প্রতিবছরের মত এবারও ভবদহ এলাকার বসতবাড়ি জলের নিচে; গাছপালা, চাষেরজমি সবখানেই জল আর জল। এলাকাজুড়ে শুধু হাহাকার, কষ্টের সুর। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিরাও আছে কঠিন বিপদে। খাদ্য এবং বাসস্থানের অভাবে জীবন যায় যায় অবস্থা সকলের। কয়েকদিন হল সুমনদের বাড়ির মেঝেও জলের নিচে। দুইটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে নিয়ে মহাঝামেলায় আছে সে, সকাল থেকেই সুমন রাস্তার পাশে একটা কুড়েঘর তৈরির চেষ্টা করছে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাতগুলো নিরাপদে কাটানোর জন্যই এ আয়োজন। শুধুমাত্র এই রাস্তাটাই ডুবতে বাকি। আশঙ্কা আছে ক্ষতি গতবারের চেয়েও বেশি হবে, টুকটাক বৃষ্টিও হচ্ছে। সবার মনেই চিরচেনা দুঃখ, নিরাময়ের বাসনা এখানে পাঁচ তারকা বিলাসিতা।
এলাকার বড় নেতা দলবলসহ ডুবা এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনে এসেছে। নেতার উপস্থিততে এলাকার কিছু উৎসাহী মানুষও সঙ্গে জুটেছে। সুমনেরও যাওয়ার কথা ছিল, নেতার সাথে তাঁর সম্পর্কটাও বেশ পুরাতন। সকালে বউয়ের সাথে এক ঝটিকা বকাবকি হয়ে গেছে, তাতে আবার পেটে পড়েছে পান্তা ভাত আর বাসি আলুরদম, মন খুব একটা ভালো নেই। সুমন দেখেও না দেখার ভান করে কাজ করতে থাকে এই পরিদর্শন টিমকে।
"কিরে সুমন, কি করিস?" নেতার প্রশ্ন।
সুমন, "পাটালি দিয়ে গুড় ভরায়ে ভরায়ে খাচ্ছি। আপনিও অংশনিতি পারেন।"
নেতা, "মজা কত্তিছিস আমাগের সাথে! তোগের দুর্দিনি দেখতি আসলাম, আর ওমনি অপমান করার চিষ্টা কত্তিছিস! ঐরাম শত্তুরির মত কতা কচ্ছিস, কাহিনীডা কি?"
“শত্তুর না, আপনি হলেন জনগণের বন্ধু। আপনাদের এই এলাকার উন্নয়নের টাকা মা'রে খাওয়ার অধিকার আছে। আপনার একার ভালোর জন্যিতি, আমরা হাজার হাজার লোক পানিবন্দি। গতবারে কোটি টাকা দিয়ে আপনি শহরে ব্যবসা বাড়ায়েছেন। আমরা মরি কি বাঁচি, সিডা না দেখলিও চলবেনে।", সুমনের উত্তর।
নেতা, “কি কইস এসব আবোল তাবোল?”
“একবিন্দুও মিছে কইনি, আপনার কীর্তিকর্ম সব ফাঁস হয়ে যেত! টাকা আর ক্ষমতার জোরে বেঁচে গেছেন, এবার আর রক্ষে নেই। আপনি নির্ঘাত ধরা খাবেন।“, সুমনের দাতভাঙ্গা জবাব।
হঠাৎ নেতার হাসি হাসি মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সুমনের বোকামি দেখে গ্রামের লোকজনতো অবাক; এরুপ কঠিন সত্যগুলো আজ যে কেন এড়িয়ে গেলনা সুমন! এটা কেউ বুঝতে পারছে না। আশেপাশের সন্ত্রস্ত আমজনতা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলো। নেতার পাশে থাকা ঘনিষ্ট কয়েকজন সুমনকে মারার জন্য এগিয়ে আসতে চাইলে, নেতা বাঁধা দিল।
নেতা বলল, "সারাদিন খাটা পিটনা করেছে তাই মিজাজটা ইট্টু খারাপ আছে। ইট্টু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবেনে। মাথা গরম করিসনে তোরা। ও সুমন, মন খারাপ করিসনে ভাইডি। আমিতো তোগের ভালোই চাই, উপায় নেইরে ভাইডি!" গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিল নেতা। তারপর হোহো করে হেসে উঠে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হল নেতা।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আর কোনদিন ফিরে আসেনি সুমন।
ভবদহের সুমন || অনুগল্প
মিন্টু ভদ্র
০৫/০৮/২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৭