সাত মার্চ, সকাল১:৩০। শোয়ার আয়োজন করছি, এই সময়ে কাজিনের ফোন। তার সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর হঠাৎ ব্লিডিং হচ্ছে। ভদ্র মহিলা শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। রাত ১২টার দিকে ব্লিডিং শুরু হওয়ার পর পরই ডাক্তারকে ফোন দেয়া হয়েছিলো। ডাক্তার সময় নিয়ে সব শুনে জানিয়েছেন- সকাল ন'টায় উনি দেখবেন। এই মুহূর্তে কাছাকাছির কোনো ক্লিনিকে যেয়ে তেমন লাভ হবে না, সাপোর্টিং যন্ত্র বা স্টাফ কোথাও নেই।
আমরা দুজনেই কাছাকাছি এলাকায় ভাড়া থাকি, ৩০০ মিটারের মতো দূরত্ব। বাসা থেকে বের হয়ে দু ভাই মিলে আলাপ করে আরো দুজন কাজিনকে ফোন দিলাম, ওনারাও স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত। ওনারাও বললেন ডাক্তারের পরামর্শ শুনতে। এক ভাবি মিডওয়াইফ। উনি ইতস্ততঃ করে বললেন দুটা ইঞ্জেকশন দিতে পারলো ভালো হতো। বড় ডাক্তার যেহেতু বলেছে, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে।
আমি কিরপিন মানুষ। ট্যাপ থেকে ফোটায় ফোটায় সারা রাত পানি পড়ে মগ ভরে যাবার দুশ্চিন্তায় ভালো ঘুম হয় না। ফোটায় ফোটায় রক্ত পড়লেও সকাল পর্যন্ত যা ব্লিডিং হবে তাতে মা আর পেটের বাচ্চা কতটা নিরাপদ থাকবে তা নিয়ে আমার কিছুটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বললাম চলো, ঢাকা মেডিক্যালে যাই।
কাজিনের প্রতিবেশি ভদ্রলোক (উনি কাজিনের ডাক শুনে সাথে সাথে বের হয়ে এসেছিলেন) বললেন ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে ওনার অনেক অভিজ্ঞতা, কোনোটাই সুখের না। কাজিন বললো- অন্য কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়া যায় না? আমি বললাম- কয়েক লাখ টাকা খরচ করতে পারলে স্কয়ার বা ইউনাইটেডে যাওয়া যায়। এর বাইরের কোথাও আদৌ কোনো সার্ভিস পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। রাতে কোনো কোনো ক্লিনিকে একজন জুনিয়র ডাক্তার ঘুমায়, কোথাও আবার তাও নাই।
বাসা থেকে দুশ মিটার দূরে একটা মাঝারি মানের ক্লিনিক, কাজিনের সাথে ওখানে গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে ওখানে একজন মহিলা ডাক্তার আছেন। উনি শুনে বললেন এই হাসপাতালের ঐ রকম জরুরি সেবা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়াই শ্রেয়। সব বিবেচনা করে ঢাকা মেডিকেলের জন্য কাজিন রাজি হয়ে গেল।
ক্লিনিকের রিসিপশনিস্ট বললো অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে তবে ২০০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। দূরত্ব মাত্র সাত কিলো মিটার, ১২০০ টাকা নেয়া যায় কি না জিজ্ঞাসা করতে রিসিপশনিস্ট বললো না অত কম হবে না। ২০০০ টাকায় রাজি থাকলে ড্রাইভারকে ফোন করে বাসা থেকে আনাবে। অর্থাৎ আরো এক ঘন্টার ধাক্কা। ভরসা উবের।
উবের চালক খুব ভালো মানুষ। যত্নের সাথে নিয়ে আসলেন, চেষ্টা করেছেন যতটা কম ঝাঁকি লাগে তার জন্য। ২:৪৫ এ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে চলে আসলাম। পত্রিকায় পড়েছি হাসপাতালের গেটে দালাল দাড়িয়ে থাকে, রুগিকে ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেবার জন্য। সৌভাগ্য, সেরকম কিছু চোখে পড়লো না। ভিতরে ঢুকে ট্রলি খোঁজার জন্য কর্তব্যরত আনসারদেরকে জিজ্ঞাসা করলে ওনারা জানালেন গেটের ঠিক বাহিরেই ট্রলি আছে।
গেটের মুখে ট্রলি পয়েন্টে সেবা দেয়ার জন্য ট্রলি বহনকারীরা ট্রলি সহ দাড়িয়ে আছেন। বললেন- অবশ্যই নিয়ে যাব, আপনারা চাইলে খুব ভালোভাবে রোগীকে নিয়ে যাব, যেভাবে বলবেন সেভাবে নিয়ে যাবো, সব কিছু হেল্প করবো। আমাদের দিকটাও একটু দেখতে হবে । আর যদি বলেন না, তাহলে অন্য রকম ভাবে নিয়ে যাব। নিজেদের অসহায় অবস্থা ব্যক্ত করে বললাম আমরা এখানে নতুন, কিছুই জানি না বা বুঝি না, আপনারা আমাদের একটু সাহায্য করেন। আমরা আমাদের পক্ষে যা সম্ভব করব।
প্রথম কাজ ট্রলিতে কাজিনের ওয়াইফকে শোয়ানো। ট্রলি ভদ্র মহিলার তুলনায় অনেক উচু। গর্ভাবস্থায় তার পক্ষে ট্রলিতে বসা অসম্ভব । টুল বা উচু পিড়া জাতীয় কিছু লাগবে, কিন্তু তা নেই। অবশেষে ট্রলিম্যানের পরামর্শে মইতে চড়ার মত করে ট্রলির নাট বল্টুতে পা রেখে কাজিনের ওয়াইফ হাচড়ে পাচড়ে ট্রলিতে চড়ে শুয়ে পড়লো।
ট্রলিম্যান বললো টিকিট কাটতে হবে। কোথায়? গেটের পাশেই। কাজিনকে ট্রলির পাশে রেখে ট্রলিম্যান সহ কাউন্টারে টিকিট কাটতে আসলাম। আমার আগের জনের সাথে ১৫ টাকা আর ৫ টাকার ভাংতি নিয়ে বসচা চলছে। নাম এবং বয়স বলার পর ভাংতির আশা না করে , কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম। কাউন্টারের ভদ্রলোক কোন ফেরত না দিয়ে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিলেন।
ট্রলি ম্যান বল্লো ১ নম্বর রুমে যেতে হবে। এক নম্বর রুমে অবস্থা ব্যাংকের স্ট্রং রুমের মত। লোহার শিকের ওপাশে একজন লোক বসে আছেন। লেখা আছে পদবী ডাক্তার, কিন্তু দেখে সেরকম মনে হচ্ছে না। ওনাকে ট্রলিম্যান বললো নয় নম্বর লিখে দেন। উনি নয় নম্বর লিখে দিলেন।
নয় নম্বর রুমে একজন গাইনি বিষয়ে অভিজ্ঞ মহিলা ডাক্তার বসে আছেন। উনি রুগি দেখলেন না, তবে সময় নষ্ট না করে অল্প কথায় খুব জরুরী কয়েকটা প্রশ্ন করে লিখে দিলেন - ২১২ তে ভর্তি করতে হবে। ট্রলিম্যান বললো, চলেন আবার টিকেট কাউন্টারে যেতে হবে। বুঝলাম আগেরটা ছিল ডাক্তারের পরামর্শের টিকেট, ভর্তি করানোর জন্য আলাদা টিকেট লাগবে।
আবার টিকেট কাউন্টারে। আগেরবার ভালোকরে দেখা হয় নি। এবার একটু তাকিয়ে দেখলাম। তিনটা চেয়ার। তিনটা মনিটর। দুজন লোক বসে আছেন। একজন মনিটরে বাংলা নাটক দেখতেছেন আর ফিচ ফিচ করে হাসতেছেন। ট্রলিম্যান কাউন্টারের লোককে বললো- ভর্তি করতে হবে। উনি বললেন টাকা দেন।
-কতো?
-কার্ড সহ ২৩০ টাকা। কার্ড নাই, কি দিবেন দ্যান।
আমিতো ক্যাশে পেমেন্ট করবো। সরকারি হাসপাতালে কার্ডে পেমেন্ট নেয়ার কথা না। কার্ড সহ ২৩০ এর অর্থ বুঝলাম না। ভাংতি পাবো না। কাজেই পকেট থেকে গুনে গুনে ২৩০ টাকা বের করে দিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি মাত্র ১০০ টাকা নিয়ে বাকি টাকা ফেরৎ দিলেন। বিশাল এক বালাম খাতা বের করে রোগির নাম সিরিয়াল নম্বর এন্ট্রি করে একটা লম্বা ফুলস্কেপ সাইজের কাগজ আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। কম্পিউটার গুলোর কোনো কাজ দেখলাম না। মনে হয় নিজেদের পয়সায় কিনে এনে লাগিয়েছেন, যখন চাপ কম থাকে তখন নাটক-সিনেমা দেখার জন্য।
(পরে দিনের আলো ফুটলে এই জায়গা আবার ঘুরে দেখে গিয়েছি। প্রথম টিকেটের দাম ১০ টাকা। ২য় টিকেটের দাম ১৫ টাকা। ২০০ টাকা জমা দিতে হয় অ্যাটেনডেন্ট পাসের জন্য। পাস ফেরত দিলে টাকা ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু অনেক দিন ধরেই অ্যাটেনডেন্ট পাস সরবরাহ নেই। কিসে কত টাকা লাগবে এটা দেয়ালে লেখা আছে। তবে রাতের বেলা এমন জায়গায় বাল্ব জ্বালানো হয় যে ঐ লেখা দেখা সম্ভব হয় না।)
ট্রলিম্যান বললো আবার ১ নম্বর রুম। আবার সেই ডাক্তার। উনি এবার হায়ারোগ্লিফিক ফন্টে কিছু লিখে দিলেন। ট্রলিম্যান বললো ভর্তি হয়ে গেছে। পরের গন্তব্য ২১২ নম্বর ওয়ার্ড।
গেট থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ। গোটা সময়টা ট্রলিম্যান এই কথা বলতে বলতে আসলেন- তিনি দয়া করে আমাদেরকে হেল্প করছেন, এতক্ষণ সময় আমাদের সঙ্গে না থেকে আরো দুই তিনটা রোগী দেখলে সেখান থেকে কমপক্ষে ৫-৬ হাজার টাকা আয় হতো। যারা ভদ্র লোক তারা এমনকি কেউ কেউ দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। এত সময় কোনো রোগির সাথে তারা থাকেন না। আমাদের দেখে তাদের ভদ্র লোক মনে হয়েছে বলেই এত সময় দিচ্ছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
দুই জন ট্রলিম্যান ট্রলি ঠেলে হাসপাতালের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের মাঝ বরাবর এসে লিফটে করে দোতালায় এনে ২১২ নম্বরে চলে আসলেন। গেটের ঠিক মুখেই বড় বড় করে লেখা- গাইনি ওয়ার্ড। পুরুষ প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। পাশে লেখা- নন কোভিড ওয়ার্ড । অর্থাৎ যাদের কোভিড আছে তাদের জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড আছে ।এখন পর্যন্ত কেউ তো জানতে চাইল না রোগির করোনা আছে কি না। সে যাক গে, আগের কাজ আগে।
তাড়া দিয়ে ট্রলিম্যান আমাদেরকে ভিতর নিয়ে গেলেন। শুধু আমরা দুজনই ওয়ার্ডে পুরুষ না , ভেতরে আরো অনেক পুরুষ আছে। করিডোরে অনেকে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছেন, কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউ বসে আছে আছেন, কেউ দাড়িয়ে আছেন। করিডোর পার হতেই ওয়ার্ড। অনেক রোগী কাতরাচ্ছেন, নার্সরা পুরুষ ভিজিটরদের মাঝেই রোগীদের কাউকে কাউকে প্রায় উলঙ্গ করে পরীক্ষা করছেন । এই ওয়ার্ডের পরে আরেকটা করিডোর। তার ডান পাশে অবজারভেশন পয়েন্ট । ট্রলিম্যান আমাদেরকে অবজারভেশন পয়েন্টে নিয়ে আসলেন।
২১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাইরের করিডোর।
ট্রলি থেকে বেডে ট্রান্সফার করতে হবে। কি উপায়? চালের বস্তার মতো করে রুগিকে তুলে ট্রলি থেকে অবজারভেশন পয়েন্টের বেডে ফেলা হলো। এখন বাজে তিনটা। সম্পূর্ণ অপিরিচিত পরিবেশে ট্রলিম্যানদের সহযোগিতা ছাড়া এত দ্রুত এখান পর্যন্ত কোনোভাবেই আসতে পারতাম না। কাজিন ওনাদের ২০০০ টাকা দিলেন। ওনারা জানালেন আমদেরকে ওনাদের খুব ভালো লেগেছে, কাজেই ৪০০ টাকা ফেরৎ দিয়ে ১৬০০ টাকা নিয়ে চলে গেলেন।
নার্স হাতে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিলেন। ক্যাথাটার, ইউরো ব্যাগ আর সিরিঞ্জ কিনতে হবে। গেটের কাছেই ওষুধের দোকান। রওনা হলাম। ইমার্জেন্সির লিফটের কাছে দেখি এক অল্প বয়সি মহিলা, একা , সামনে সাদা চাদরে ঢাকা ট্রলি। মহিলার কান্নার শক্তিও শেষ হয়ে পড়েছে মনে হলো। ওষুধ নিয়ে ফেরার পথে দেখি উনি ফোনে আত্মীয়-স্বজনদের আসতে অনুরোধ করছেন। এখানে যারা থাকে তাদের এসব গা সওয়া। কার কাছে যেনো শুনেছিলাম দিনে ২০-২৫টা মৃত্যুর ঘটনা এখানে ঘটে। স্বজন হারাদের সান্তনা দেয়ার জন্য হাসপাতালে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ মনে হয় নেই।
ওষুধ নিয়ে এসে দেখি চিকিৎসা চালু হয়ে গেছে। ইঞ্জেকশন পড়েছে, স্যালাইন চালু হয়েছে। একজন রুগির দেখলাম হিস্টিরিয়ার মতো আছে। ঘড়ি ধরে দেখলাম, ঠিক চার মিনিট দশ সেকেন্ড পর পর চেচিয়ে উঠছে- আমাকে তোরা মরতে দিস না, আমারে তোরা বাঁচা। এখানকার পরিবেশ আমার কাজিনের ভালো লাগছে না। বললো- ভাই , এখন অন্য কোথাও নেয়া যায় না? আমি বল্লাম- হাতে লাখ পাঁচেক থাকলে চলো, স্কয়ারে যাই, পরিবেশ এর চেয়ে ভালো, চিকিৎসা এর চেয়ে বেশি হবে না। কাজিন বললো- ঠিক আছে, সকাল হোক, তার পর ট্রান্সফার করার চেষ্টা করবো।
কিছু বিশাল মোটাসোটা মহিলা এপ্রোন পরে ঘোরাঘুরি করছেন। নার্সরা গরিব ঘরের লোক, এত মোটা হওয়ার কথা না। জানা গেল এনারা এফসিপিএস ছাত্র। পেসেন্টের সঙ্গে যত রকমের উপহাস করা যায়, বিদ্রূপ করা যায় করছেন এবং এত অশ্লীল কথা বলছেন যে বিশ্বাস করা মুশকিল। নাসরা চুপচাপ সহ্য করছেন।
এরমধ্যে নার্সরা একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে। পাশের টেবিলে বসা আনসার সদস্য খুব আগ্রহ নিয়ে এসে বললেন- রক্ত যোগাড় করে দেয়া যাবে কোনো সমস্যা না। আমি বললাম - ধন্যবাদ, আমাদের রক্ত রেডি করা আছে, লাগবে না। উনি মনমরা হয়ে ওনার জায়গায় চলে গেলেন।
কাজিনকে বললাম, পেশাদার ডোনারদের রক্ত নেয়ায় কিছু সমস্যা আছে। তুমি ভাগনাকে ফোন দাও। এক ভাগনা বাঁধন (রক্ত দানকারি সংস্থ)-এর সাথে জড়িত । আরেক ভাগনার গ্রুপ রোগির সাথে মিলে যায়। কেউই ফোন ধরছে না। কাজিনের শশুর সাথে আছেন। ওনার গ্রুপ ম্যাচ করে। ওনাকে নিয়ে রওনা দেই । ট্রান্স ফিউশন সেন্টার, ব্লাড ব্যাংক এবং রক্ত পরীক্ষা পাশের বিল্ডিঙে (নাম নতুন বিল্ডিং)।
ট্রান্সফিউশন সেন্টার ২৪ ঘন্টা খোলা। রাতে ভিড় কম বলে কর্তব্যরত লোক চেয়ারে নেই। মনে হলো ঘুমাতে গেছে (পরে বুঝেছি, রাতে লোক কম থাকে, বিভিন্ন টেস্ট ওনাদেরই করতে হয়, চেয়ার এবং ল্যাব দুটাই ম্যানেজ করেন ওনারা)। দরজায় নক করতে এসে স্লিপ কাটার সময়ে ডোনারের নাম, বয়স জিজ্ঞাসা করলেন। বয়স ষাটের উপরে শুনে বললেন- হবে না। পঞ্চাশের নিচের ডোনার নিয়ে আসেন।
ফোনের পিডমিটার দেখাচ্ছে ৯০০০ স্টেপের ওপর , সাড়ে ছয় কিলোমিটারের মতো হাঁটা হয়ে গেছে। ভাগনারা কেউ ফোন ধরছে না। আনসারের সাথে কাজিন এবং তার শশুর দুজনেই কথা বলে ফেলেছেন। মাত্র ২০০০ টাকা করে ব্যাগ রক্ত । এখনই পাওয় যাবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বেশিরভাগ ডোনার নেশাখোর। অসুখের ঝুঁকি আছে। তাছাড়া নিয়মিত রক্ত দেয় বলে এদের রক্তে হিমোগ্লোবিন কম। জীবন-মৃত্যুর অবস্থা ছাড়া এদের কাছ থেকে রক্ত নেয়া যাবে না।
আত্মীয়স্বজনদের অনেককেই ফোন করা হচ্ছে কেউ ফোন ধরছে না। আজকাল নিয়মিত ভাবেই দিন রাত ৩ বা ৫ ডিজিটের অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করে রেকর্ডেড ভয়েসে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা শোনানো হয়। নিরুপদ্রব নিদ্রার জন্য পরিচিত অনেককেই দেখেছি রাতে ফোন সাইলেন্ট করে রাখতে । সম্ভবত এরকম কিছু হয়েছে
যে ভাগনার রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করে সে একটা হোস্টেলে থাকে। হোস্টেল সুপার কে ফোন দেওয়া হল। উনি ভাগনাকে জাগিয়ে দিলেন। ভোর সোয়া পাঁচটা । ভাগনা জানাল সে আসছে। এর মধ্যে আরো কয়েক দফা ওষুধের দোকান, রক্ত পরীক্ষাগার দৌড়া দৌড়ি। পোনে ছয়টা বাজে। ফজরের সময় হয়ে গেছে। প্রায় এক বছর পর মসজিদে আসলাম। আগে এই এলাকায় পানির কঠিন সমস্য দেখেছি। এখন মসজিদে পানির সরবরাহ স্বাভাবিক দেখলাম। খুব ভালো লাগলো।
ওয়ার্ডের দরজায় নূরানী চেহারার এক ভদ্রলোকের পোস্টার ; নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। চেহারা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ওয়ার্ল্ডের করিডোরে হাঁটাহাঁটি করি । অনেকগুলা জায়গায় ছোট ছোট বাবুদের ছবি বাঁধাই করে রাখা আছে। নিচে খুব বড় করে বিভিন্ন সতর্কবাণী- বাচ্চাদেরকে নিয়ে সতর্ক থাকবেন, বাচ্চা চুরি হওয়ার আশঙ্কা আছে ইত্যাদি। গাইনি ওয়ার্ড এর আশেপাশে অন্তত ৩০-০ জায়গায় এরকম লেখা দেখেছি। এর পরেও মানুষ অপরিচিত লোকের কোলে বাচ্চা দিয়ে এদিক সেদিক যায়, বাচ্চা চুরি হয়।
এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করি। নতুন এক জাতের তেলাপোকা দেখলাম। লম্বায় এক ইঞ্চির মতো হবে, কিন্তু খুব সরু। মনে হয় হাসপাতাল ভ্যারাইটি। কিডনি হাসপাটালেও এরকম একটা তেলাপোকা দেখেছিলাম, তবে ওগুলো আরো ছোটো, রঙও এর চেয়ে উজ্বল। করিডোরের সামনে হসপিটাল ওয়েস্টের নির্ধারিত জায়গা আছে, তবে বাস্কেট গুলো হারিয়ে গেছে।
সকাল ৬-৩০। ভাগনা চলে এসেছে। ট্রান্সফিউশন সেন্টার ভাগনাকে নিয়ে চলে গেলাম। নির্ধারিত ফি দিয়ে রক্ত দিয়ে আসলাম। খুব বেশি খরচ না, ব্যাগের জন্য একশ টাকা, স্ক্রিনিং-ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য সাড়ে তিনশ। মোট সাড়ে চারশ টাকা। দেড় ঘন্টা পর ক্রস ম্যাচিং এবং স্ক্রিনিং শেষে রক্ত ফেরত নিয়ে আসতে হবে। ভাগনাকে নাস্তা করাতে নিয়ে গেলাম মেডিকেলের গেটে । খাবার-দাবার যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক সস্তা। একটা সিদ্ধ ডিম মাত্র ১০ টাকা নাস্তা।
অবজারভেশন পয়েন্টের পাশের করিডরে দাড়িয়ে আছি। এর মধ্যে কয়েকবার এসে নার্স রক্তের জন্য তাড়া দিয়ে গেছে। খুব কম বয়স্ক ভদ্রলোক এসে সুন্দরভাবে বললেন এখানে দাঁড়ানো যাবে না, বাইরে চলে যান । পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে বললেন উনি হাসপাতালের লোক। আমি বললাম- আরেকটু স্পেসিফিকভাবে বলেন। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় - আপনার পরিচয় কি? উনি বললেন- আমি দাদু। দাদু? হাসপাতালে এই নামের পোস্ট আছে নাকি? আমার কথায় দাদু ভীষন মাইন্ড করলেন, তবে আবারো ভদ্র ভাবেই বাইরে যেতে বললেন। যাহোক, কাজিনকে ভিতরে রেখে আমি ওয়ার্ডের বাইরে এসে দাড়াই।
অবজারভেশন পয়েন্টের নার্সরা জানিয়ে দিলেন রোগীকে আর অবজারভেশন পয়েন্টে রাখার প্রয়োজন নেই, এখান থেকে ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করতে হবে। কিন্তু ওয়ার্ডে কোনো খালি বেড নেই এ কথা নার্সদের জানাতে ওনারা বললেন কিছু করার নেই, প্রয়োজনে ওয়ার্ডে এক বেডে দুইজন থাকতে হবে, কিন্তু অবজারবেশন পয়েন্টে আর রাখা যাবে না।
ঢাকা মেডিকেলে এটা আমার তৃতীয় দফা আগমন। দ্বিতীয়বার এসেছিলাম ২০০৫, চাকরির বাধ্যতামূলক শারীরিক পরীক্ষার জন্য। প্রথমবার এসেছিলাম ১৯৯৩/৯৪ এর দিকে, বড় ভাই অসুস্থ হয়ে ভর্তি ছিলেন। দুইবারই দেখেছি বেডে জায়গা না পেয়ে রোগীদের মেঝেতে শুতে হচ্ছে। এখন অনেক উন্নয়ন হয়েছে; মেঝেতে আর রোগীকে থাকতে হয় না । ৩ ফিট বাই ৬ ফিট সাইজের বেডে প্রয়োজনে রোগীদের ডাব্লিং করতে হয়। ঢাকা মেডিক্যালে অফিশিয়ালি বেড়ের সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। নিয়মিত ভাবেই চার হাজারের কাছাকাছি রোগি ভর্তি থাকে। তিন হাজারের মতো রোগিকে ডাব্লিং করতে হয়।
কাজিনের মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। পারলে এখনি রোগীকে এখান থেকে নিয়ে অন্য কোন হাসপাতালে ট্রান্সফার করে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, এভাবেই হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে, আমাদেরও নিতে হবে। রুগি ট্রান্সফার না করাই ভালো।
কাজিনের ওয়াইফ যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্তাবধায়নে ছিলো, কাজিন ওনাকে ফোন দিয়ে পরিস্থিতি জানালে উনি ধৈর্য ধরে সব শুনে ধমক দিয়ে বললেন- একদম ঠিক চিকিৎসা চলছে। পেশেন্টকে এই মুহূর্তে নড়ানো যাবে না।
নার্সরা এর মধ্যে অন্য রোগী নিয়ে ব্যস্ত, ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করার কথা ভুলে গেছেন মনে হয়। এর মধ্যে একাধিক বার ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার ঘুরে এসেছি। অবশেষে আটটার আগে আগে রক্তের স্ক্রিনিং-ক্রসম্যাচিং শেষে রক্ত পাওয়া গেলো। আটটার আগেই প্রথম ব্যাগ রক্ত দেয়া শুরু হয়ে গেলো। পিডোমিটারে দেখাচ্ছে ১৫০০০ স্টেপের কিছু বেশি, প্রায় ১১ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে।
আটটা বাজে। করিডোরে দাড়িয়ে আছি। নার্সদের শিফট চেঞ্জ হচ্ছে। এফসিপিএস স্টুডেন্টদের মতো গাব্দাগোব্দা না, বেশিরভাগ নার্সই হালকা পাতলা গড়নের। পোশাক দেখেই বোঝা যায়, বড়লোক পরিবার থেকে কেউ নার্সিং পেশায় আসে না। নার্সদের মাথায় দেখলাম দুই রকমের ক্যাপ- গোলাপি মতন আর সবুজ মতন। বয়স দেখে অনুমান হয় প্রথম গ্রুপ শিক্ষানবিস বা জুনিয়র, দ্বিতীয় গ্রুপরা অনেক সিনিয়র।
ভর্তির প্রায় সাড়ে পোনে ছ ঘন্টা ঘন্টা পর, নতুন শিফট শুরুর ৪৫ মিনিট পর, ৮:৪৫ মিনিটে আমাদের জানানো হলো- আল্ট্রা সনোগ্রাম করা হয়েছে, রেজাল্টে দেখা যাচ্ছে রুগির প্লাসেন্টা ছিড়ে গেছে। জরুরী ভিত্তিতে সি-সেকশন অপারেশন করা লাগবে।
ডিএমসিএইচ-এ কয়েকদিন- ২য় পর্ব
প্রথম ছবি বিডিনিউজ২৪ থেকে নেয়া, বাকি গুলো আমার তোলা।
একজন রোগির স্বজন কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায় বোঝানোর জন্য প্রথম দিনের বিবরণ বিস্তারিত দেয়া হচ্ছে। ২য় দিনের বর্ননা থেকে বাহুল্য বর্জন করে লেখা শুরু হবে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:২৯