দ্বিতীয় পর্ব
সন্ধ্যার পর সীমিত আকারে আহার করে বের হয়ে পড়লাম। ডিএমসির টয়লেটের অবস্থা স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমার টয়লেটের মতো, তবে অমিতাভ বচ্চন অটোগ্রাফ দিলেও আমি ওই টয়লেট ব্যবহার করতে পারব না; এজন্যই এই সীমিত আকারে খাওয়া।
আজ ৭ই মার্। বহু বছর পর মনে হয় ভাষণ না শুনেই ৭ই মার্চ পার করলাম। ঢাকা শহর অপরূপ সাজে সেজেছে। রাজমনি সিনেমা হলের পাশে রমনা থানা, এজি অফিস, একটু দূরে প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে ফরেন মিনিস্ট্রি সবকিছু আলোয় ঝলমল করছে। দেশের উন্নতি দেখে বুকটা ফুলে উঠল।
ফরেন মিনিস্ট্রেতে আলোকসজ্জা। চলন্ত রিকশা থেকে তোলা।
রাত সাড়ে আটটা মতো বাজে। সাধারণত post-operative ওয়ার্ডে ছয় ঘণ্টার বেশি রুগি রাখা হয় না। আমরা সৌভাগ্যবান, কি কারনে জানি না- আমাদেরকে এখনো ওয়ার্ডে ট্রানস্ফার করা হয় নি। পেপার রেডি করা হচ্ছে । আমরা রুগির ওয়ার্ডের সামনে বসে আছি।
কাজিন বললো ভাই- পা একটু সামলায়ে , সন্ধ্যার পরে যে ক্লিনার মহিলা ডিউটি করছে তার মুখ ল পাস। আমি একটু গুটিয়ে বসলাম। পাশের বিছানায় যে পরিবার বসে আছেন তারা মনে হয় আমাদের বেশ পরে এসেছেন, কাজিন যতটা জানে ওনার অতটা জানেন না, ওনাদের একজনের পা বিছানার একটু বাইরে , চলাচলের রাস্তায় ছিলো।
ক্লিনার মহিলা ময়লা ফেলার বাস্কেট দুটা রোগী ট্রান্সফার করার ট্রলিতে বসিয়ে রওনা হলেন। পাশের বিছানার অ্যাটেন্ডেন্টের পা এর কারণে রাস্তা ব্লক থাকায় তুমুল বাবা মা তুলে গালি গালাজ শুরু হয়ে। গেলো আমি কাজিনকে বললাম - আমরা সৌভাগ্যবান, আমাদেরকে এটা এই এক বেলা সহ্য করতে হচ্ছে, চিন্তা করে দেখো এই ভদ্রমহিলার পরিবারের কি অবস্থা। কাজিন বললো- আমার মনে হয় না এই মহিলার বাসায় এরকম একজনই আছে, যে রকম মহিলা, বাসায় এই পিস আরো তিনটা থাকলে অবাক হবো না।
কাজিনের ফুপা শশুর বাসা থেকে খাবার দিয়ে গেছেন। কাজিনের খাওয়া-দাওয়ার আগ্রহ নেই; কিন্তু পরে কখন সুযোগ হবে জানি না, ওকে খেতে নিতে বললাম। ঐ পরিবেশেই আর সবাই খাচ্ছে, কাজিনও খেয়ে নিলো।
কাজিনের ওয়াইফকে দেয়া হবে নিচ তলায়, ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে। কাজিনের খুব আগ্রহ স্ত্রীকে ওয়ার্ডে না রেখে কেবিনে রাখবে । আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিষেধ করলাম । অন্তত পক্ষে আরো দুটো দিন পরে নার্সের সার্বক্ষণিক দৃষ্টির সামনে থাকা দরকার। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে দু-তিন দিন পর না হয় কেবিনের চেষ্টা করা যাবে।
এতক্ষণ দুজন রোগী (মা ও ছেলে) একই ফ্লোরে পাশাপাশি ওয়ার্ডে ছিলো, অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আমাদের সমস্যা কম ছিলো। এখন দুজন দুই ফ্লোরে। ম্যানেজ করবো কি ভাবে? আমরাই বা থাকবো কোথায় ? এখনতো আর ২১২ ওয়ার্ডের করিডোরে আমাদের থাকতে দেবে না।
কর্তব্যরত আনসারদের জিজ্ঞাসা করাতে ওনারা জায়গা দেখিয়ে দিলেন। সিড়ির পাশের একটা চিপা যায়গায় ১০-১৫ জন আছেন। এর বাইরে করিডোরে আরো ২০-৩০ জন। সিড়ি দিয়ে দোতলা থেকে তিন তলার ওঠার সময়ে মাঝের স্পেসে আমাদেরকে থাকতে হবে, ২১১ নম্বর এর সবাই এর আশে পাশেই থাকেন। ২১১থেকে অ্যাটেনডেন্টদের দরকার পড়লে হ্যান্ড মাইক দিয়ে ডাকা হয়। আশে পাশে অ্যাটেনডেন্ট কেউ না থাকলে আনসার ভাইদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখলে ফোন নম্বর দিয়ে রাখলে ওনারা ফোনে ডেকে দিতে পারবেন।
অ্যাটেনডেন্টদের থাকার যায়গা।যেখান থেকে ছবি তোলা সেখানে আমরা থাকবো।
দশটা নাগাদ ট্রান্সফার পেপার পাওয়া গেল। আবার লবনের বস্তার মতো রোগিকে বেড থেকে ট্রলিতে। ওয়ার্ডের আয়াকে কাজিন আগেই বখশিশ দিয়ে রেখেছে। নিচতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । ২১২এর গেটে কঠিন তল্লাশি। তিনজন আনসার ব্যাগ , ট্রান্সফার পেপার চেক করে অনুমতি দিলেন। বাচ্চা চুরি রোধে এই ব্যবস্থা। একারণে ২১২ থেকে বাচ্চা চুরির কথা শোনা যায় না। নিচে কঠোরতা কম। ওখানে মাঝে মাঝে হয়।
নিচ তলায় যাবার লিফট বন্ধ। একশ গজ ঘুরে ইমারজেন্সিতে একটা স্লোপ আছে, যখন লিফট ছিলোনো ওদিক দিয়েই ওঠানো হতো। ওদিক দিয়ে ঘুরে আবার একশ গজ ঘুরে ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ত্রিশ চল্লিশটা বেড। প্রায় তিনভাগের একভাগ ফাকা। অন্য দিনের তুলনায় আজ অবস্থা একটু ভালো, ডাব্লিং করতে হবে না। একটা খালি বেড খুঁজে আবার লবণের বস্তার মত করে রোগীকে ট্রলি থেকে বেডে ট্রান্সফার করলাম।
সাহায্যকারি আয়া জানিয়ে দিলেন যে ওয়ার্ডে রাখতে গেলে একজন 'খালা' লাগবে। কিছু বয়স্ক মহিলা আছেন, এনারা রোগির গোসল করা, বাথরুমে নেয়া, খাওয়ানো এসব কাজে সেবা করে থাকেন। এদের খালা বলা হয়। কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছেন । এরা হাসপাতালের অংশ নন, রোগিরা যা দেয় তা দিয়েই এনাদের চলে।
আয়া আমাদের খালা খুঁজে দিলেন। বললেন এই খালাটা খুব ভালো। খালার সাথে চুক্তি হলো- খালাকে আমরা আগামি চার দিনের জন্য ৮০০ টাকা দেবো। এখানে সাধারণত চার দিনের বেশি থাকা লাগে না । এরচেয়ে বেশি যদি থাকতে হয় তবে তার জন্য আলাদা হিসাব করা যাবে। খালার কথা মত আমরা আপাতত একটা ছোট বালতি, সাবান ইত্যাদি কিনে দিলাম।
কাজিনের ওয়াইফের খিদে নেই। তবে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে হালকা কিছু খেতে হবে। আবার বাইরে যাওয়া। লাল চা এবং পাউরুটি এনে চায়ে ভিজিয়ে পাউরুটি খাওয়ানো হলো।
আসার পর থেকে নার্সকে দেখিনি। হয়তো কেবিনে গিয়েছিলেন। দেখলাম এত বড় ওয়ার্ডে মাত্র একজন নার্স। মনে হয় আরেকজন অন্য কোথাও ব্যস্ত আছেন।
অধিকাংশ ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে। তবে কিছু ওষুধ সাপ্লাই নেই। নার্স ফর্দ ধরিয়ে দিলো , কি কি লাগবে তার। আবার দোকান, ফর্দ মত জিনিস নার্সের কাছে জমা দিলাম। এক মিনিট পর নার্স ভিতর রেখে পাঠালেন- একটা ইঞ্জেকশন নার্স স্কয়ারের লিখেছেন দোকান থেকে রেনাটার দিয়েছে। বদলে আনতে হবে। আনলাম।
রুগির ফুপু আছেন। উনি রাতে থাকবেন। রোগীর পাশে একটা বেড ওনার জন্য যোগাড় করা হলো । ওনাকে খেয়ে নিতে বলে আমরা উপরে চলে গেলাম। ফুপুর কাছে আমাদের ফোন নম্বর আছে, বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আনসার ভাইকে ১০০ টাকা আর আমাদের ফোন নম্বর দিয়ে ওনার ফোন নম্বর নিয়ে গেলাম।
আমাদের বিছানার পাশের বিছানার ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী আট-নয় দিনের মতো আছেন। ওনাদের রোগীর অবস্থা বেশ ভালো , সম্ভবত দু'একদিনের মধ্যে চলে যাবেন। অল্পস্বল্প কুশল বিনিময় করে বিছানা বিছিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম । মশা সংখ্যায় অত্যন্ত কম, তবে দুই একটা যা আছে তা ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। চোখের ওপর আলো। এই জায়গাটায় ফ্যান নেই, গরম। ঘুমানোর অনুকুল পরিবেশ না। ফোন চেক করে দেখলাম, সাত তারিখে সারাদিনে সাতাশ হাজার স্টেপ হাঁটা হয়েছে, যা করোনার মধ্যে রেকর্ড। শরীরের ক্লান্তির কারণে বসে থাকতে পারছি না, গা এলিয়ে দিলাম।
পিডোমিটার অ্যাপে স্টেপ সংখ্যা
সারারাত এই সিঁড়িপথে অসংখ্য লোকের আনাগোনা। কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয় না, তবে রাস্তাটা এমন সরু, না চাইলেও ধাক্কা লেগে যায়। নিচে এক নিশাচর ভদ্রলোক ফোনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। সারারাত ফোন টেপাটিপি করে গেলেন। বুঝলাম না , রাতের বেলা ফোনে এতো কি কাজ । সকলেই বিপদের মধ্যে আছেন, ওনাকে কেউ কিছু বলছেনা দেখলাম, আমিও কিছু বললাম না।
একটা থেকে আনুমানিক চারটা পর্যন্ত আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে ছিলাম (কাজিন সেটুকুও ঘুমাতে পারে নি); তারপর আর শুয়ে থাকতে পারলাম। চুপচাপ বিছানা বসে থাকলাম। ফজরের পর দুই ভাই মিলে বসে পরিকল্পনা ঠিক করলাম- আপাতত আমি বাসায় ফিরে যাব। হাফ ডে অফিস করে দুপুরের পর ফিরে আসবো। আমাদের দুজনের পক্ষে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করা সম্ভব না। কাজিন আগের দিনই গ্রামের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছে, আগামিকাল রিইনফোর্সমেন্ট চলে আসছে।
কাজিনের খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে সাতটা নাগাদ বাসার পথে বেড়িয়ে পড়লাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:৩৪