(চৈত্রের বৈতালিক হাওয়ার রাত। জোছনালোকিত নীড়মহলের শুভ্র দেয়ালে আছড়ে পড়ছে হাওয়া। নীড়মহলের তিনদিকে তীব্র দাবদাহে ফাঁটা চৌচির আবাদী-অনাবাদী ভূমি! জোছনায় ভেসে যাচ্ছে প্রান্তর। আরও দূরে গ্রাম। একদিকে জল। সে জল পাড়ি দিয়েই তরুণ কবি পা রাখে নীড়মহলে। এককালের সদা সর্বদা প্রাণচঞ্চল নীড়মহল এখন সুনসান। কেবল দর্শনার্থীদের যতটুকু পদচারণা। তারপর আবার নীরব। দলছুট হয়ে একা একা হাঁটতে থাকে কবি-ইতিহাসের স্বাদ নিতে নিতে। নীড়মহলের নাচ ঘরে এসে থমকে দাঁড়ায় কবি। বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশিরানি অনুভব করে। একটা বাতাস উঠলো-শীতল বাতাস। বয়ে গেল বুকের ভেতর দিয়ে। নাচঘরে কবি একা একা হাঁটে আর জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে রুদ্রসাগরকে। পৃথিবীর বুক বেয়ে জোছনা চুইয়ে পড়ছে রুদ্রসাগরের কোলে! বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শীতল জলের চোরা স্রোত নামে কবির বুকে। এককালের নুপূর-নিক্বণে মুখরিত নাচঘরে এখন কেবল নৈঃশব্দ বাতাসের মহড়া চলছে। হঠাৎ ঘুঙুরের শব্দে চমকে ওঠে কবি। চতুর্দিকে তাকিয়ে শব্দের উৎসস্থল খুঁজতে থাকে। পিছন থেকে শোনা যায় লাস্যময়ী হাসি। চুড়ি-ঘুঙুরের নিপুণ শব্দ।)
কবি : কে? কে ওখানে লাস্যময়ী?
মাধবীলতা : (মাধবীর হাসি)
কবি : কে তুমি অন্তরালে তুলছো চুড়িতে নিঁখুত নিনাদ
ঘুঙুরে বিরহী বাসনার আর্তনাদ?
মাধবীলতা : আমি গো কবি...
কবি : কবি! কি করে জানলে তুমি, আমি কবি?
মাধবীলতা : জানি গো, জানি, আমি সব জানি।
কবি : তুমি সব জানো! তবে সামনে এসো
অন্তরালে বুনো না রহস্যের জাল।
মাধবীলতা : অন্তরালের এই জাল ছিঁড়ে
আমি যে পারবো না আসতে তোমার সামনে!
কবি : কেন? এমন কি দূর্ভেদ্য সে জাল
যে তুমি সামনে আসতে পারবে না!
মাধবীলতা : সে আমি তোমায় বলতে পারবো না কবি।
কবি : তবে এ কথা অন্তত বল, তুমি কে?
কি করছো এই নির্জন প্রাসাদে?
মাধবীলতা : ও মা! কেমন কবি গো তুমি,
ঘুঙুরের শব্দ শুনেও বুঝতে পারোনি, আমি কে?
কবি : খানিকটা পেরেছি করতে অনুমান
সে ঐ মেঘলা আকাশের তারাটির মতো।
মাধবীলতা : অর্ন্তভেদী কবির অনুমান শতভাগ সত্য।
কবি : তবে বল, কি নাম তোমার?
মাধবীলতা : মাধবীলতা। মাধবী নামেই ডাকতো সবাই
শুধু ওঁ ডাকতো লতা নামে।
বাবা অবশ্য নাম রেখেছিলেন মঞ্জুশ্রী
কিন্তু সে নাম ওঁর নয় পছন্দ, বলতো- মঞ্জুশ্রী বড্ড সেকেলে;
তাই নিজেই রেখেছিল নাম-মাধবীলতা।
কবি : ওঁ কে? বুঝেছি, তোমার স্বামী।
(মাধবী লতার হাসি।)
একি, তুমি হাসছ যে!
মাধবীলতা : হাসবো না! তুমি দেখি ছাই কিচ্ছুটি জান না
কেমন কবি গো তুমি!
কি করে লেখো অমন রসের কবিতা
শব্দের বুননে পাথরে জাগাও কাম
সন্ন্যাসিনীর ভেতরেও গড়ায় বাসনার ঘাম!
জানো না বুঝি, আমাদের থাকতে নেই পতি?
কবি : বুঝেছি আমি মাধবীলতা, তবে
এখন তুমি কি করছ এখানে
কেন পড়ে আছ এই বোবা বিজন প্রাসাদে?
কেন ফিরে যাওনা তোমার ঘরে-
আপন সংসারে?
মাধবীলতা : বাড়ি ছিল আমাদের
সেখানে তেমন হতো না থাকা।
তবে আমাদেরও ছিল একটা সংসার
তোমরা যাকে সংসার বলে জানো
তেমন সংসার নয়।
কবি : মানে!
রহস্যের বুনন ছিঁড়ে
বলবে কি একটু খোলাসা করে?
মাধবীলতা : আমাদের বাড়ি ছিল পদ্মানদীর পাড়ে
ফরিদপুরে।
ঢোল বাদক বাবা,
মা ছিলেন ঝুমুর দলের নায়িকা।
কখনও যশোর, কখনও খুলনা, কখনও নদীয়া-চব্বিশ পরগনা
আবার কখনও বিক্রমপুর, ঢাকা, কুমিল্লা
বারোমাস ঘুরে ঘুরে করতে হতো
ঝুমুর পালা।
আমি তাদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে
কখন যেন বড় হয়ে যাই
বুঝতেও পারি না। হঠাৎ-ই নিজেকে আবিষ্কার করি
হাজারো মানুষের চোখের ভেতর-
যারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,
তীক্ষ্ণ চোখে বুকের দিকেও।
ইশারা করে, সিটি বাঁজায়
মেলার খরচ বাঁচিয়ে পয়সা ছুঁড়ে দেয়।
আমি তখন বেশ গাইতে পারি, দূরন্ত নাচতে পারি!
তেমনি একদিন গাইছিলাম পালা- কুমিল্লার এক মেলায়।
ওঁর এক শিল্পী বন্ধু আমাকে দেখেছিলেন তখন। ক’দিন বাদেই-
বাবা আমাকে নিয়ে অচেনা লোকেদের ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন
এক নিশুতি রাতে। আমি বললাম-
‘বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
বাবা বললেন, ‘একজন মহান মানুষকে গান শোনাতে।’
অচেনা লোকেদের দেখিয়ে আমি বললাম, ‘এরা কারা বাবা?’
বাবা আবার বললেন, ‘এরা তাঁর পেয়াদা।’
আমি চুপ করে অন্ধকারে গাছপালা দেখতে লাগলাম।
ঘোড়ার গাড়ির দুলুনিতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম বাবার কাঁধে মাথা রেখে।
যখন জেগে উঠলাম, দেখি ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলেছে অন্ধকার সাঁতরে
হঠাৎই আমার নাকে এলো অপরিচিত শরীরের বিশ্রী গন্ধ
আমি অনুভব করলাম এ গন্ধ বাবার নয়, বাবার গায়ের গন্ধ আমার চেনা
এক ঝটকায় অচেনা লোকের কাঁধ থেকে মাথা তুলে আমি বললাম-
‘বাবা কোথায়? আমার বাবা কোথায়? আমি বাবার কাছে যাব।’
অচেনা লোকদুটো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। যেন কষ্টিপাথরের সে মুখ!
আমি ‘বাবা,বাবা..’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে
গাড়ি থামাতে বললাম।
তারা আমার কোন কথাই শুনলো না।
দূরন্ত গতিতে গাড়ি ছুটতে লাগলো অন্ধকার ছিঁড়ে-ফুঁড়ে
আমি জোড় করে গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইলাম
একজন সজোড়ে আমার ডান গালে কষলো এক চড়
আমি জ্ঞান হারালাম....
কবি : তারপর!
মাধবীলতা : পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো যখন
তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করি
এই প্রাসাদের একটি নির্জন কক্ষে।
দক্ষিণের জানালায় ছুটে গিয়ে দেখি অথৈ জলরাশি!
উত্তরের জানালায় ছুটে গিয়ে দেখি অথৈ জলরাশি!
চতুর্দিকে কেবল অথৈ জলরাশি!
জলরাশি বেষ্টিত নির্জন প্রাসাদ কে কেবল আমি একা একটি মানুষ।
জলের ওপারে সবুজ গ্রাম মাথা দুলিয়ে আমাকে লোভ দেখায়,
কিন্তু কাছে টানে না মোটেও।
সেই থেকেই আমার জীবন বন্দী হয় ঐ নির্জন ক আর এই নাচঘরে।
হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে বাবা-মা, ঝুমুর দল,
মেলা, যাযাবর জীবন আর মঞ্জুশ্রী।
আমি হয়ে যাই মাধবীলতা।
কবি : এতকাল তুমি এখানেই আছ?
মাধবীলতা : কি করবো বল? মুক্তির উপায় নেই।
কবি : ইচ্ছে করে না তোমার মুক্ত হতে?
মাধবীলতা : ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে মুক্ত হয়ে, মুক্ত পাখির মতো আকাশে উড়ি।
উড়ে যাই ফরিদপুরের পদ্মাপাড়ের সেই সবুজ গ্রামে
বাসন্তী, রোকেয়া, দিপালীদের সাথে পদ্মায় সাঁতার কাঁটি
আলপথে ছুটো ছুটি করি
বাবুদের ভাঙা দেউলে পুতুল খেলি
ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে....
কিন্তু আমার ইচ্ছের পায়ে যে শিকল পড়ানো!
কবি : তুমি তো চাইলেই এখন মুক্ত হয়ে
তোমার যেখানে খুশি চলে যেতে পারো
কেউ তো তোমাকে বাঁধা দিতে আসবে না।
মাধবীলতা : মাধবীলতাদের মুক্ত নেই কবি!
মাধবীলতাদের পায়ে এক অদৃশ্য শিকল পড়ানো থাকে
চাইলেই তারা ইচ্ছে মতো মুক্ত হতে পারে না।
স্থান বদলায়, কালবদলায়, পাত্রও বদলায়,
কিন্তু মাধবীলতাদের জীবন বদলায় না!
কবি : আমি তোমাকে মুক্তি দেব মাধবীলতা।
মাধবীলতা : (হাস)ি
কবি : হাসছ কেন তুমি? দোহাই তোমার অমন করে হেসো না
তুমি হাসলে আমার ভেতরে কালবৈশাখী ডানা মেলে।
মাধবীলতা : কবি, তুমি ভালবাসা বোঝ, জীবনের জটিল তত্ত্ব বোঝ না!
ভালবাসার কাঙাল তুমি, তবু ভালবাসা বিলাতে দ্বিধা কর না
তাই তো আমি তোমাকে পেয়ে সাড়া দিলাম।
কবি : ভেতরে আমার কৌতুহল অকাতরে দিচ্ছে উঁকি
এতো বছরে তুমি কি দেখতে একই রকম আছ?
মাধবীলতা : মাধবীলতাদের বয়স বাড়তে নেই কবি, বয়স বাড়ে না।
বয়স বাড়লে মাধবীলতারা শুধুই শুকনো লতা, এঁটো পাতা;
বয়স বাড়লে নিশ্চিত আস্তাকুঁড়।
তাই তো আমি শুকনো লতা না হয়ে এখনও মাধবীলতা।
কবি : তুমি এখানে থাকবে আর কতকাল?
মাধবীলতা : যতকাল থাকবে নীড়মহল, ততকাল।
কবি : তারপর?
মাধবীলতা : জানিনা।
হয়তো বাওড়ি বাতাসে রুদ্রসাগরের ঢেউয়ে
বিলীন হবে এই দুঃখের বালিয়াড়ি।
কবি : তুমি বেঁচে থাকবে মাধবীলতা,
তুমি বেঁচে থাকবে আমার কবিতায়।
আমি তোমাকে অমরত্ব দেব।
( মাধবীলতা নীরব)
মাধবীলতা, মাধবীলতা, কথা বল তুমি
তুমি কি চলে গেলে?
তাই বুঝি বইছে এমন বাওড়ি বাতাস!
মাধবীলতা : (কাঁন্নার রেশ) আমার অতিথি তুমি, তোমাকে ফেলে যাব
আমি নই অতটা হৃদয়হীনা। এ নয় বাওড়ি বাতাস,
এ আমার দীর্ঘশ্বাস!
কবি : তোমার কন্ঠে কাঁন্না! কেন মাধবীলতা!
আমি কি না বুঝে তোমায় দিয়েছি যাতনা?
মাধবীলতা : তুমি যে দিতে জান না যাতনা, সেকি আমি জানি না!
সময় হয়ে এলো তোমার চলে যাবার
তাইতো আবেগ বাঁধা মানেনা।
অনেক কাল পরে আমি কথা বললাম মানুষের সাথে
সারাক্ষণ তো কেবল পাখি, প্রজাপতি, ঘাস ফড়িং আর
রুদ্রসাগরের নিঃসঙ্গ পানকৌড়ির সাথে কথা বলে চলি।
কবি : এই বিদায় ক্ষণে একটিবার দেখা দেবে না মাধবীলতা?
মাধবীলতা : না কবি, অবুঝ হয়ো না কবি
আসছে শ্রাবণ পূর্ণিমায় তোমায় রইলো নিমন্ত্রণ
আসবে তুমি, বল?
সেদিন সকল আগল ভেঙে আমি আসবো তোমার সামনে
কেবল তোমার জন্যে আবার ঘুঙুরে ফেরাবো যৌবন
চৌষট্টি কলা করবো তোমায় সমর্পণ!
জোছনায় ভিজে-পুড়ে পোয়তী রুদ্রসাগরের বুকে
বাওড়ি বাতাসে ভেসে বেড়াবো তুমি আর আমি
আমার নিঃসঙ্গ পানকৌড়ির ডানায় চেপে।
রইলো তোমায় আকুতি ভরা নিমন্ত্রণ,
আসবে তুমি কবি?
কবি : আসবো মাধবীলতা, আসছে শ্রাবণে না হোক
কোন এক শ্রাবণের পূর্ণ চাঁদের জোছনার মেলায়
আমি আসবো ছুটে তোমার কাছে।
জোছনায় বিভোর হয়ে তোমার চৌষট্টি কলার রস করবো আস্বাদন
এই পাথুরে প্রাসাদ থেকে তোমাকে মুক্ত করবো।
ভেসে গিয়ে বাওড়ি বাতাসে অনন্ত সুখের বালিয়াড়িতে
গড়বো দুজন মায়াবী প্রাসাদ।
মাধবীলতা : স্বপ্নজাল বুনবো বলছো?
কবি : বুনো, স্বপ্নজাল ছুঁড়ে দিয়ে বাতাসে
সে জালে জড়িও আমাকে, কাছে টেনো
কথা দিলাম মাধবীলতা, আমি আসবো-
তোমার পানকৌড়ির ডানায় চড়ে।
আমি আসবো মাধবীলতা.........
(আবার নাচ ঘরে নিঃশব্দের যবনিকা নামে। আরেক ঝাপটা বাতাস বয়। বাতাস, নাকি মাধবীলতার দীর্ঘশ্বাস! কবির অন্তর ছুঁয়ে সে বাতাস মিলায় রুদ্রসাগরের বুকে। কবির চোখের পাতায় নেমে আসে মাধবীলতার নিঃসঙ্গ কালো পানকৌড়ি। কবি পানকৌড়ির ডানায় চেপে বসে। কবিকে আরোহী করে, বাতাসে সাতার কেঁটে পানকৌড়ি উড়ে যায় রুদ্রসাগরের উজানে। কোথায় যায়...!)
*মাধবীলতা সম্পূর্ণ একটি কাল্পনিক চরিত্র।