লাইনের উপর একটা বড় শিশুগাছ পড়ে আছে। লাইনের দুধারে শিশু আর মেহগনি গাছগুলো বাতাসের তোড়ে অসহায় ভাবে বেঁকে যাচ্ছে। একটা ভেঙে তার মাথায় পড়লেই নিশ্চিত জীবন পাখি উড়াল দেবে! লতাগুল্মগুলো সদ্য স্বামীহারা গ্রাম্য নারীর মতো মাথা কুটছে রেলাইনের ওপর! আচমকা একটা বিকট বজ্রনাদ শুনে ছাতা ফেলে দু-হাতে কান ঢেকে চোখ বুজে বসে পড়লো সে। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুলে বুকে হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে বেঁচে আছে কিনা! আশপাশে তাকালো সে, নিশ্চয় কাছেই কোথাও পড়েছে ডাকটি!

গ্রাম থেকে ভেসে আসছে বরুণদেবতার উদ্দেশে বাজানো শঙ্খ আর উলুধ্বনি, কিন্তু তা বরুণদেবতা নয়, খুব বেশি হলে পৌঁছচ্ছে পূর্বপাড়ার বীরেন কর্মকারের ছেলে বরুণ কর্মকারের কানে, যে সোনার অলংকার বানাতে জানে ঝড় থামাতে নয়!

ঝড়-জলের সাথে যুঝতে যুঝতে বহু কষ্টে নীলু পৌঁছে গেল গ্রামে আর আশ্রয় নিলো ধীমানদের নতুন পাকা ঘরে। আরো প্রায় মিনিট দশেক পর যেন কামুক ঝড়ের রতিপাত হলো। ততোক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শুরু হয়েছে ঝড়ের পরের কোলাহল, কার কী নেই সেই হিসাব-নিকাশ এবং তার অনুসন্ধান, আর ঝড়ের বিকট রূপ নিয়ে যার যার নিজস্ব বয়ান। কেউ কেউ হিসাব মেলাতে লাগলো শেষ কবে এমন ঝড় দেখেছে। কেউ বললো, ‘ধুর, এতো ঝড়-ই না, ঘর্ণিঝড় ছিলো সিডর, উপকূলে কতো মানুষ মরলো!’ আরো অভিজ্ঞরা স্মরণ করলো ১৯৯১ আর ১৯৭০ সালের ঝড়ের কথা। বৃদ্ধ রঘুনাথ বললেন, ‘যুদ্ধের আগের বছর যে ঝড় অইছিল, তার কাছে তো এই ঝড় দুধির শিশু! বাপরে বাপ, সে তো ঝড় না, পেলয় কাণ্ড! মনে অইছিল য্যান কলির শ্যাষ! সারা গিরাম লণ্ডভণ্ড অয়ে গিছিলো। এর ঘর নাই, ওর গোয়াল নাই। তারপর নতুন করে আবার ঘর-বাড়ি তুললাম। কিন্তু বছর ঘুরতি না ঘুরতি-ই যুদ্ধ বাঁধলো আর আমরাও ঘর-বাড়ি ফ্যালা থুয়ে দেশান্তরি অলাম।’

নীলু যখন স্টেশনে পৌঁছলো তখন বেশ অন্ধকার। সারা স্টেশনে পাতা আর ভাঙা ডালপালা, মনে হচ্ছে যেন এখানে কতোকাল কোনো মানুষের পা পড়েনি! তার হাতে-পায়ে-গায়ে কাঁদা মাখা, তাই বারান্দায় গাঁটরি রেখে ঘরের তালা খুলে গামছাখানা নিয়ে পুকুরের দিকে গেল। পুকুরের কাঠের গুঁড়িতে নেমেও আবার উঠে স্টেশন মাস্টারের বাড়ির দিকে গেল খোঁজ-খবর নিতে। সব ঠিক আছে জেনে ফিরে এসে পুনরায় নামলো পুকুরে।

স্নান করে আসার পর খুব হাঁচতে লাগলো নীলু। মাথাটা ভীষণ ভার ভার লাগছে। শরীরটাও বেশ গরম মনে হচ্ছে। শীত শীত লাগছে। ক্ষিধে লেগেছে খুব। খেতে হলে বাজারের হোটেল থেকে খেয়ে আসতে হবে। কিন্তু এখন আর বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে না। ভাতের ভেতর দুটো আলো সিদ্ধ দিয়ে খাবে সে উপায়ও নেই। ঝড়ে রান্নাঘরের বেড়াখানা উড়িয়ে নিয়ে কোথায় ফেলেছে কে জানে! সকালবেলা খোঁজ করে দেখতে হবে। চুলাটাও ঢাকা দিয়ে যাবার কথা মনে নেই। ভারী বৃষ্টির ছাটে চুলা ভিজে গেছে। ভেতরে জল জমেছে। ঘরের স্টোভটাও নষ্ট। অগত্যা মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লো সে। শরীরের তাপ আরো বেড়েছে। একটা কাঁথায় শীত মানছে না। উঠে শেলফ থেকে খবরের কাগজে মোড়ানো আরেকটি পাতলা কাঁথা বের করে আগেরটির উপরে দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।

নীলু সাধারণত খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে। উঠেই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ায়। সূর্য তখন লাল হয়ে বাজারের পূর্বদিকের রেললাইন ধরে ধীরে ধীরে এগোয়। সে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে প্ল্যাটফর্মের পূর্ব মাথা থেকে পশ্চিম মাথা পর্যন্ত। গুনগুন করে গান গায়। তারপর হাত-মুখ ধোয়। কিন্তু আজ আর উঠলো না। ওঠার সামর্থ্য তার নেই। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। জল তৃষ্ণা পেয়েছে প্রচণ্ড। খুব কষ্টে উঠে বেড়া ধরে ধরে মাটির কলসের কাছে গিয়ে একটু জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো। খুব বেশি জ্বর এলে তার হুঁশ থাকে না। আবোল-তাবোল স্বপ্ন দ্যাখে, ভুলভাল বকে। মনে হয় কেউ তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে বনবন করে ঘোরায় চড়কার মতো, তারপর অনেক উপরে শূন্যে ছেড়ে দেয়, আর সেখান থেকে ভয়ংকর গতিতে সে নিচের দিকে পড়তে থাকে। এই সব মুহূর্তে সে কখনো কখনো ‘মা’ বলে জোড়ে চিৎকার করে ওঠে। আজও ভোরের দিকে তার তেমন অনুভূতি হয়েছিল। ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল।

দুপুরের দিকে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো তার। যদিও এখন দুপুর না সন্ধে তা ঠাহর করার অনুভূতি তার নেই। শরীর ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছে। পেটে কিছুই পড়েনি আজ। সেই কাল দুপুরবেলা পরিমলের বাড়িতে ভাত খেয়েছিল। আর রাতে চিবিয়েছে কয়েক মুঠো শুকনো মুড়ি। দূর্বল শরীরটা অনেক কষ্টে বাগে এনে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে রাঙাবউ দাঁড়িয়ে।

কোনোমতে সে বললো, ‘রাঙাবউ, তুমি এই সময়!’
‘সে আজ মোকামে গেছে।’ রাঙাবউয়ের মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল নীলুর রক্তাভ দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে, ‘এ কী! তোমার কী হয়ছে?’
‘জ্বর।’ বলেই দরজা থেকে সরে বিছানায় বসে পড়লো নীলু।
রাঙাবউ ঘরে এসে নীলুর কপালে হাত রাখলো, ‘ওমা, জ্বরে তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে! ওষুধ খেয়েছ?’
নীলু দুদিকে মাথা নাড়লো।
‘ইস্! দেখি তুমি শোও তো। মাথায় জল দিতি হবি। কপাল একেবারে আগুন!’

বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লো নীলু। রাঙাবউ পুকুর থেকে জল এনে মাথায় জল ঢাললো। গামছা ভিজিয়ে গা-মাথা মুুছিয়ে দিলো। জল না হয় ঢাললো কিন্তু খাবার আর ওষুধ? চিন্তায় পড়লো রাঙাবউ। তার পক্ষে তো কিছুতেই বাজারে যাওয়া সম্ভব নয়। সে বাজারে গেলে চেনা-জানা কারো চোখে পড়বেই আর সে কথা তার বরের কানেও যাবে। শেষে ঠিক করলো, আপাতত বাড়ি থেকে ভাত এনে খাওয়ানো যাক। তারপর ওষুধের কথা ভাবা যাবে। বললো, ‘তুমি বসো সখা। আমি যাব আর আসপো। ঘুমায়ে পোড়ো না আবার, দরজা খোলাই থাক।’

চলে গেল রাঙাবউ, আঁচলের আড়ালে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো। টিফিন কেরিয়ার খুলতেই ঘ্রাণ ছড়ালো। একবাটিতে ভাত-সবজি, অন্য দুই বাটিতে কইমাছের ঝোল আর ডাল। নীলু বেড়ার সাথে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে।

‘হাত দিয়ে খাতি পারবা, না খাইয়ে দেব?’ টিফিন বাটি থেকে থালায় ভাত-তরকারি সাজাতে সাজাতে বললো রাঙাবউ।
‘পারবো।’
নীলু উঠতে যেতেই রাঙাবউ বললো, ‘উঠতি হবে না, ওখানেই বসো।’
জলভরা জগ আর একটা খালি টিফিন বাটি নীলুর সামনে ধরে বললো, ‘হাত ধোয়।’

পেটে ক্ষুধা, মুখে বিস্বাদ। তবু রাঙাবউয়ের জোরাজুরিতে খেতে হলো নীলুকে। খাওয়া শেষ হলে পুনরায় বাটিতে হাত ধুয়ে গামছায় মুছে শুয়ে পড়লো নীলু, ‘আমি বসে থাকপার পারতেছি নে। মাথাডা ভার।’
রাঙাবউ থালা ধুয়ে এসে বিছানায় বসে বললো, ‘আবার মাথায় জল দিবা?’
‘না।’
‘একা একা মানুষ এমনে থাকতি পারে! কই একটা বিয়ে করো, তাও করবা না। অসুখ-বিসুখ হলি কে দ্যাখে?’
‘তুমি-ই তো দেখতেছো।’
‘আমি আর কতোক্ষণ! তারপর? সত্যি ঠাট্টা করতিছিনে সখা, এইবার তোমার মিতে আসুক, তারে বলে একটা বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো।’

চুপ করে রইলো নীলু। তার মনের আকাশে ভেসে উঠলো কণিকার মুখ। কে জানে সে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে।
আরো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রাঙাবউ বললো, ‘আমি যাই, দেখি কাউরে দিয়ে ওষুধ আনাতি পারি কিনা।’

রাঙাবউ চলে যেতেই নিঃসঙ্গতার যাতনা বিষাদের রঙ ছড়ালো তার মনের আকাশে। মনে হলো রাঙাবউ যদি আরো কিছুক্ষণ থাকতো কিংবা আজ যদি মিতে আসতো! এমনিতে তার দিবারাত্রি কেটে যায় ভাললাগা-মন্দলাগার মাঝে, কিন্তু অসুখ-বিসুখ হলেই সে ভীষণ অসহায়বোধ করে। তখন তার একাকীত্বের হাহাকার বেড়ে যায়। জলে ডুবে যাওয়া মানুষের খড়-কুটো আঁকড়ে ধরার মতো সে-ও কাউকে আঁকড়ে ধরতে চায়। দিন কাটে যেমন তেমন, রাত যেন পোহাতেই চায় না। মনে হয় অনন্তকাল ধরে সে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে! সেইসব রাত্রে কখনো রাঙাবউ এলে তার মনে হয় বহু বছর পর সে সূর্যের দেখা পেয়েছে!

রাঙাবউ, বউমারা তপনের বউ। হ্যাঁ সত্যিই, রাঙাবউয়ের বর বউমারা তপন, বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তপনের নামের সাথে এই উপাধিটি যোগ হয়েছে! বউকে একেবারে মেরে না ফেললেও দিন নেই রাত নেই যখন-তখন তপন বউ মারে আর বউয়ের মা-বাপ তুলে অশ্লীল গালাগালি করে। এজন্য গ্রামের লোক তার নাম দিয়েছে বউমারা তপন। মাস কয়েক আগে এক অপরিচিত ভদ্রলোক গ্রামে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদা তপনের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’

লোকটা তখন বললো, ‘গ্রামে তো তপন দুইজন। আপনি কোন তপনের বাড়ি যাবেন? কুঁজো তপন না বউমারা তপনের বাড়ি?’
আরেক তপনের পিঠে আবার কুঁজ আছে, তাই তার নাম কুঁজো তপন। ভদ্রলোক প্রশ্ন শুনে মানসিকভাবে হোঁচট খেলেন। বললেন, ‘ঐ যে বাজারে বড় মুদি দোকান আছে যার, সেই তপনের বাড়ি যাব।’

লোকটা তখন বললো, ‘ও, বউমারা তপন! সামনে আগায়ে যান। তারপর ডানের রাস্তায় ঢুকে কয়ডা বাড়ি পর দেখবেন বাঁ-দিকে একটা চিকন হালট চলে গেছে রেললাইনের দিকে। ঐ হালটের সাথের বাড়িটাই বউমারা তপনের বাড়ি।’

মন খারাপ হয়েছিল ভদ্রলোকের। তিনি কষ্ট করে দূর থেকে এসেছিলেন খুড়তুতো বোনটাকে দেখতে। এসে দেখবেন বোন তার পাকা গিন্নী হয়ে সুখে-শান্তিতে স্বামী-শাশুড়ি নিয়ে সংসার করছে। তা না গ্রামে ঢুকেই তাকে শুনতে হলো ভগ্নিপতি তার বোনকে মারে। বউমারা তপনের মানে তো তাই দাঁড়ায়!

বউমারা তপনের বউ, যার ডাক নাম পুরবী। সে-ই যে এক মাঘের শীতের রাতে নীলু যাকে আশ্রয় দিয়েছিল। পরের রাতেও নীলুর ঘরের দরজায় শব্দ হয়েছিল। নীলু তখন ঘুমানোর আয়োজন করছিল। সে ঘরের ভিতর থেকেই বলেছিল, ‘কে?’

বাইরে থেকে নীচু স্বরে নারীকণ্ঠ বলেছিল, ‘আমি, আমি পুরবী। কাল রাতে...’

কণ্ঠ শুনেই নীলুর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এ কী উপদ্রব শুরু হলো! আগের রাতে সে ভূতের ভয় পেয়েছিল। কিন্তু পরের রাতে সে ভয় পেয়েছিল এই ভেবে যে, বধূটির জন্য তাকে কোন বিপদেই না পড়তে হয়! আবার অসহায় একজন নারীকে এই শীতের রাতে আশ্রয় না দেওয়াও নির্দয় কাজ। দরজা খুলে দিয়েছিল নীলু।

‘আপনি ঘুমায়ে পড়িছিলেন?’
‘না, ঘুমানোর আয়োজন করতেছিলাম।’
‘আমি আপনারে বিরক্ত করলাম, তাই না?’

নীলু যতো না বিরক্ত তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত। তবু শঙ্কা গোপন করে বলেছিল, ‘না না বিরক্ত হবো ক্যান? নেহাত আপনি অসুবিধেয় পড়ছেন। নইলে কী আর আসতেন!’

পুরবী বিছানায় বসে বলেছিল, ‘আজও আমায় ঘর থেকে বের করে দিলো। পাশের ঘরে নয়তো তার মায়ের কাছে গিয়ে শুতি বললো। আমি পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে কী তাগের লীলাকীর্তন শোনবো! কোন স্ত্রী তা সহ্য করতি পারে! আর বুড়ির কাছেই বা কেমন করে শোবো? বুড়ি অসুস্থ। ঐ ছাপড়া ঘরে একা ঘুমায়। কথা বলতি পারে না ভালো মতো। ডাকলি মরার মতো তাকায়। বুড়ির পায়খানা-প্রসাব আমারেই পরিষ্কার করতি হয়। নাওয়াতি-খাওয়াতি হয়। তাই বলে রাতে তার কাছে আমি একা শোব! ক’দিন পরপরই বিছানা-কাপড় কেঁচে দিই। তবু বিছানা-কাঁথা দিয়ে কী দূর্গন্ধ! গা দিয়েও গন্ধ। সারা রাত মালসায় আগুন জ্বলে। তার ধোঁয়ার গন্ধ। অমন রোগীর ঘরে একা থাকা যায় বলেন? যদি রাতে মরে আমার পাশে শক্ত হয়ে থাকে! আমার ভয় করে। মিথ্যে বলবো না, ঘেন্নাও করে!’

নীলু হাঁ হয়ে পুরবীর কথা শুনেছিল। কী সাবলীল ভাবে মনের কথা বলে সে! লুকোয় না কিছু। আরও অনেক কথা বলেছিল পুরবী। সবই তার নিজের কথা। বর্তমানের পোড়া দিনের কথা, বাবার বাড়ির সুখের দিনের কথা। এক সময় নীলু বলেছিল, ‘কেউ যদি দেখে ফেলে যে, আপনি এই রাতে আমার ঘরে, তালি যে আপনার লোকনিন্দা হবেনে।’

হঠাৎ ফুঁসে উঠেছিল পুরবী, ‘হয় হোক, তালি আমিও বাঁচি, বাপের বাড়ি ফিরে যাব! আমি আর ভয় করিনে। কই তার তো লোক নিন্দার ভয় হচ্ছে না। নিজের বউরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দূর সম্পর্কের শালিকে নিয়ে শুয়ে আছে। তবে আমি কেন লোকনিন্দার ভয় পাব! আমি তো আর তার মতো ছেনালি করতি এখানে আসিনি। ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, চলে এসেছি। সারাটা দিন বাড়ির মধ্যে থাকি। আমার দম আটকে আসে জানেন। কারো সাথে মন খুলে কথা বলবো তেমন মানুষটি নেই। পাড়ায় যাওয়া নিষেধ। আমার বাবার বাড়ি যৌথ পরিবার জানেন। কাকাতো-জ্যাঠাতো ভাই-বোন মিলে বার-তেরো জন। হাটের মতো বাড়ি। কথা বলার লোকের অভাব দূরে থাক, একটু একা নিরিবিলি থাকবার ফুসরত ছিল না। ছোটবেলা থেকে ঐ অভ্যেস আমাদের। আর এখানে ঠিক উল্টো।’

নীলু পুরবীর মুখের সাহসী কথা শুনে বিস্ময় বনে গিয়েছিল। তারপর আবার বলতে শুরু করেছিল পুরবী, ‘আজ যখন ঘর থেকে বের করে দিলো তখন রান্না ঘরের বারান্দায় বসে ভাবলাম, আত্মহত্যা করি। ছোট আমগাছটার ডালে ঝুলে জীবন জ্বালা জুড়াই। তারপর আবার মনে হলো, মরলে তো আমিই মরলাম। তার কী! সে তো আবার দু-দিন না যাতি-ই বিয়ে করে সংসার করবিনি। জেদ চেপে গেল মনে। জীবনের শেষ দেখতি চাই। একা একা কতোক্ষণ বারান্দায় বসে থাকা যায়! শেষে আপনার কথা মনে হলো। কাল রাতে আমারে আশ্রয় দিয়ে বাঁচায়ছেন। নইলে শীতের মধ্যে মরে পড়ে থাকতাম। ভোরে অন্ধকার থাকতি চলে গেলাম, বলেও যাতি পারলাম না। এমন ভাবে ঘুমাচ্ছিলেন, ডাকতি খারাপ লাগলো। আজও আসার সময় ভাবলাম আসা উচিত হবি কি-না। শেষে সব ভয় ডর পায়ে ঠেলে চলে এলাম। এখন আপনার যদি কোনো অসুবিধা হয় বলেন, চলে যাই।’

নীলু পুরবীর কথার মাঝে আর কথা বলেনি। সে বুঝেছিল পুরবীর ভেতরে কথা জমে আছে। তাই হালকা হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। নীলুর তখন মনে হয়েছিল কণিকার কথা। পুরবীর মতো কণিকার ভেতরেও জমে ছিল কতো কথা। কণিকাও এমনিভাবে তার কাছে কথার ঝাঁপি খুলে ভেতরের গুমোট কাটাতো! কণিকার সকল বেদনার ভাগী হতো সে।

নীলু সৌজন্য দেখিয়ে বলেছিল, ‘না না আমার কোনো অসুবিধা নাই।’ শঙ্কা সত্যিই ছিল তার।

এরপর থেকে প্রায়ই রাতের বেলায় নীলুর দরজার কড়া নড়তে লাগলো। আর নীলু শঙ্কিত বুকে দরজা খুলতে লাগলো। কিন্তু একটা সময় তারও শঙ্কা কেটে গেল যখন দু-জনের মধ্যে গড়ে উঠলো অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। একদিন পুরবী বললো, ‘আমাদের মধ্যে যখন বন্ধুত্ব-ই হলো, তখন আপনি আপনি করে কথা বলাটা ভাল দেখায় না।’

অতঃপর আপনি’র দূরত্ব ঘুচে তুমি হলো। পুরবী এখন নীলুকে সখা বলে ডাকে। আর নীলু তাকে ডাকে রাঙাবউ বলে।

সর্বনাশী মাসতুতো বোন রুপালি না থাকলেও মাঝে মাঝেই রাতেরবেলা সখার কাছে আসে রাঙাবউ। রুপালি না থাকলে তপন দোকান বন্ধ করার পর জসিমের চাল কলে মদ আর জুয়ার আড্ডায় যায়। সেখান থেকে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। পুরবী মাতালের অপেক্ষায় বসে থাকে। তপন বেশিরভাগ দিনই বাড়িতে এসে ভাত খায় না। বিছানায় পড়েই ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকতে থাক শুরু করে। কোনো কোনো দিন অকারণে পুরবীর গায়ে হাত তোলে। গালাগালি করে। আবার কোনো কোনো দিন এসেই পুতুলের মতো তাকে ছুড়ে ফেলে দেয় বিছানায়। হয়তো দরজা খোলাই থাকে কিংবা ঘরে বাতি জ্বলছে। পুরবী কোনোমতে হাত দিয়ে বেডসুইচটা অফ করে। তপনের মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ বের হয়। পুরবীর পেট গুলিয়ে ওঠে। আপন পুরুষের চুম্বনে বিষের অনুভূতি হয়। সে মিলনের আনন্দ ভুলে যায় অস্বস্তিতে, বিরক্তিতে, তপনের পশুর মতো আচরণে। কাঠের পুতুলের মতো সে ক্ষণিকের জন্য নিজের শরীরটাকে ফেলে রাখে তপনের দেহসুখের জন্যে!

তপনের সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয়, তখন এই মানুষটির প্রতি তার ভালবাসা জন্মায়নি। জন্মার কথাও না। বিয়ের আগে ঘটা করে তাকে দেখতে গিয়েছিল তপন। বিয়ের পর ভালবাসা জন্মার আগে, কোনো প্রকার মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই বাসর রাতে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে শারীরিক সম্পর্ক। শারীরিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই আকাশময় ছড়ানো মেঘের মতো ভালবাসা যখন একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছিল মানুষটির প্রতি, তখনই মুহূর্তের বাতাসে উড়ে যাওয়া মেঘের মতোই মিলিয়ে যেতে থাকে তার ভালবাসা। মিলিয়ে যেতে যেতে এখন আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। শুধুই সামাজিকতার দায়ে, বাবা-মা, জ্যাঠার সম্মানের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন এই মানুষটির সাথে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, ভালবাসা বিহীন শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।

জৈবিক ক্ষধা মিটিয়ে পা ছড়িয়ে যখন মরার মতো ঘুমায় তপন, তখন পুরবী বিছানা ছেড়ে ওঠে। তপন মদের গন্ধমুখে তাকে চুমু খায়, মুখ চাটে-বুক চাটে, কামড়ায়। তখন নিজের শরীরটাকেই ঘেন্না লাগে পুরবীর। নিজেকে অপবিত্র মনে হয়। কলতলায় গিয়ে স্নান করে সে, কুলিকুচি করে। মদের গন্ধ ধুয়ে যায় শরীর থেকে। এরপর কোনোদিন সে ঘুমোতে যায়। আবার কোনোদিন কিছু সময়ের জন্য আসে নীলুর কাছে। তপন পাড় পাতাল হওয়ায় এই এক সুবিধে। সকালের আগে তার ঘুম ভাঙে না, ভোরের আগে তো নয়-ই। পুরবী ঘরে শিকল দিয়ে নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারে তার সখার কাছে। সখাতে-রাঙাবউতে সুখ-দুঃখের গল্প করে। হাসি-ঠাট্টা করে। নীলু তার রাঙাবউকে গান শোনায়, সানাই বাজিয়ে শোনায়। রাঙাবউ তন্ময় হয়ে শোনে। খোলা মনে প্রশংসা করে। তার বানানো ভাস্কর্যের প্রশংসা করতেও ভোলে না। রাঙাবউয়ের প্রশংসা শুনে নীলুর উৎসাহ চলকে পড়ে, তার ঝরে পড়া স্বপ্নবীজ অঙ্কুরিত হয়ে স্বপ্নবৃক্ষ হয়, পুনরায় ফোটে স্বপ্নফুল, ফুটতেই থাকে....!

এমনি গল্প করতে করতে কোনো কোনো রাত ভোর হয়। এক সময় মোরগ বাগ দেয়। পাখি ডেকে ওঠে। ভুলু ডেকে ওঠে। ডুবে যায় শুকতারা কিংবা শেষ রাতের চাঁদ। কতো রাত ভোর হয় এমনি ভাবে! রাঙাবউ ফিরে যায় তার বরের ঘর নামক তাসের ঘরে। কোনো গোপন অভিসার নয়, নয় শারীরিক সুখের লেনদেন। যেন এক বিমূর্ত সম্পর্ক! একটু বন্ধুত্ব, একটু কথা বলা, একটু হাসি-তামাশা। নীলুর প্রতি এক মায়াময় টান অনুভব করে রাঙাবউ। বরের সোহাগ বঞ্চিত তার নারী হৃদয় একটু মিঠে কথার আদর চায়। মিঠে কথার এই আদরটুকু নীলুর কাছে পায় সে। তাই লোকনিন্দার ভয় উপেক্ষা করে বারবার সে আসে তার সখার কাছে।

রাঙাবউ যেন কোনো এক অজানা সুখের ডালি নিয়ে আসে তার কাছে, আবার ফিরে যেতেই সে শূন্যতা অনুভব করে কিন্তু বুকের কন্দরে তখন শীতল বাতাস বয় কণিকার জন্যে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সমস্ত হৃদয় জুড়ে থাকে কণিকা। সে তো কমলপুর ফিরে গিয়েছিল কেবল কণিকার জন্য। কণিকাকে বলতে চেয়েছিল, ‘চল কণিকা, আমি এক স্বপ্নের স্টেশন পেয়েছি। সেখানে আসে আমার কল্পনার রঙিন ট্রেন। আমি ট্রেন চালাবো। তুই হবি সেই ট্রেনের একমাত্র যাত্রী। আমাদের কল্পনার ভুবন চষে বেড়াবো আমরা দু’জন। পৃথিবীর সকল ফুলের রঙ নিয়ে আমি তোর সাদা কাপড় রাঙিয়ে দেব, চল যাই কনিকা!’

কিন্তু পায়নি সে কণিকাকে। তার আগেই উড়ে গেছে কণিকা! মাঝে মাঝে সে ভাবে কণিকা কি তার ফেরার অপেক্ষায় ছিল? সে-ই কি ফিরতে দেরি করেছিল?

রাঙাবউ এলে নীলু প্রাণখুলে তাকে কণিকার গল্প শোনায়; কণিকার সুখের সোনালি দিনের গল্প, দুখানলে পোড়া ধূসর দিনের গল্প। রাঙাবউ তার সখার মুখ থেকে শোনে কণিকা নামের মেয়েটির জন্য বুক থেকে উৎসারিত হাহাকারের শব্দ! শুনতে শুনতে রাঙাবউয়ের ভেতরে ক্ষরণ হয়। মনে মনে তপন আর নীলুকে পাশাপাশি দাঁড় করায়। এতোকাল সে শুনেছে নারী হৃদয় বড় রহস্যময়। অথচ এই দু’জন পুরুষকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে তার মনে হয় পুরুষও কী কম রহস্যময়! একজন নিজের স্ত্রীকে পায়ে ঠ্যালে, আরেকজন এক বিধবার জন্য কাঁদে! নারী কিংবা পুরুষ নয়, আসলে হৃদয় মাত্রই এক রহস্যময় দূর্গ!

মাঝে মাঝে বিকেল অথবা সন্ধ্যার দিকেও রাঙাবউ আসে নীলুর কাছে, যখন তপন দোকানে থাকে। রাঙাবউ প্রায়ই তার সখার জন্য এটা সেটা খাবার নিয়ে আসে। ভাল কিছু রান্না করলেই আঁচলের নিচে করে নিয়ে হাজির হয়। একদিন নীলু নিষেধ করে বলেছিল, ‘ইডা কিন্তু ঠিক হতেছে না রাঙাবউ। দাদা জানলি তোমারে মারবেনে, আর লোকে শুনলি ছিঃ ছিঃ করবেনে। তুমি আর আনো না।’
রাঙাবউ অভিমান করে বলেছিল, ‘আনবো না তো! তবে কাল থেকে আর রাঙাবউয়ের মুখ দেখতি পাবা না।’

নীলু অসহায় সুরে বলেছিল, ‘রাগ ক’রো না রাঙাবউ। আমি তোমার ভাল’র জন্যেই কতেছি। তাছাড়া অমন একটা অমানুষের রোজগারের টাকায় কিছু খাতি আমারও ভাল লাগে না।’

রাঙাবউয়ের চোখ ভিজে গিয়েছিল, ‘স্বামীর মনেই যখন জায়গা হলো না। আমার আর ভাল দিয়ে কী হবি সখা?’

একটু থেমে রাঙাবউ আবার বলেছিল, ‘রোজগারের কথা বললে তো সখা? আমি বাড়িতে কাজ করি না? আর বিয়ের সময় যে আমার বাবার বাড়ি থেকে এতোগুলো টাকা যৌতুক আনলো। হাটের গরু কেনাবেচার মতো সারা রাত দর কষাকষি করে শেষ রাতে ঠিক হলো দুই লাখ টাকা আর ছয় ভরি সোনা। সে-সব কী ওর!’

আর কিছু বলেলি না নীলু। সে জানে আর কিছু বলতে গেলেই রাঙাবউ অভিমান করবে। আর রাঙাবউয়ের অভিমান বড় যাতনার। তার অভিমান মানেই মৌন থাকা। কোনো কারণে অভিমান করলে কয়েকদিন আর এ মুখো হয় না। তখন সুযোগ বুঝে নীলুকেই গিয়ে অভিমান ভাঙাতে হয়।

সন্ধ্যার দিকে নীলুর জন্য ওষুধ আর থার্মোমিটার নিয়ে এলো রাঙাবউ। তার নিজের জ্বরের কথা কাগজে লিখে পাশের বাড়ির অমলের বারো বছরের ছেলে অসীমকে দিয়ে পাঠিয়েছিল আলিম ডাক্তারের কাছে। আলিম ডাক্তার অসীমের হাতে ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছে। রাঙাবউ নীলুকে ওষুধ খাওয়ালো। জ্বর মাপলো, একশো দুই জ্বর। রাঙাবউ আবার মাথায় জল দিতে চাইলে নীলু বলো, ‘এহন আর জল দেবার দরকার নাই। তুমি বাড়ি যাও। কেউ যদি...’

রাঙাবউ নীলুর কথা অগ্রহ্য করে বালতি নিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখলো পুকুরের উদ্দেশে। জল এনে ঘরের দরজা ভেজিয়ে নীলুকে ধরে শুইয়ে দিলো। তারপর নীলুর মাথায় জল ঢাললো। মাঝে মাঝে হাতে জল নিয়ে নীলুর তপ্ত কপাল-চোখ ধুয়ে দিলো। নীলু মাঝে মাঝে চোখ উল্টে তাকালো রাঙাবউয়ের দিকে। তার মনে হলো তপন একটা পাষাণ্ড, অপদার্থ! এমন বউকে কেউ কষ্ট দেয়! হঠাৎ ভেজানো দরজা ঠেলে কেউ একজন ঘরে ঢুকলে রাঙাবউ চমকে পিছনে তাকালো। মগের জল ছিটকে পড়লো নীলুর মুখে!

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১:২১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×