“কত্তদিন তুমি গল্প লিখোনা, এইবার একটা কঠিন প্রেমের গল্প লিখো”, বাবু বললো আমাকে। আসিফ হাসান বাবু। ভাগ্যিস, ওর নামের মাঝে বাবু আছে!! তা না হলেও তো আমি ওকে বাবু বলেই ডাকতাম!! কলেজ পড়ার সময়টাতে অনেক প্রেমিক প্রেমিকা যুগল কে বলতে শুনতাম - “জান্, তুমি কোথায়? বাবু তুমি খাইসো? জান্ তোমায় অনেক অনেক মিস্ করতেসি, ইত্যাদি ইত্যাদি”। শুনে আমি মুখ বেকাতাম, ‘ইইহ্ তোদের প্রেমের বয়স হইসে? জান, বাবু আরো কত কি!! ঢং য়ের শেষ নাই তোদের। আগে তো ঠিক করে বড় হ তোরা”। প্রেম বিদ্বষী আমি প্রেমের পায়রা দের হাত ধরে হেঁটে চলা, শিশুর মতো আধো আধো কথা বলা, সুযোগ পেলে একে অন্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেওয়া প্রকৃতপক্ষেই সহ্য করতে পারতামনা। বয়ঃসন্ধির বয়সটার উপর ওই বয়সটা পার হয়ে যাওয়াদের যেমন একটা বিতৃষ্ণা বা সন্দেহ, আমি যেন ওই পার হয়ে যাওয়াদের দলেই ভিড়ে ছিলাম। আমি যেন পরিণত হওয়ার আগেই অনেক বেশি পরিণত, অনেক বেশি সতর্ক।
কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমার এক বান্ধবী অশ্রু-সজল হয়ে বলেছিল, সে যাকে এতোদিন অনেক ভালোবাসতো, সে নাকি তাকে প্রেমের আহবানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তার এখন কি করা উচিত? যুথির অন্যান্য বান্ধবীরা নাকি তাকে হ্যাঁ বলতে পরামর্শ দিয়েছে, আমার মতামত কি? আমি ওকে অনেক বিজ্ঞের মতো বললাম, “আচ্ছা ছেলেটা যদি তোমাকে পার্কে নিয়ে গিয়ে তোমার হাত ধরতে চাই তুমি স্বাভাবিক থাকতে পারবা? এই যে ভালোবাসো ভালোবাসো বলছো, তুমি কি নিশ্চিত এটা মোহ নয়, এটা প্রেম? যখন ভার্সিটি পরবা, একটা সুন্দর ছেলেকে দেখে তোমার আরো বেশি ভালো লেগে গেলো, তোমার হাতে তো তখন সে সুযোগ টাও নেওয়ার উপায় থাকবেনা”। আরো অনেক কিছুই বুঝালাম ওকে, পড়াশোনার কথা বললাম, পরিবারের কথা বললাম, ভালবাসা নিয়েও অনেক কথা বললাম। যুথি ছেলেটাকে না করে দিল। ওই সেমিস্টারে যুথি অনেক ভালো রেজাল্ট করলো। আমাকে বললো - “তোমার জন্যই আমি আজ ভালো রেজাল্ট করতে পারলাম”। আমার রেজাল্ট ভালো ছিলনা, কিন্তু যুথির এই সাফল্যে আমার অবদান আছে চিন্তা করে মনে একটা অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করলাম।
মনে করেছিলাম একটু বড় হলেই আমার এই প্রেম বিতৃষ্ণা চলে যাবে। কিন্তু তখন যেন আমি নিজেকে সেই কলেজ জীবনের বয়সেই ভাবতে লাগলাম। আমি ভার্সিটি তে ভর্তি হলাম। সবাই যেন প্রেমের রাজ্যে ডুব দেওয়ার জন্যই সদা প্রস্তুত হয়ে আছে সেখানে। আজ এ ওকে প্রপোজ করেছে তো পরশু দু’জন মিলে বেহায়ার মতো গা ঘেষে ঘেষে হাঁটছে, তার ও হয়তো দু’দিন পরে
দু’জন মিলে বৃষ্টিতে নব ধারায় প্লাবিত হচ্ছে। আমার অসহ্য লাগতো। ভালোবাসার মানে কি বুঝে ওরা? ভালোবাসা মানেই কি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া? ভালোবাসা কি সকাল সন্ধ্যা ফোন করে - “বাবু কি করো? খাইসো? ঘুমাইসো?” এসব ন্যাকা কথা বলা? তবুও মনের মধ্যে একটা ভালোবাসার লোভ জেগে উঠছিলো ধীরে ধীরে। ভাবতাম, ইস্ আমায় যদি কেও খুব গোপনে ভালোবাসতো? কেও যদি হুট করে এসে আমায় বলতো - “প্রভাত শেষে আলোয় রঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”। সে কোনদিন আমায় ন্যাকা করে কথা বলবেনা, আমায় কারণে অকারণে পার্কে নিয়ে সুযোগ বুঝে হাত ধরতে চাইবেনা, রবীন্দ্র উপন্যাসের নায়কদের মতো তার প্রেম হবে নিস্বার্থ। সে আমাকে অন্তর থেকেই ভালোবাসবে, কোন লোক দেখানো সৌজন্যতা থাকবেনা তার মধ্যে। সে আমার কাছে হবে জলের মতো পরিস্কার। আমি ভাবতাম। স্বপ্ন সত্যি হবেনা জেনেও সুন্দর স্বপ্ন দেখার রেশ যেমন অনেকক্ষণ থাকে তেমন আমার এসব ভাবনা আমাকে মনে মনে তৃপ্তি দিতো। উপন্যাসের নায়িকাদের আমার বড্ড ভালো লাগে, আমি কেন সাধারন হতে যাবো?
আমার জীবনের একটা মুহুর্তে আসিফ এলো, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় ইতি টানতে যাচ্ছিলাম। কিভাবে পরিচয়, মনের কাছা কাছি আসা সেগুলো না হয় অন্য কোন গল্পেই বলবো, আজ সেসব থাক। মনে আছে প্রথম যেদিন রিক্সায় উঠেছিলাম কেমন অসভ্যের মতো আমার গা ঘেষে বসেছিলো। আমি যতই সরে সরে যাচ্ছিলাম ও যেন ততোই আমার কাছে সরে সরে আসছিলো। সেদিনই ছিলো আমাদের প্রথম দেখা!! আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। ভয়ও হচ্ছিল। প্রতিদিন কতো প্রতারণার খবর শুনি, আমি তেমন কোন ফাঁদে পড়লাম না তো? হে, ঈশ্বর আমায় রক্ষা করো। টুপ করে আমার হাতটা ও ধরে ফেললো নির্ভীক হয়ে। আমার ভয় চূড়ান্ত হলো, চোখের কোনে জলের কণাও জমা হয়ে গিয়েছিল। আসিফ আমার মুখ চোখ দেখে বললো, “তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমি কি তোমাকে রেপ্ করবো”? আমি আরো করুণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, তা দেখে ও পাত্তা দিলো বলে মনে হলোনা। আমার হাত ওর হাতের সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। মনে হচ্ছিল আমি শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম। হায়, এমন প্রেম কি আমি চেয়েছিলাম?
আসিফ আমাকে বলতো, “তোমার কথা শুনলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। আমাকে অন্তত দিনে ১০ মিনিট কথা বলার সুযোগ দিবা”? কথা বলতেও আমার অস্বস্তি হতো। কি বলবো ভেবেই পেতাম না। আচ্ছা, আমার কন্ঠ কি সুন্দর শোনাচ্ছে? আমার কথা কি ওকে আনন্দের যোগান দিচ্ছে? ওর যাতে ভালো লাগে, সে কারণে কেন জানি এমন কিছু কথা বলতাম যা আমার ধাতে নেই। কিছু কৃত্রিম কথা, কিছু সরল কথা, কিছুবা খুব গোপণ কথা, এমন কথায় কথায় আমাদের কথা জমে গেলো। ১০ মিনিট ২০ মিনিট হলো, ২০ মিনিট ও কিছুদিন পরে ডাল পালা শাখা প্রশাখা মেলে কত শত মিনিট হলো তার হিসেবে নেই। আমাকে আর ও অনুরোধ করতোনা, আমিই কারনে অকারণে আমার কণ্ঠে ওকে মুগ্ধ করার দায়িত্ব নিয়ে নিলাম।
দেখতে দেখতে অনেকটা সময়ই আমরা পার করে ফেললাম। যখন দেখা হতো ও আমাকে শুধু ছুঁয়ে দিতে চাইতো, বলতো তোমাকে একটা ......... ? আমি লজ্জা পেতাম, ভয় পেতাম। আমার বিবেক আমাকে বলতো, এসব করা ঘোরতর অন্যায়!! আমি ওকে না করতাম। ও রাগের ভান করতো, কষ্ট পেতো। আমায় বলতো এতোই যদি ন্যায় অন্যায়, আমার সাথে প্রেম করছো এতে তোমার অন্যায় হয়না? আমি শিশু-সুলভ হাসি দিয়ে ওর হাত ধরে বলতাম, না হয়না!!
তবুও কোন কোন রাতে, কোন কোন ভোরের বেলায় কিংবা কোন কোন মন খারাপ করা সন্ধ্যায় ওর কথা খুব মনে হতো। মনে হতো, ওর বুকের মধ্যেই যেন আমার আশ্রয়! ছি ছি!! এসব চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়াটা ও ঠিক না।
- আসিফ, তোমাকে না আমার আসিফ ডাকতে আর ভালো লাগেনা, তোমায় আমি বাবু বলে ডাকবো।
- আচ্ছা বাবু, তোমায় ও আমি বাবু ডাকবো, আমরা তাইলে দুই বাবু।
- হুম আমি ছোট বাবু, আর তুমি একটু বড় বাবু।
বাবু ডাকটার মধ্যে কেমন জানি একটা ভালোবাসার রেশ আছে, একটা স্নেহের রেশ আছে। বাবু ডাকলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। “আমরা দু’টি বাবু, প্রেমের জ্বরেই কাবু”। এতোদিনে প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের বাবু ডাকের মাহাত্ম্য আমার কাছে বোধগম্য হলো।
সেদিন ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে আসলো। সন্ধ্যার পরে রিক্সা করে বাসায় ফিরছিলাম আমরা। ঠান্ডা বাতাসে বাবুর শরীরের উষ্ণতা টের পাচ্ছিলাম। আমার অন্যরকম লাগছিলো, খুব ভালো লাগছিলো। রিক্সা-ওয়ালা হুড তুলে দিলো। বাবু আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে, আমায় কানে কানে বললো, প্লিজ বাবু তোমার ঠোঁটে একটা চুমু দিই? এটাই প্রথম, এটাই শেষ। আজ আমি ওকে না করলাম না। নিজেও কি মনে মনে এটাই প্রত্যাশা করছিলাম?
বাবু, কঠিন প্রেমের গল্প আমি লিখতে পারিনা। উপন্যাসের নায়িকা নই, আজ আমি সবার মতোই সাধারন। সাধারন কি কখনো কঠিন কিছু লিখতে পারে? বরং আমি কোমল স্মৃতিচারণই করলাম আজকে এই জৈষ্ঠ্যের রাতে...
(একটি লুতুপুতু গল্প লিখার চেষ্টা )