(এই পর্বেও ভৌতিক কিছু নেই। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমি গ্রামে কি করছিলাম। সেই কৌতুহল গুলো আগে থেকে মিটিয়ে রাখছি। যারা ভৌতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী না, তাদের অনুরোধ করবো এই পর্ব বাদ দিয়ে যেতে । পরের পর্বে কিছুটা ভৌতিক ঘটনা থাকতেও পারে। )
মুহিব আমার আপন জেঠাতো ভাই। বয়সে আমার চেয়ে সামান্য একটু বড়; তবে অভাবের কারণে শরীরে গ্রোথ কম, আমার চেয়ে ছোট দেখায়। ভাইদের মধ্যে এর সাথেই আমার ওঠাবসা সবচেয়ে বেশি। সকাল নয়টার মধ্যেই মুহিব এসে উপস্থিত। আমাদের বাড়ি থেকে গ্রামের দূরত্ব প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ, কাজেই মুহিবকে সূর্য ওঠার পরে পরেই রওনা দিতে হয়েছে। সকালবেলা খাওয়া দাওয়া করে একটু জিরিয়ে বাবা-মায়ের সাথে জরুরী কথা বার্তা সেরে আমরা এগারোটার দিকে বের হয়ে পড়লাম, দুপুরের খাওয়া গ্রামে ।
তিরিশ বছর আগের উত্তরবঙ্গের গ্রাম এমন কোন আকর্ষণীয় জিনিস ছিল না। এখানে প্রেমপত্র লেখার মতো কেউ নেই, বেশিরভাগ মেয়েরই স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। কলেজে পড়ুয়া যে দুই একজন আছে তারা সম্পর্কে হয় ভাতিজি, না হয় ভাগ্নি না হয় নাতনি-পুতনি। নোয়াখালী কুমিল্লার গ্রামগুলোতে সেই সময় বিদ্যুৎ থাকলেও উত্তরবঙ্গের গ্রামে কেনো থানা সদরে ও সেই সময়ে সরকারি অফিসের বাইরে বিদ্যুৎ খুব একটা ছিল না।
গ্রামের শৌখিন লোক শরীফ চাচা। ওনার বাসায় একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল, ব্যাটারীতে চলে । সপ্তাহে দুই দিন করে থানা সদর থেকে ব্যাটারি চার্জ দিয়ে আনতে হতো। যারা ব্যাটারীতে টেলিভিশন দেখেন নাই তারা জানেন না এই বস্তু কি জিনিস। টেলিভিশন দেখছেন, একটু পরেই টেলিভিশনের স্ক্রিন ছোট হওয়া শুরু করল। ক্রমশ স্ক্রিনের চারপাশে কালো হতে হতে একসময় দেখা গেল যে একুশ ইঞ্চি টিভির ভিজিবল স্ক্রীন মাত্র আট-দশ ইঞ্চি , তারপরে ছবি নেই হয়ে গেল।
সেই সময় বিটিভি ছাড়া আর কোন টেলিভিশন চ্যানেল ছিলো না। ঢাকায় গামলা আসা শুরু হয়েছে কেবল। তবে বিটিভির অনুষ্ঠান খুব ভালো মানের ছিল। এমনকি খবরের মানও ভাল ছিল। সিরাজুল মজিদ মামুন, রোকেয়া হায়দার, আমিনুল হকের মতো ভালো ভালো খবর পাঠক খবর পড়তেন। বিটিভির সাপ্তাহিক নাটক গুলো খুব ভালো মানের হতো। তো, দু এক দিন ব্যাটারির টিভি দেখে আমি আর আগ্রহ পাই নি।
অধিকাংশ বাড়িতেই মাগরিবের নামাজের পরে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়া হতো, এশার নামাজের পরেই ঘুম। কেবল শরিফ চাচার বাসায় রাত নটা পর্যন্ত টেলিভিশনের শব্দ। শীতের রাত, সাড়ে সাতটার মধ্যে এশার নামাজ শেষ। অত্যন্ত নিস্তরঙ্গ জীবন। করার মতো কিছু নেই। ইন্টারনেটের নাম তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জানে না। সাথে বই ছিলো মাত্র কয়েকটা । সময় কাটে না ।
বিকেলবেলাটাতে ইউনিয়ন সদরের বাজারে যাই। মুহিবের দোকানে বসে থাকি। মুহিবের একটা ঘড়ি-রেডিও সারাইয়ের দোকান আছে, ওর চলে যায় (মুহিব তখনো বিয়ে করে নি, এখন নানা হয়ে গেছে)। মাঝে মাঝে পাশের ডাক্তার জ্যাঠার বাসায় যাই। ঐ এলাকায় মাত্র দুটো বাসায় দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। জ্যাঠাতো ভাই পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছেন। সেজন্য ইত্তেফাক রাখেন । ইত্তেফাকের দাম পঞ্চাশ পয়সা থেকে বেড়ে দু টাকা হয়েছে। মাসে ষাট টাকা খুব কম না। তবে ঢাকা থেকে পেপার আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়।
মুহিবদের জীবনটা বড় কষ্টে কেটেছে। মুহিবের বাবা মুহিবের জন্মের পরপরই মারা যান। গ্রামে প্রচলিত কাহিনী এই যে- উনি বান মারা কাটাতে পারতেন; কিন্তু কাউকে বান মারতেন না। তো একবার এরকম ক্লায়েন্টের অনুরোধে বান মারা কাটানোর জন্য উনি ঘর থেকে বের হচ্ছেন এই সময় ওনার বড় ছেলে ( মুহিবের বড় ভাই )এসে ওনাকে বাধা দেয়। বান কাটানোর কাজ নাকি এতো সাংঘাতিক যে অসম্পূর্ণ রাখলে ওটা উল্টো রিএকশন হয়ে নিজের উপর আসে। সেই কারণে মুহিবের বাবা মারা যায়।
আমি অনেকজনকে জিজ্ঞেস করে এই ভার্সনই পেয়েছি। আমার ধারণাআমার ওই বড় আব্বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সেই সময় গ্রামের শিক্ষিত লোক মাত্র পাঁচ-ছ জন ছিলেন। তারাও শহরে থাকতেন। ঘটনা বোঝার মতো কেউ ছিলো না। গ্রামের কুসঙস্কারাচ্ছন্ন লোকজন এই বান মারার ঘটনায় বিশ্বাস করে।
মুহিবের একদম বড় ভাই তেমন একটা লেখাপড়া করতে পারেন নি। মুহিবের ইমিডিয়েট বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েট ফেল। মুহিব নিজে ক্লাস এইট এর পরে আর পড়াশোনা করতে পারেনি। তবে মুহিব self-made ছেলে। রেডিও ঘড়ি এসবের মেরামতি শিখে নিয়েছে। হাতের কাজ খুব ভালো। দিন চলে যায়। তবে কিছুটা অসৎ সঙ্গে পড়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই ফেনসিডিল খোরদের সঙ্গে বসে নেশা করত। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ফেনসিডিল খুব সহজলভ্য ছিল। ঢাকায় যদিও ৮০-১০০ টাকা বোতল, ঐ এলাকায় ১৫-২০ টাকায় পাওয়া যেতো।
এর মাঝে আমার কলেজের ক্লাসমেট কামরুজ্জামান এবং ওয়াজেদ এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই ( কামরুজ্জামান পরে ২০০০ সালের দিকে ক্যান্সারে মারা যায়। কামরুজ্জামানের বাবা আমার বাবার চেয়ে বয়সের প্রায় কুড়ি বছরের বড় হলেও দুজনের মধ্যে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল)। কামরুজ্জামান একই থানায়, ওয়াজেদ নয় কিলোমিটার দূরের পাশের থানায় থাকে। সপ্তাহে দু তিনদিন কামরুজ্জামান আর ওয়াজেদ (সাথে ওয়াজেদের বড় ভাইয়ের শ্যালক) শালবনে মটরসাইকেল নিয়ে চলে আসে। আমরা চারজন মিলে টুয়েন্টি নাইন খেলি।
যতক্ষণ তাসের ফোটা দেখা যায় ততক্ষণ খেলা চলে। একদিন কামরুজ্জামান বলার চেষ্টা করেছিল --ভাই এদিকে হাতি বের হয় আমরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। গত ৭০-৮০ বছরে এদিকে কেউ হাতি দেখেনি। কামরুজ্জামান বলার চেষ্টা করছিলো এটা সত্যি কারের হাতি না, অশরীরী হাতি। তা নিয়ে আমরা খুব ঠাট্টা তামাশা করেছিলাম।
ওয়াজেদের বাবা কাজি সাহেব। উনিও বাবার বন্ধু স্থানীয়। ওয়াজেদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। গ্রাম দেশে এটা খুব স্বাভাবিক। তো ওয়াজেদকে একদিন বললাম - চল তোর হবু শশুর বাড়ি ঘুরে আসি। ওয়াজেদের জবাব ক্যানরে? আমার শালিদেরও কি চিঠি দিবি নাকি? চিঠির খবর এদিকেও চলে এসেছে। বড় হতাশ হই। কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে সেই কথা ভাবতে থাকি।
তো মোটামুটি এভাবেই আমার গ্রামের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। অত্যন্ত বোরিঙ জীবন।
তৃতীয় পর্বঃ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১:২৮