১ম পর্ব
তো সকাল ৮:৪৫ এর দিকে আমাদের জানানো হলো আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট অনুসারে রুগির প্লাসেন্টা ছিড়ে গেছে, জরুরি ভাবে অপারেশন করতে হবে। আমার অনুমান আমরা আসার পরপরই আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছিল, কিন্তু সেই সময়টা নরমাল অপারেশন আওয়ারের বাইরে বলে তখন আমাদেরকে বিষয়টা জানানো হয়নি ।
সে যাক, নার্স হাতে দুটো স্লিপ ধরিয়ে দিলেন। একটা দুই ব্যাগ রক্তের রিকুইজিশন স্লিপ, আর একটা স্লিপে অপারেশনের জন্য কি কিনতে হবে তার লিস্ট । সার্জিক্যাল টেপ , ব্লেড, গ্লাভস, কিছু ইঞ্জেকশন ইত্যাদি। হাসপাতালে এগুলোর সাপ্লাই নেই। কাজিনকে ওয়ার্ডে রেখে আমি ওষুধের দোকানে দৌড়াই। প্রায় হাজার টাকার মতো লেগে গেল ফর্দ মিলিয়ে জিনিস কিনতে।
(আমি যে সময়টাতে বাইরে থাকছি, কাজিন কিন্তু বসে থাকছে না, মাঝে মাঝেই নার্সরা একটু পরপরেই নতুন লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছেন, দু'জনকেই দৌড়াতে হচ্ছে। সে সময় কাজিনের শশুর মেয়ের পাশে থাকছেন।)
লিস্ট অনুযায়ী জিনিস ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে রক্তর খবর নিলাম। পরিচিত অনেককেই রক্তের জন্য ফোন করা হয়েছে, গ্রুপ ম্যাচ করে, কিন্তু ঢাকায় আছেন - এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাগনা তার বন্ধুদের দুজনকে বলেছে। ওরা মিরপুর থেকে রওনা দিয়েছে। মিরপুর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসতে যে সময় লাগে তাতে লন্ডন-প্যারিস রিটার্ন যাতায়াত হয়ে যায়। রক্ত কি তাহলে কিনতেই হবে?
এর মাঝে লাইন ম্যানেজারকে ইমেইল করে দিলাম- ডোন্ট কল মি আই উইল কল ইউ। আজ এবেলা অফিস কামাই হচ্ছে।
রক্তের জন্য নার্স কয়েকবার তাগাদা দিয়ে গেছেন। ভরসা সন্ধানী। সন্ধানী এর অফিস আওয়ার জানা নেই, তবে এটুকু জানি কলেজ বিল্ডিং এর নিচতলায় এর অফিস আছে, এখন নটা পার হয়ে গেছে কাজেই খোলা না থাকার কথা না। ভাগনা সহ স্লিপ নিয়ে চলে গেলাম কলেজ বিল্ডিঙে।
ওনারা জানালেন যে গ্রুপের রক্ত দরকার তা স্টকে আছে। তবে ওনারা এমনি এমনি রক্ত দেয়া প্রেফার করেন না, ভালো হয় যদি আমরা এর বদলে দুই ব্যাগ রক্ত ডোনেট করি। জানালাম ভাগনা একটু আগে রক্ত দিয়েছে এখন আর দিতে পারবেনা , তবে আমি দিতে পারবো । নার্সদের স্লিপে লেখা আছে রোগীকে ওটিতে নিতে হবে। আমাদের তাড়া আছে বুঝে ওনারা কথা না বাড়িয়ে আমাদের দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে দিলেন। খরচ হিসাবে ১০০০ টাকা দিতে হলো।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে ১০০০ টাকা রক্তের দাম না, গ্রুপিং, স্ক্রিনিং, রক্তের ব্যাগের দাম- এসব খরচ কাভারের জন্য এই টাকাটা না নিয়ে উপায় থাকে না। আর সব লেনদেনের রশিদ ওনারা দিয়ে থাকেন।
রক্ত নিয়ে আবার দৌড়ালাম ডিএমসির নতুন বিল্ডিঙে, ট্রান্সফিউশন সেন্টারে। আইন অনুসারে এখানে আবার নতুন করে স্ক্রিনিং করতে হবে, ক্রস ম্যাচ করতে হবে। সাড়ে নটা বাজে। ওনারা জানিয়ে দিলেন দেড় ঘন্টা সময় লাগবে । ওয়ার্ডে ফিরে এসে শুনলাম নার্স এর মধ্যে আরো দুবার রক্তের জন্য তাড়া দিয়ে গেছেন।
আটটার শিফটে একজন সিনিয়র চিকিৎসক এসেছেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। কাজিনের বিষয়টা ভালো লাগছে না। আমাকে জানালে আমি বললাম প্রত্যেক রোগের এটেনডেন্ট এর সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে গেলে ডাক্তারের জন্য রোগি দেখা বাদ দিতে হবে। যা প্রয়োজন ওনারা করলেই হলো, তুমি এটা নিয়ে টেনশন করো না।
যে কাজিনদের ঘুম ভাঙিয়ে দুটার সময়ে কথা বলেছিলাম তাদের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যে ছোট, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পদে কর্মরত আছেন। উনি সকালে ঢাকা মেডিকেলে ওনার কাউন্টার পার্টকে (নাম ধরি মমতাজ সাহেব) ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন- আমার ভাইয়ের স্ত্রী ভর্তি, একটু দেখবেন। কাজিনকে মমতাজ সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে ওনার সাথে যোগাযোগ করতে বলে দিলেন ।
মমতাজ সাহেব আমাদের খুঁজছভিলেন, ভদ্রলোক ফোন পেয়ে সাথে সাথে চলে এসেছেন ওয়ার্ডে। উনি ডাক্তারকে কি বলেছেন জানিনা, কিন্তু ডাক্তার এর মধ্যে এক মিনিটের জন্য এসে কাজিনকে বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানিয়ে গেলেন। যে কোনো সমস্যায় ওনার সাথে যোগাযোগের কথা বলে মমতাজ সাহেব আপাতত বিদায় নিলেন।
এক ট্রান্সফিউশন সেন্টারেই দেখলাম কিছু বসার জায়গা, অন্য কোথাও নেই। পনেরো মিনিটের ব্যবধানে পরপর দুবার যেয়ে রক্তের পরীক্ষা শেষ হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করায় টেকনিশিয়ান অল্প একটু রেগে গিয়ে বললেন মেশিনের কাজ, সময় লাগবে। রুগি ওটিতে আছে বলে অনুরোধ করার পর ভদ্রলোক ভিতরে যেয়ে দেখে এসে বললেন এখনো হয় নি।
সাড়ে দশটার দিকে উনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন এক ব্যাগ রক্ত হয়ে গিয়েছে , এটা নিয়ে যান। আর এক ব্যাগে সমস্যা আছে। ব্যাগের গায়ে ভুল গ্রুপ লেখা আছে। ডাক্তার যদি বলে আরো লাগবে তাহলে আমাদের জানায়েন, ওটার বদলে আপনার চাহিদা মতো রক্ত দেয়া যাবে।
সন্ধানীতে রক্তে গ্রুপিঙের কাজটা কোন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান না, বরঙ ছাত্রদেরই করতে দেখেছি। এবং এই ভুল আগেও হতে দেখেছি, আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি। এটা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে যা আছে তা নিয়ে দৌড়ালাম ওয়ার্ডে।
রোগীকে এর মধ্যে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে । পাশাপাশি দুইটা থিয়েটার। কোনটার মধ্যে ঢোকানো হয়েছে নার্সরাও বলতে পারছে না। দুটাতেই নক করে রোগীকে খুঁজে বার করে নার্সের হাতে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে বলা হলো আর এক ব্যাগ রক্তের জন্য চেষ্টা করছি ।
এই সময়ে ডাক্তার নিজেই ওটি থেকে বের হয়ে আসলেন। বাচ্চাদের গলায় যেভাবে বিব ঝোলানো থাকে, ডাক্তারের গলায় এরকম একটা কালো রঙের টেবিল ক্লথ জাতীয় পলিথিন শিট জড়ানো আছে। অপারেশন থিয়েটারের ডাক্তাররা মনে হয় এরকম অ্যাপ্রন ব্যবহার করেন।
ডাক্তার উচু গলায় বললেন- দাদু, রক্তের রিকুইজিশন স্লিপ নিয়ে আসেন।এরপর দাদু স্লিপ আনলে নিজে কিছু একটা লিখে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন- এক ব্যাগ সাদা রক্ত (প্লাজমা) লাগবে , নিয়ে আসেন। এক্ষণে বুঝলাম, দাদু আসলেই হাসপাতালের একটা পোস্ট , কাল্পনিক কিছু না।
এই অবস্থায় কোথায় সাদা রক্ত পাই? মমতাজ সাহেবকে ফোন দেওয়া হলো। উনি ট্রান্সফিউশনে যেতে বললেন, বললেন উনি ওখানে আসছেন। সাদা রক্তের জন্য লালফিতার ঝামেলা কিছুটা বেশি। বিভাগের হেড পর্যন্ত যায়। মমতাজ সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে নিজেই দুই রুম ঘুরে দরকারি কাগজে সই নিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দিলেন। সরকারি খরচ সম্ভবত ১১০০ টাকার মতো লাগলো। প্লাজমা একেবারে ফ্রোজেন, ললি আইসক্রিমের মতো। এটা কিভাবে পুশ করবে ভাবতে ভাবতে মমতাজ সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ছুটে গেলাম ওয়ার্ডে।
রক্ত বুঝিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্নমুখে অপেক্ষা করছি । মেয়ের ফুপু-ফুপা খবর পেয়ে চলে এসেছেন। ওনারা মোটামুটি অবস্থা সম্পন্ন লোক। দুজনেই ওয়ার্ডের অবস্থা দেখে হতবাক। ফুপা আমার কাজিন কে বললেন তোমার হাসপাতাল চয়েজ ভালো হয় নি। এর চেয়ে ভালো কোথাও নেয়া গেলো না? ওনার সাথে কোন তর্কে না জড়িয়ে উনাকে বললাম আপাতত এখানেই থাকুক পরবর্তীতে অন্য কথা ভাবা যাবে।
ওটির সামনে হাটাহাটি করি। দরজার দিকে চোখ পড়ে গেলো। যেই রুগির মাথায় বেনি করার মত চুল নেই তার কি হবে ভেবে চিন্তা হচ্ছে।
যেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর আন্ডারে তার ওয়াইফ চিকিৎসাধীন ছিল, কাজিন এর মধ্যে তার সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছে। উনি বলেছেন চিকিৎসা ঠিকমত চলছে। উনি নিজেও এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারতেন না।
দুপুর ১২ টার কাছাকাছি বাজে । রক্ত দিতে ভাগনার দুই বন্ধু চলে এসেছে। ওদেরকে অনুরোধ করলাম যে কিছুক্ষণ থাকো, দেখি আরো রক্ত লাগে কিনা। খুব ছটফটে যৌবনদীপ্ত দুটি ছেলে। বন্ধুর কথায় রক্ত দেওয়ার জন্য এভাবে চলে এসেছে দেখে খুব ভালো লাগলো।
১২:১৫ মত বাজে। ওটির দরজা দিয়ে একজন নার্স উঁকি দিয়ে রোগীর নাম বলে জিজ্ঞাসা করলেন- রোগির স্বামী কি আছেন? আমার কাজিন সামনে এগিয়ে গেল । সবাই শুনতে পায় এমন গলায় স্পষ্ট ভাবে নার্স জিজ্ঞাসা করলেন- জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা কি কিছু ভাবছেন? আমরা কোনো পদ্ধতি দিয়ে দেবো? কাজিনের সিক্স ও ক্লক পজিশনে ফুপা শশুর, দু হাত পিছনে। নাইন ও ক্লক পজিশনে আমি, এক হাত দূরে। কাজিন ফিস ফিস করে কি যেন বললো। নার্স বললোঃ আমরা টিউব দিয়ে দিতে পারি , তিন বছরের জন্য কোনো দুশ্চিন্তা নেই । কাজিন এবার আরো ফিস ফিস করে কি যেন বললো। নার্স মাথা ঝাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন ।
ওয়ার্ডের এই অবস্থা দেখার পরেও যদি কেউ ব্রহ্মচারি না হয় তাহলে বুঝতে হবে মানুষের চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে।
কয়েক মিনিট পর একজন নার্স বের হয়ে আসলেন। হাতে দুই ব্যাগ রক্ত । বললেন রক্ত লাগে নাই। ব্লাড ব্যাংকে ফেরত দিয়ে দেন অথবা আর কারো কাজে লাগলে তাকে দিয়ে দেন। কাজিন হতভম্ব । সকাল থেকে রক্তের জন্য দৌড়াদৌড়ি অথচ এখন রক্ত লাগবে না বলছে । অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কোন ডাক্তারই রক্ত মজুদ না রেখে রোগীকে ওটিতে নিতে চান না, হঠাৎ করে সমস্যা হয়ে গেলে তখন কি হবে ভেবে। কাজেই আমাদের রক্তের চাহিদা দেওয়া ঠিক ছিল । কাজিনকে সেই কথা বললাম।
রক্ত নিয়ে ব্লাড ব্যাংকে চলে আসলাম ফেরত দিতে। টেকনিশিয়ান প্রচন্ড জোরে একটা ধমক দিলেন- এভাবে কেন ফেরত দিচ্ছেন? আমি খুব নিচু গলায় ওনাকে বললাম- ডাক্তার জোগাড় করতে বলেছিলেন, তাই নিয়েছিলাম, এখন বলছেন লাগবে না তাই ফেরত দিতে এসেছি। উনি আবার ধমক দিয়ে বললেন এভাবে কেন দিচ্ছেন? লাল-সাদা দুটো ব্যাগ একসঙ্গে কেন রেখেছেন ? এভাবে রাখলে তো রক্ত নষ্ট হয়ে যাবে। এতক্ষনে ওনার রাগের কারণ বুঝলাম। আমি আমি আবার গলা নামিয়ে উনাকে বললাম দুঃখিত আমার জানা ছিলনা দুটা রক্ত আলাদা ভাবে রাখতে হবে । নার্স আমাকে এইভাবে একসঙ্গে দিয়েছে, আমি এভাবে নিয়ে এসেছি।
ওয়ার্ডে ফিরে ভাগনার বন্ধু দুজনকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যেতে বললাম। নিতে চাচ্ছিলো না, জোর করেই যাওয়া আসার পথ খরচ দিয়ে দিলাম । দুজনেই ছাত্র, মিরপুর থেকে যাওয়া আসার খরচ কম না।
ওটি থেকে একজন আয়া বের হয়ে এসে বললেন রোগীর নাম ধরে বললেন - ওনার লোক কোথায়? সামনে এগিয়ে যেতে বললেন বকশিশ দেন । রোগীকে ওটি থেকে ওয়ার্ডে নিতে হবে। কত দিতে হবে জিজ্ঞাসা করলে বললেন- দুইজন আছে, ৬০০ টাকা দেন। একটা ৫০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে আরো খুঁজছিলাম, আর লাগবে না বলে উনি চলে গেলেন।
পোস্ট অপারেটিভ রুম ওটির উল্টাদিকে, পাঁচ গজ দূরে । ওয়ার্ডের অন্য অংশের তুলনায় এটা বেহেশত। এখানে অনেকগুলো বেড, সামান্য কয়টা তে রোগী আছে। শুধুমাত্র সিজারের পেশেন্টদের এখানে রাখা হয়। ঢাকা মেডিকেলে ৮০% এর উপরে রোগীর নরমাল ডেলিভারি হয়। যার কারণে ওয়ার্ডের এই অংশে চাপ কম, ডাবলিঙ করতে হয় না। একটা এসি আছে, কিন্তু কাজ করে না মনে হলো। তবে ফ্যান গুলো কাজ করে।
কাজিনের ওয়াইফ অত্যন্ত নির্জীব অবস্থায় ট্রলিতে শুয়ে আছে। এবার ট্রলি থেকে বেডে ট্রান্সফার করা। ওয়ার্ড বয় আমাকে বললো- আপনি বিছানার উপরে দাঁড়ান। এরপরে পায়ের দিকে আয়া, মাথার দিকে ওয়ার্ড বয় আর কোমরের দিকে আমি ধরে আবার লবনের বস্তার মতো রোগীকে ট্রলি থেকে বেডে ট্রানস্ফার করলাম। রোগির শরীরে এখনো অ্যানাসথেসিয়ার প্রভাব রয়েছে, তার পরেও চেহারা দেখে মনে হল ট্রান্সফার ব্যথাহীন হয় নি।
ওয়ার্ডে রোগী দেখলাম দশ-বারো জন। কিন্তু নার্স পাঁচজন। এর মধ্যে দুজন নার্স বিছানায় মুখোমুখি পদ্মাসনে বসে আছেন, একজন টেবিলে বসে আছেন (চেয়ারে না) আর একজন বিছানার কোনায় পা ফেলে বসে আছেন । পার্ফেক্ট তাস খেলার আসরের পজিশন। এক পাটি তাসেরই খালি অভাব।
সাধারণত ডাক্তার ফাইলেই সব লিখে দেন, নার্সরা পড়ে বুঝে নেন। কিন্তু এক্ষেত্রে মমতাজ সাহেবের উপস্থিতি অন্য রকম প্রভাব ফেলেছে । ডাক্তার নিজে একবার এসে নার্সদেরকে ওষুধের কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, কোনটা কোনটা চালু হয়ে গেছে বললেন, আর বললেন আগামী কয়েকঘণ্টা পানিও খেতে দেওয়া যাবে না । নার্সদের দায়িত্ব ভাগ করা আছে। একজন ফাইলটা বুঝে নিলেন।
পঞ্চাশোর্ধ ডাক্তারের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে, ঘামে ভিজে আছে। সম্ভবত সকাল থেকে উনি দাড়িয়েই আছেন, বসার কোন সুযোগ পাননি। রুমে যে কয়জন রুগি দেখছি সব আজকেরই অপারেশন। ওনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।
একজন পান খাওয়া, খুব ভালো মানুষ চেহারার মোটাসোটা আয়া দেখলাম এই ওয়ার্ডে কাজ করছেন । ওনাকে দেখে অনুরোধ করলাম- খালা, পেশেন্টকে আপনি একটু দেখবেন। আমরা আপনার অবস্থাটা দেখব। উনি মাথা নেড়ে হেসে দূরে সরে গেলেন। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, উনি সেই গ্রুপে পড়েন যারা নিজে থেকে কিছু চেয়ে নিতে পারেন না
বাচ্চা , বাচ্চার বাবার কি অবস্থা বা বাচ্চা কোথায় কিছুই জানিনা। ভাগনাকে ওয়ার্ডে স্ট্যান্ডবাই রেখে কাজিনকে খুঁজতে বের হয়ে গেলাম । যেই প্যাসেজ দিয়ে ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে তে ঢুকতে হয় ঠিক তার মুখেই ২১১ নম্বর ওয়ার্ড- এন আই সি ইউ। প্রিম্যাচিওর বাচ্চাদের অধিকাংশকেই ইনকিউবেটর রাখতে হয় । তাদের জন্য এই ওয়ার্ড । ডাক্তার কাজিনের কাছে একটা স্লিপ দিয়ে বলেছেন- জরুরী ভিত্তিতে ২১১ তে ভর্তি করেন।
কাজিনকে দেখলাম ২১১ নম্বর ওয়ার্ডের ডাক্তারের সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে আছে, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। অনেক কাকুতি-মিনতিতেও কাজ হয়নি । ডাক্তার খুব কর্কশ ভাবে বলে দিলেন কোন সিট খালি নাই, ভর্তি করা যাবে না, অন্য কোথাও নিয়ে যান। (এই ডাক্তারটির অনেক দুর্নাম, পারলে উনি যেন লোকদের ধরে পেটান, এমন অবস্থা। )
গেটে কর্তব্যরত আনসারদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বললেন - কাছেই ভালো ক্লিনিক আছে, খরচ খুব কম । ৩-৪ হাজার টাকার মতো লাগবে । ওখানে ভর্তি করেন । নিরুপায় কাজিন তাতেই রাজি । আমি আটকালাম। মা একজায়গায় বাচ্চা আরেক জায়গায় এটা বাস্তব সম্মত হবে না, আমরা দুজায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে পারবোনা । (আর শুধু অক্সিজেনের বিলই দিনে তিন-চার হাজার টাকা নেবে, কোথাও কোথাও মোট খরচ দিনে ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে যায় শুনেছি।)
পিজি হাসপাতালের ভিআইপিদের জন্য আইসিইউর কেবিন দু-একটা রেখে দেওয়া হয়, বড় তদবির ছাড়া কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হল এখানেও এরকম হতে পারে। বললাম আগে মমতাজ সাহেবকে ফোন দাও, দেখি উনি কি বলেন।
তাছাড়া এখান থেকে অন্য কোনো হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাবো- এতক্ষণ সময় অক্সিজেন ছাড়া বাচ্চা বাঁচবে কি করে ?
মমতাজ সাহেব ফোন পেয়ে ছুটে আসেন। ডাক্তারের সঙ্গে কি কথা হলো জানিনা , পাঁচ মিনিট পরে বাচ্চা ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেলো। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন - বাচ্চার ওজন কত ? আমাদের জবাব - জানিনা।
- জানেন না কেন?
এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবো? এই হাসপাতালে কারো কাছে তো কিছু জিজ্ঞাসা করার উপায়। ভাবলাম একবার- বলি ওজন মাপার যন্ত্র ভুলে বাসায় রেখে এসেছি । কিন্তু গ্যাঞ্জাম না করে নরম স্বরে বললাম- ভুল হয়ে গেছে । আসলে ডাক্তার সাহেব ফাইলে কি লিখেছেন আমরা তো এত বুঝি না, ফাইল টা দেখেন, হয়তো ফাইলে লেখা আছে।
ডাক্তার ফাইল মিলিয়ে ফর্ম পূরণ করে বাচ্চাকে ভর্তি করে নিলেন, কাচের ঘরে বাচ্চা ঢুকে গেলো।
(কয়দিন থেকে যা বুঝেছি, মমতাজ সাহেব হাসপাতালে খুব উচু কোনো পদে চাকরি করেন না, ২য় না ৩য় শ্রেনীর একটা পদে আছেন। তবে কোটিপতি মানুষ। এই হাসপাতালসহ আরো কয়েকটা সরকারি হাসপাতালে উনি সাপ্লায়ার/কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন। একজন বড় মন্ত্রীর ভাতিজি জামাইয়ের সাথে একসাথে ব্যবসা করেন। খুব প্রভাবশালি মানুষ। )
মমতাজ সাহেবকে বারবার করে ধন্যবাদ জানাই। জিজ্ঞাসা করলাম সিট কি দু-একটা খালি ছিল? উনি বললেন- না, একটা বাচ্চাকে ছুটি করিয়ে দিয়ে আপনাদের বাচ্চাকে ভর্তি করালাম । আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। ডাক্তারদেরকে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি মাঝে মাঝে কসাইয়ের কাজও করতে হয় । কিছু বলার ভাষা খুজে পাইনা
৩০ ঘণ্টার উপরে ঘুমানোর কোনো সুযোগ হয়নি। গত ১৫-১৬ ঘন্টা পানি স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি । অধিকাংশ সময়েই দাঁড়িয়ে বা দৌড়ের উপর ছিলাম। পিঠে প্রচন্ড ব্যথা করছে। রাতে এখানেই থাকতে হবে। আর সবাই যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে হবে। হাসপাতালে গেটে বিছানা বিক্রি হয় । কাজিনকে পাঠিয়ে দিলাম বিছানা কেনার জন্য । এক ভদ্রমহিলার অনুমতি নিয়ে তার বিছানার পাশে মাটিতে আমি বসে পড়লাম। ভদ্রমহিলা বড় সাইজের একটা পানের বাটার মতো পুটলি বের করলেন। ভাবলাম পান খাবেন । পুটলি খুলতেই দেখি একটা মানুষের বাচ্চা। দেখেই বোঝা যায়, আন্ডার ওয়েট। মনে হয় যেন একটা বড়সড় ব্রয়লার মুরগি ড্রেসিং করে রাখা হয়েছে। কাল রাতে জন্মেছে। মহিলার নাতনি। মেয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি আছে , ভিতর বাচ্চা রাখার পরিবেশ নেই । বাচ্চা নানীর সাথে ফ্লোরে।
কাজিন বিছানা নিয়ে চলে এসেছ. ছোট বিছানার দাম দেড়শ টাকা, মাঝারিটা ১৮০ টাকা , সবচেয়ে বড়টা আড়াইশো টাকা কিন্তু সবচেয়ে বড় টা বিছানোর জায়গা করিডোরে নেই। এজন্য ১৮০ টাকা দামের টা নিয়েছে। আনুমানিক তিন ফিট বাই সাড়ে পাঁচ ফিট সাইজের বিছানা ।
ইমার্জেন্সি গেটে বিছানার দোকান
কাল রাতে মেঝেতে কোনো ফাঁকা জায়গা দেখিনি। আজকে একটু ফাকা জায়গা দেখা যাচ্ছে। কারণ সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটা অনেক রুগি রিলিজ নিয়ে চলে যায়, এই জায়গা গুলো খালি হয়। এর পরে আবার পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত বাড়তেই থাকে, কমে না।
আলোচনা করে ঠিক হলো আমি আর কাজিনের শশুর আপাতত বাসায় চলে যাই , কাজিন আর তার ও ফুপু শাশুড়ি এখন ডিউটিতে থাকবেন। সন্ধ্যার আগে/পরে আমি চলে আসবো।
একটা ফাঁকা জায়গা বের করে বিছানা বিছিয়ে ফেললাম। সমস্যা হলো রোগী ২১২ ওয়ার্ডে , বাচ্চা ২১১ তে । যদিও কাছাকাছি, তারপরেও খানিকটা ব্যবধান আছে । দুই ওয়ার্ডের যে কোনটা থেকেই যে কোনো সময়ে ডাক আসতে পারে। দু জায়গায় থাকার মতো লোকবল আমাদের হবে না। উপায় কি?
ব্যবস্থা হয়ে গেল । গেটের সামনে কর্তব্যরত আনসার দের ১০০ টাকা চা নাস্তার জন্য দেওয়া হলো। ওনারা জানালেন- বাচ্চার কোন প্রয়োজন হলে বা ডাক্তার খোঁজ করলে আমাদেরকে ২১২ তে এসে খবর দিয়ে যাবেন।
২:১৫ বাজে । কাজিনের শশুর কে নিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
ডিএমসিএইচ-এ কয়েকদিন- ৩য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:৩১