[ এই পোস্টে টিকা বলিতে ভ্যাকসিন বুঝাইয়াছি। রয়েল ডিস্ট্রিক্টের ব্লগারদের প্রতি অনুরোধ- অন্য কিছু ভাবিয়া পোস্টটি রিপোর্ট করিবেন না । ]
প্রতিদিনই বাজারে টিকা নিয়ে নানান গুজব শুনছ। অবশ্য যে টিকার ম্যানেজমেন্টে পিপিপি এন্ড সন্স এবং বিপণনে দরবেশ এন্ড ব্রাদার্স নিয়োজিত সেই টিকা নিয়ে গুজব না হওয়াটাই অস্বাভাবিক হতো।
অক্সফোর্ডের টিকার বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ এইমাত্র এই টিকা মাত্র ৭০% কার্যকর, শতভাগ কার্যকর নয়। অভিযোগ প্রায় সত্য (অক্সফোর্ডের টিকা পূর্ণ ডোজে দিলে ৬২% কার্যকর, ৭০% না)। তবে প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে এমন কোন টিকা নেই যা শতভাগ কার্যকর। কিছু কিছু টিকা আছে যেগুলো ৯০% এর উপর কার্যকর। এগুলি অসাধারণ ভালো টিকা। যেখানটাতে কোন টিকা পাওয়া যায় না সেখানে ৫০% এর উপরে কার্যকর টিকা পেলে তা ব্যবহার করা যায়। সেই প্রেক্ষিতে অক্সফোর্ডের টিকা ব্যবহারে কোনো সমস্যা থাকার কথা না।
ফাইজার বা মডার্নার টিকা প্রায় ৯৫% কার্যকর। আমরা তাহলে ফাইজার বা মডার্নার টিকা ব্যবহার না করে অক্সফোর্ডের টিকা কেন ব্যবহার করবো?
- ফাইজারের টিকা -৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হয়। আমাদের দেশে এটা সংরক্ষন এবং পরিবহন করার কোন বাস্তবসম্মত উপায় নেই এটা বুঝতে হবে।
এই চেইন আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি কেন? এটা কি সরকারের ব্যর্থতা না?
-না। কেননা এখন পর্যন্ত আমরা এতদিন যত টিকা ব্যবহার করে এসেছি তা কখনই এত লো-টেমপারেচারে সংরক্ষণ করতে হয়নি। কাজেই আমাদের দেশে এরকম চেইন তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দেয় নি।
এখন কি করা যেত না?
-যেতো । তবে অসম্ভব বড় বিনিয়োগ করতে হতো। অনেক সময় লাগতো।
মডার্নার টিকা তো এত কম টেমপারেচারে সংরক্ষন না করলেও চলে।
-হ্যা । মডার্নার টিকা অবশ্য -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা যায়। আইসক্রিম রাখার উপযোগি ডিপ ফ্রিজে এই টিকা সংরক্ষন করা যেতো। কিন্তু ২টা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। শেলফ লাইফ এবং প্রাপ্যতা। এই টিকার শেলফ লাইফ ১ মাস। এই বিষয়টা পরে আলোচনায় আসবে। আর টিকা এখন দুষ্প্রাপ্য। আমেরিকা বা ইইউতেও টিকার সংকট আছে। এই মুহূর্তে আমাদের মডার্নার টিকা পাওয়া সম্ভব না।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এর বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ এই যে ভারত নিজেও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে না, করছে বায়োটেকের ভ্যাকসিন ব্যবহার (ব্লগেও এরকম পোস্ট দেখেছি)। এটি মিথ্যা অভিযোগ। ভারত বায়োটেক এর ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনও ব্যবহার করছে । হাতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে ভারত তাই ব্যবহার করছে। বুদ্ধিমানের কাজ করছে। আরো টিকা পাওয়া গেলে ভারত সেগুলোও ব্যবহার করবে বলে মনে হয়। প্রায় ১০০ কোটি লোককে টিকার আওতায় আনতে গেলে তাই করতে হবে।
অভিযোগ ভারতের টিকা নিম্নমানের । নিম্নমানের কথাটি বলতে গেলে অন্য কারো সাথে তুলনা করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন এর মত কঠোরভাবে ভারতের ভ্যাকসিন এর মান হয়তো নিয়ন্ত্রণ করা হয় না । কিন্তু ভারতের ভ্যাকসিন এতটা খারাপ না । সিরাম ইনসটিটিউট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান। এরা বছরে দেড়শো কোটি ডেজের মতো টিকা তৈরি করে। এদের টিকা শুধু ভারতে ব্যবহার করা হয় এমন না, পৃথিবীর অনেক দেশে ভারত থেকে ভ্যাকসিন কেনে। ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও, পেইহো এসব বড় বড় সংস্থাও সিরামের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কেনে।
টিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ এর অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া । ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলেছেন ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে পুরুষ নারীতে পরিনত হতে পারে , মানুষ কুমিরে পরিণত হতে পারে, চেহারা বিকৃত হতে পারে। ( বাংলাদেশে উত্তর কোরিয়ার কিম জং এর সমর্থক আছে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সমর্থক থাকা অসম্ভব না)। তবে আমি বলবো, তিন ডলারের ভ্যাকসিন দিয়ে যদি পুরুষ থেকে নারীতে পরিনত হওয়া যেতো তবে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মানুষ এই অপারেশন করাতো না।
লক্ষ লক্ষ লোককে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর সম্প্রতি একটি রিপোর্ট পত্রিকায় এসেছে যেখানে টিকার প্রতিক্রিয়ায় চেহারার কিছুটা বিকৃতি দেখা গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। রিপোর্টটি কতটা সত্য যাচাই করা সম্ভব হয় নি। এরকম হয়ে থাকলেও এটি ভ্যাকসিনের কারণেই হয়েছে কিনা এমন বলাটা বলা মুশকিল বলেই মনে হয়। ভ্যকসিন গ্রহণের ফলে মানুষের কুমিরে পরিবর্তন হবার কথা এখনো শুনিনি।
ভ্যাকসিন এর বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ভ্যাকসিন গ্রহণ করে মানুষ মারা যাচ্ছে। যেকোনো ফরেন অবজেক্ট শরীরে প্রবেশ করলে কিছু সাইড এফেক্ট হতে পারে, এটা স্বাভাবিক। ফোলা, ব্যথা, হালকা জ্বর এগুলো সাধারণ সাইড এফেক্ট। খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, সেপ্টিসিমিয়া এগুলো অতি রেয়ার সাইড এফেক্ট। ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু হওয়াটা অসম্ভব না। যে কোনো টিকা নিলে এগুলো হতে পারে। যে কোনো মেডিক্যাল প্রসিডিউরের ফলে মৃত্যু হতে পারে। এটা বুঝতে হবে।
আমাদের দেশে এমএমআর টিকা অনেক বছর থেকে দেয়া হয় । এটা প্রায় ৯০%এর মতো কার্যকর। এমনকি উন্নত বিশ্বেও এই টিকা দেয়ার পর প্রতি লাখে ২৫ থেকে ৩০ জন শিশু মারা যায়। সত্য এই যে এই ভ্যাকসিন না দেওয়া হলে আরো বহুগুণ শিশু মারা যেত।
ভারতে কয়েক লক্ষ লোককে এই টিকা দেওয়া হয়েছে এরমধ্যে ৫২ টি মৃত্যুর ঘটনা শোনা গেছে । আমেরিকায় প্রায় তিন কোটি লোককে টিকা দেয়া হয়েছে। এরম মধ্যে ৫০টির মতো মৃত্যুর ঘটনা শোনা গেছে। এটি বড় ফিগার না। আর যারা মারা গেছেন তারা ঠিক টিকার রিঅ্যাকশনে মারা গেছে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল। মনে রাখবেন, ট্রায়াল দেয়া হয়েছে কয়েক হাজার লোকের উপর। টিকা দেয়া হচ্ছে কয়েক কোটি লোকের উপর। কাজেই ট্রায়ালে মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও বাস্তবে ঘটতে পারে।
মুখে বলা সহজ। টিকা নিলে আমি যে মারা যাবো না এমন কি গ্যারান্টি?
-গ্যারান্টি নেই । কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিদিন এখনো সরকারী হিসেবে ১০-১৫ জনের মতো লোক মারা যাচ্ছে । আপনি যে এর মধ্যে থাকবেন না এই গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। আর টিকা নিয়ে কেউ মারা যাক এটা সরকার চাইবে না। কাজেই দু-একজন যদি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাবে বলে আশা রাখি
টিকা তো মাত্র ৬২% কার্যকর। তাহলে তো ৩৮% সম্ভাবনা রয়েই যায় কোভিড-১৯ হবার।
-তা সত্য। তবে অধিকাংশ টিকার ক্ষেত্রেই দেখা যায় যাদের ক্ষেত্রে টিকা কার্যকর হয় না তারাও অসুস্থ হলে অসুখের সিরিয়াসনেস কম হয়, মৃত্যুর ঝুকি কম হয়। কাজেই টিকা আপনার উপর পুরোপুরি কার্যকর না হলেও কিছুটা উপকার করবে।
অক্সফোর্ডের টিকার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ৬৫ বছর বয়সের উপরের লোকের জন্য এই টিকা কার্যকর না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এই দাবি করেছেন। মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে ম্যাখো অনেকের নিকট সুপার হিরো হয়ে গেছেন। ওনার অনেক ভক্ত ওনার বাণীকে অমৃত বাণী ভাবেন। ম্যাখোর কাছে এই দাবির স্বপক্ষে প্রমান চাওয়া হলে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন এর সপক্ষে তার কাছে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই।
এটি একটি অপপ্রচার। অক্সফোর্ড টিকা ৬৫ বছরের উপরের লোকদের জন্যেও কার্যকর। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা তথ্য না থাকা পর্যন্ত ৬৫ বছরের উপরের লোকের উপর টীকার ট্রায়াল দেয়া অনৈতিক। এইজন্য প্রথম পর্যায়ে ৬৫ বছর বয়সের উর্ধের লোকের উপরে ট্রায়াল দেওয়া হয় নাই। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়ার পর ৬৫ বছর বয়সের লোকের উপরেও ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে এবং টিকা কার্যকর পাওয়া গেছে।
আরেকটি অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী নিজে এই টিকা নেননি। বাংলাদেশের লোকদের গিনিপিগ বানিয়ে এই টিকার ট্রায়াল দেয়া হচ্ছে এবং এতে প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে। এটি সত্য বলে মনে হয় না। আমেরিকাতেও জো বাইডেন বা মাইক পেন্স বা ফাউসি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টিকা নেন নি । অনেক লোক টিকা নেওয়ার পরে তারা টিকা নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট ভিআইপি । এমনকি তারা কোনো খাবার খাওয়ার আগে ডাক্তার সেই খাবার পরীক্ষা করে দেখেন, এরপরে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট সেই খাবার খান। টিকার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট টিকার কার্যক্রম শুরু করবেন এমন ভাবা ঠিক না।
আরেকটি গুজব- প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ফাইজারের টিকা নিয়ে নিয়েছেন। এটি সত্য হবার সম্ভাবনা কম। টিকা জোগাড় করা এবং বাংলাদেশে নিয়ে আসা দুরূহ হবে। আর শুধু টিকা আনলে হবে না। এই টিকা পুশ করার টেকনিক আলাদা। এর জন্য আলাদা নার্সও আনা লাগবে। এরকম হলে বিষয়টি গোপন রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করি না।
টিকার উপর প্রধানমন্ত্রীর আস্থা থাক বা না থাক, তিনি বাইরে যেয়ে টিকা নেবার পরিকল্পনা নিয়েছেন বা না নিয়েছেন , টিকার উপর মানুষের আস্থা আনার জন্য এমনকি খালি ফায়ালে পানি ভরে হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টিকা নেয়া প্রয়োজন। এবং এটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার প্রয়োজন। গুজব টিকায় আগ্রহী মানুষকেও নিরুৎসাহিত করে ফেলতে পারে।
টিকার বিরুদ্ধে আরেকটি অপপ্রচার এই যে টিকায় শুকরের চর্বি আছে। ফাইজার, মডার্না এবং অক্সফোর্ড নিশ্চিত করেছে তাদের টিকায় কোনো শুকরজাত প্রোডাক্ট নেই।
আরেকটি কথা শুনছি। ভারত নাকি টিকার মধ্যে স্লো পয়জন ঢুকিয়ে দিয়েছে। তা হলে তো খুব ভালো হয়। যত চেতনার ফেরিওয়ালা টিকা নিয়েছে সবাই হাপিশ হয়ে যায়।
যারা টিকা নিতে চাচ্ছেন না তাদের কাউকে কাউকে বলতে শুনছি- করোনা চলেই গেছে, পরীক্ষাকৃত লোকদের মাঝে সংক্রমন ৩% এর কম। এমনকি ইউরোপ বা আমেরিকাতেও সংক্রমন ও মৃত্যুর হার কমে আসছে। এমনটা যদি সত্যিই হয় তবে খুব ভালো হয়। করোনা আরো অনেক কাল থাকুক এমনটা চায় এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন যে এই ভাইরাস আরো অন্তত কয়েক বছর থাকবে, স্থায়ী ভাবেও থেকে যেতে পারে। পশ্চিমা অনেক বিশেষজ্ঞ আশংকা করছেন যে আর কয়েক মাস পর আরো ভয়ংকর আকারে করোনার তৃতীয় ঢেউ দেখা দেবে। সেই হিসেবে টিকা নেয়াই মনে হয় শ্রেয় হবে।
কেউ কেউ বলছেন যে টিকা নিয়ে কি লাভ, করোনার নতুন স্ট্রেইনের বিরুদ্ধেতো টিকা কাজ করে না। ইউকে এবং দক্ষিন আফ্রিকার বিজ্ঞানীদের দুই রকম বক্তব্য কিছুটা কনফিউশন তৈরি করেছে এটা সত্য। তবে দক্ষিন আফ্রিকার বিজ্ঞানীদের দাবি যদি সত্যও হয়, তাহলেও বলতে হয় এর চেয়ে ভালো টিকা যতক্ষন না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষন এটা থেকে যতটুকু প্রটেকশন পাওয়া যায় তাই ভালো।
টিকার নামে ফটোসেশন হচ্ছে। সোসাল ডিসট্যান্স মানা হচ্ছে না । কাজেই টিকা নেবো না।
-ভিআইপিদের হাসপাতালে না যেয়ে ছোটো হাসপাতালে চলে যান। তার পরেও টিকা নেয়া ভালো হবে বলে মনে করি। যারা ফটোসেশন করে তারা টিকা হোক, মিলাদ মাহফিল হোক আর হরতাল বা হরতাল প্রতিরোধ যাই হোক না কেনো, ফটোসেশন করবে, আটকানো যাবে না।
তিন ডলারের টিকা দরবেশ বাবার কাছ থেকে পাঁচ ডলারে কেনা হলো কেনো? এই টিকা নিয়ে চুরির অংশিদার হবো না।
-৬০০০ টাকা দিয়ে বালিশ বা ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে পর্দা কেনা হলো, সেখানে মাত্র পাঁচ ডলারে টিকা কেনায় দরবেশ বাবার কত লস হলো সেটা ভাবলে আর টিকা না নিয়ে পারবেন না।
টিকা তো নার্স দিচ্ছে না। বিভিন্ন নেতারা দিচ্ছে। ওনাদের হাতে টিকা নেবো না।
-নেতারা নিজেদের মধ্যে টিকা মারামারি করুক। ওনাদের কাছে টিকা নেয়ার দরকার নাই। আপনি নার্সদের কাছ থেকেই নিয়েন।
এই টিকা আওয়ামীলীগ আবিস্কার করেছে। আওয়ামীলীগের আবিস্কার করা টিকা নেবো না।
-আওয়ামীলীগের আবিস্কার করা স্যাটেলাইট দিয়ে দিন রাত স্টারস্পোর্টস, এইচবিও, স্টার মুভিজ, জি বাংলা দেখলে যদি সমস্যা না হয় তাহলে আওয়ামীলীগের আবিস্কার করা টিকা নিলেও সমস্যা হবে না।
গুজব দূর করে ভালো করলেন। টিকা নিতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু বয়স ৪০ হয় নাই। উপায় কি?
- উপায় আছে।
রেজিস্ট্রেশনের সময়ে পুল ডাউন লিস্ট পেশা হিসেবে থেকে গনমাধ্যম কর্মি বা লাশ দাফনকারি হিসেবে নিবন্ধন করুন। ব্লগে লেখালিখি করলে নিজেকে গনমাধ্যম কর্মি বলা যেতেই পারে। জীবনে কোনো না কোনো লাশ দাফনের সাথে যুক্ত থাকলে ঐ পেশাও লেখা যায়। অথবা ধর্মীয় প্রতিনিধিও বাছতে পারেন। পেশা যাচাইয়ের ব্যবস্থা না রাখায় এরকম কাজ অনেকেই করছেন।
কিছু সমস্যাঃ
(১) surokkha ওয়েব সাইট , অ্যাপ ও রেজিস্ট্রেশন- সার্চ ইঞ্জিনে surokkha লিখে সার্চ করলে এই নামের একটা বাংলাদেশি ইনসিওরেন্স কম্পানির পেজ চলে আসে। এমনটি গুগল প্লে স্টোরে ঐ কম্পানির এই নামের অ্যাপও আছে। । এটা বিভ্রান্তিকর। নাম বাছাইয়ের আগে সংশ্লিষ্টরা একটু চেক করে দেখলেও পারতেন।
আমার বয়সি লোকেদের কাছে এইরকম একবার ব্যবহারের অ্যাপ মানে অনর্থক ফোনের স্টোরেজ মেমরি নষ্ট করা। তবে কম বয়সিরা অ্যাপ খোঁজেন। প্লেস্টোরে এখনও অ্যাপ আসেনি। আসলে ভালো হতো।
বিপুল সংখ্যক লোক ইন্টারনেট ব্যবহার জানেন না। ফোনের পুশপুল মেসেজ ব্যবহার করে বা অটোমেটেড কল সার্ভিস ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা চালু করলে ভালো হতো।
রেজিস্ট্রশনের পর কার্ড প্রিন্ট করা আমার কাছে ঝামেলার মনে হয়েছে। সব অনলাইনে করার সুযোগ যেহেতু আছে, এটাও ক্লাউডে স্টোর করা যেতো।
ওয়েবসাইট টি চালুর পর থেকেই টিকা সনদের বিষয়ে দেখাচ্ছে আপডেট আসছে-
কয়েক লক্ষ লোক প্রথম টিকা নিয়ে নিয়েছেন। এখনই ক্লাউডে এগুলো আপডেট না করা হলে পরে বড় ঝামেলা হবে।
(২) টিকার প্রাপ্যতা নির্ধারণ- কিছু পাটিগণিতিয় সমস্যাঃ
প্রথমে শোনা গেলো দেড় কোটি লোককে টিকা দেয়া হবে । পরে ঘোষনা আসলো মোট তিন কোটি চল্লিশ লাখ লোককে টিকা দেয়া হবে। দেশে পঞ্চান্ন বছরের ওপরের লোক সোয়া দুই কোটি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি প্রায় কুড়ি লাখ, বিদেশ থেকে ছুটিতে এসে আটকা পড়া শ্রমিক কয়েক লক্ষ, সামরিক বাহিনির সদস্য আড়াই লাখ, আড়াই লাখ মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন দুজন করে ধরলে পাঁচ লাখ, আনুপাতিক হারে অন্য ধর্মের পুরোহিত পঞ্চাশ হাজার, জনপ্রতিনিধি ও সম্মুখ সারির গনমাধ্যম কর্মি ধরি দু লাখ- সব মিলিয়ে আড়াই কোটির মতো।( মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন বাদে সবার বয়স ৫৫র উপর বলে ওনাদের বাদ দিয়েছি) । সরকারি কর্মচারি, ধর্মিয় প্রতিনিধি এদের কেউ কেউ ৫৫র উপরে বলে গোনায় দুবার চলে এসেছেন। সরকারের প্রাপ্যের প্রথম লিস্টে যারা ছিলেন তাদের শতভাগ টিকা নিলেও এক কোটি লোকের দু কোটি ডোজ টিকা রয়ে যায়। মৃত লোক নৌকাকে ভালোবেসে ভোট দিতে আসতে পারে, কিন্তু মৃতদের করোনার ভয় নেই, তারা টিকা নিতে আসবে বলে মনে হয় না। সরকার কি হিসেব করে প্রথম প্রাপ্যতার লিস্ট করেছিলো?
৪০-৫৫ বছরের লোকদের নতুন করে প্রাপ্যতার তালিকায় নেয়ায় আরো প্রায় আড়াই কোটি লোক যুক্ত হলো। মোট পাঁচ কোটি লোক টিকার জন্য আবেদন করতে পারবে। তিন কোটি চল্লিশ লাখ টিকা দিতে গেলে প্রাপ্যের ৬৮% লোককে টিকা দিতে হবে। এত লোক কি আগ্রহি হবে? বিশেষ করে গ্রামের দিকে (এখনো ৬০% লোক গ্রামে থাকে) টিকা নেবার জন্য লোকের আগ্রহ তেমন একটা আছে বলে শুনছি না। আশির দশকে ভ্যাসেকটমি-লাইগেশনের পর সাবজেক্টদের শাড়ি-লুঙ্গি দেয়া হতো। এখন শাড়ি লুঙ্গি কিনতে গেলে দেখা যাবে পর্দার মতো চল্লিশ পঞ্চাশ হাজারে কেন হচ্ছে। এর বদলে নগদ অর্থ প্রনোদনা দেয়া যায়।
চল্লিশের নিচের বয়সের বেশি কিছু লোক আছেন যারা ডায়াবেটিস-কিডনি সমস্যা-উচ্চ রক্তচাপ-অ্যাজমা এসব সমস্যার কারণে উচ্চ ঝুঁকিতে আচেন। এদেরও টিকার আওতায় আনা দরকার।
(৩) টিকার পরিধি, টিকার সাথে সংযুক্ত জনবল, Herd immunity - আরো কিছু পাটিগণিতের সমস্যাঃ
Herd immunity আনতে গেলে দেশের ৬০% এর উপর লোককে সুরক্ষা চক্রের আওতায় আনতে হবে। এই ভ্যাকসিন যদি ৬২% কার্যকর হয় তবে ১০০% অ্যাডাল্টকে টিকার আওতায় না আনলে এটা সম্ভব না। এই বিষয়ে সরকারের কি পরিকল্পনা তা সরকার জানায় নি। এনআইডি এখনো সব লোককে দেয়া হয় নি। এনআইডি যাচাই করে টিকা দেয়া হলে সবাইকে টিকা দেয়া সম্ভব না। কোভিড যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তা মোকাবেলায় সরকারের প্ল্যান থাকা উচিৎ।
আমাদের চেয়ে প্রায় আট গুন বড় জন সংখ্যার দেশ ভারত দিনে আড়াই লাখের মতো করে টিকা দিচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের টার্গেট দিনে কুড়ি হাজার। ৩২ কোটি লোকের দেশ আমেরিকায় নার্স আছে ৩৫ লাখের মতো । আমেরিকায় দিনে দেয়া হচ্ছে ৪ লাখের মতো টিকা। ষোল কোটি লোকের বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে নার্স আছে ১৫ হাজার, বেসরকারি হাসপাতালে আছে আরো পাঁচ হাজার। জন সংখ্যার অনুপাতে আমেরিকার একশ ভাগের এক ভাগ (ডাক্তার আছেন প্রায় ৫০ হাজার, কিন্তু ইন্টার্নশিপ শেষ হবার পর ওনারা কাউকে ইঞ্জেকশন দেয়ার কথা না)। এই জনবল দিয়ে দিনে তিন লাখ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা অতি উচ্চাভিলাসি। হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। একধার দিয়ে লোক দাড়া করালাম, তার পর গরুর ইঞ্জেকশন দেবার মতো করে দিয়ে গেলাম এটা কোন সুস্থ চিন্তা না। ইনফেকশনের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে বড় সমস্যা হবে।
বিভিন্ন হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় আর অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের অপারেশন করার কথা শোনা যায়। টিকার কাজে এরকম না শুনতে হলেই ভালো হবে।
একটি টিকার দাম ৫ ডলার বা প্রায় সাড়ে চারশ টাকা। এক জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস মাত্র দশ টাকা বা আরো কম। জীবানু নাশকের জন্য জন প্রতি খরচ দুটাকার বেশি হবার কথা না । প্রোটোকল মেনে টিকা দেয়া দরকার।
একজন নার্স হ্যান্ড গ্লাভস পরবেন, এর পর ভায়াল থেকে সিরিঞ্জে টিকা ভরবেন, হাতে জীবানু নাশক লাগাবেন, টিকা পুশ করবেন, আবার জীবানু নাশক লাগাবেন, টিকা কার্ডে স্বাক্ষর করবেন। সময় লাগে। ঠিক মতো টিকা দেয়া হলে দিনে এক লাখ টিকা দেয়া সম্ভব বলে মনে করি। মাসে পচিশ লাখ টিকা দেয়া হলে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা দিতে দু বছরের কিছু বেশি লাগবে। দিনে দু লাখ করে টিকা দেয়া হলে লাগবে এক বছরের কিছু বেশি।
মানব শরীরে টিকার কার্যকারিতা কতদিন থাকবে এটা অজানা। যদি কার্যকারিতা মাত্র এক বছর থাকে তবে সাড়ে তিন কোটি লোককে টিকা দেয়া শেষ করার আগেই বুস্টার ডোজ দেয়ার সময় চলে আসবে। নেভার এন্ডিং প্রসেস। খোলাবাজারে টিকা ছেড়ে দিয়ে সবাইকে নিজ দায়িত্বে টিকা নিতে বলা ছাড়া উপায় থাকবে না।
(৪)স্টোরেজ সমস্যাঃ ছয় মাসের মধ্যে নাকি সব টিকা চলে আসবে। টিকার শেলফ লাইফ ছয় মাস। টিকা দিতে লাগবে এক বছরের বেশি সময়। এই টিকা কি ভাবে স্টোর করা হবে স্পষ্ট না। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট। থানা এলাকা গুলোতে গরমের সময়ে দিতে পাঁচ-ছয় ঘন্টা বিদ্যুৎ না থাকার ঘটনা স্বাভাবিক। ফ্রিজ চালু না থাকলে টিকা স্টোরেজে আরো সমস্যা হবে। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
কোনো কোনো কেন্দ্রে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই, প্রতিদিন সকালে টিকা আনা হয়, টেবিলে রেখে একজন একজন করে দেয়া হয় (নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)। এখন শীতে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু এপ্রিলে দিনের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। ঐ তাপমাত্রায় সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত টিকা বাইরে রাখা হলে কার্যকারিতা কিছুটা কমে যাবার কথা । টিকার জন্য খুব বড় ফ্রিজ দরকার নেই, কয়েক শত কোটি টাকার টিকার জন্য কয়েক কোটি টাকার ফ্রিজ কেনা হলে আখেরে তা কাজে লাগবে।
(৫) শিক্ষকদের টিকা দানঃ সরকার স্কুল গুলো খুলে দেবার চিন্তা করছে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে তিন লাখের কিছু বেশি শিক্ষক আছেন। এরা সকলেই নাহয় সরকারি আইডি দেখিয়ে টিকা নেবেন। বেসরকারি স্কুল গুলোর প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষকদের কি হবে? এনাদেরও টিকার আওতায় আনা দরকার। পেশার প্রমান নেবার ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত রাখা হয় নি, এটা উপরে আগেই বলেছি।
(৬) সবার অংশগ্রহনঃ যদিও দেশের জনসংখ্যার ৫০% মহিলা, এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহনকারীদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৩০% এর কাছাকাছি। প্রয়োজনে মহিলাদের জন্য আলাদা কেন্দ্র করে হলেও মহিলাদের অংশগ্রহন বাড়ানো দরকার।
কেন্দ্রগুলোতে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের দেখছি। খেটে খাওয়া গরিব মানুষদের দেখছি না। দেশের ২০% লোক পোভার্টি লাইনের নিচে বাস করে। সংখ্যার হিসেবে-চল্লিশোর্ধ টিকার প্রাপ্য পাঁচ কোটি লোকদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি। কয়েক ঘন্টা ব্যয় করে এরা টিকা দিতে আসবে এমন সম্ভাবনা কম। বিভিন্ন মহল্লায়/ওয়ার্ডে ক্যাম্প করে, হাতের ছাপ মিলিয়ে অন স্পট রেজিস্ট্রেশন করে এবং টিকার বিনিময়ে টাকা দিয়ে এদের টিকায় আগ্রহী করা যায়। মনে রাখতে হবে, এরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে । অসুস্থ হলে প্রাইভেট হাসপাতালে দেখানোর অবস্থা এদের নেই।
(৭) রমজানের প্রস্তুতিঃ টিকা নিলে রোজা ভেঙে যাবে এই ধরণের ধারণা অনেকেরই আছে। রোজার মধ্যে টিকাদেয়ার প্রক্রিয়া কি ভাবে সমান গতিতে চালু রাখা যায় সে বিষয়ে এখন থেকে সরকারের প্রস্তুতি নেয়া দরকার।
পরিশেষে বলবো সবাই টিকা নিন। তবে অনুগ্রহ করে টিকা নেবার পরেও মাস্ক ব্যবহার এবং হাত ধোয়ার অভ্যাস ছাড়বেন না ( টিকা গ্রহণকারি নিজে করোনা থেকে নিরাপদ থাকলেও তার কাছের লোকের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারেন )।
আমেরিকাতে ৬৫ বছরের উপরের লোকেরা টিকা পাচ্ছেন। ইইউতে আশির ওপরের লোকেরা। আমাদের দেশে চল্লিশের উপরে হলেই পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা বড় সুযোগ।
ভবিষ্যতের পৃথিবী টিকা পাওয়া আর না পাওয়া এই দুই দলে ভাগ হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সৌদি আরব বলেছে যে টিকা ছাড়া ওমরাহ করতে দেবেনা। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে টিকা না থাকলে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল করা ভবিষ্যতে সম্ভব নাও হতে পারে। টিকা নিন, এগিয়ে থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৪৭