মাগরেবের আজান হবে হবে, তাড়া হুড়ো করে বাড়ি ফিরছি।পথে সোবহান স্যার পাকড়াও করলেন-- তোমার ইংরেজি তো আগের চেয়ে অনেক ইমপ্রুভ করেছে। তবে বানানের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। সোবহান সার এইচএসসিতে ইংরেজি পড়াতেন। হঠাৎ করে এই কথা কেন বললেন বুঝতে পারলাম না।
একটু এগুতেই শেলী ম্যাডাম ডাকলেন-- এদিকে আয় । মাইকেল ইংরেজিতে কবিতা লিখেছিল , সুবিধা করতে পারেনি; পরে কিন্তু বাংলাতেই ফিরে আসতে হয়েছিল। এটা মনে রাখবি । ৪০০ গজ পথ পেরুতে একে একে রাশেদ স্যার এবং সজিব সার পাকড়াও করলেন। হাতের লেখা ভালো হওয়া, কাটাকাটি না করা বা দুই লাইনের মাঝখানে গ্যাপ ঠিক করার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।
কলেজ ছেড়েছি বছরের কিছু বেশি হবে তো কম না। হঠাৎ সার-ম্যাডামদের এত খবরদারির কারন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। যা হোক, আপাততবড় চিন্তা মাগরিবের আজানের আগে বাসায় ঢুকতে হবে। যত বাহাদুরই হই না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি তো কি হয়েছে, যতক্ষণ বাপের হোটেলে খাচ্ছি ততক্ষণ বাপের আইন মেনে চলতে হবে, সারাদিন যে চুলোয় থাকি না কেনো, মাগরিবের আজানের আগে বাসায় ফিরতে হবে।
মাগরিবের নামাজের পর একটা ডিম সেদ্ধকে গোলমরিচ মাখিয়ে সাইজ করছি, এই সময় বাবার ডাক। সার্টিফিকেটের নাম ধরে ডাক দিয়ে বলছেন এই দিকে আসেন। বাবা আপনি করে বলছে এর মানে অবস্থা সুবিধার না। হঠাৎ কী হলো? কী এমন অপকর্ম করলাম? যাহোক বাবার শুরু করলেন - আমি এখন কিছু করছি কিনা কোন চাকরি-বাকরি পেয়েছি কিনা, উপার্জন করা শুরু করেছি কিনা এইসব দিয়ে আমি হতভম্ব । বাক্যহারা ।
রাজনৈতিক দলগুলোর খেলাধুলার সিডিউল মেলাতে যেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। হল খালি করে দিতে হয়েছে। ঢাকায় আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকার সুযোগ ছিলো, আগ্রহ ছিল না। সাত আট দিন হলো বাড়ি ফিরেছি। দেরি করে শোয়া, দেরি করে ওঠা, কিছু খেয়ে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, তাস পেটানো, দুপুরে বাইরে খেয়ে নেওয়া, আবার তাস পেটানো, সন্ধ্যের আগে বাসায় ফেরা- এটাই এখন আমার রুটিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এটাই সুবিধা, পড়াশোনা করতে আর কেউ বলে না। এর মাঝে হঠাৎ বাবার এই ইন্টারভিউ এবং উল্টোপাল্টা প্রশ্ন। কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
বাবা বুক পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। কাগজটা দেখার সাথে সাথে আমার হৃদপিণ্ড উল্টাপাল্টা রক্তপাম্প করা শুরু করে দিলো। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন -এটা চিনতে পারেন ? আমি নির্বাক । এই জিনিস বাবার হাতে চলে আসবে এটাতো আমার কল্পনাতেও ছিলো না। বাবার দ্বিতীয় প্রশ্ন - কয়জনকে এই জিনিস দিয়েছিলেন?
আমার অবস্থা আরো খারাপ। অর্থাৎ একাধিক জায়গা থেকে বাবার কাছে রিপোর্ট আসছে। পছন্দ হয় না ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে বাবার কাছে রিপোর্ট করতে হবে?
বাবার পুনরায় জিজ্ঞাসা আমার জানতে হবে- কতজনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তৃতীয়বার জিজ্ঞাসার পরে আমার জবাব ছয়জন। বাবার ভর্ৎসনা সাবাস ছয়টার মধ্যে ছয়টাই ফেরত এসেছে। আপনার সাকসেস রেট হানড্রেড পারসেন্ট। চাকরি বাকরি কিছু করছেন না, ছটা প্রেম করার শখ। বিয়েও কি ছটাই করার ইচ্ছে? বউদের ও কি বাপের হোটেলে এনে রাখবেন? প্রেমপত্র ইংরেজিতে লেখা হলো কেন? এত বানান ভুল। ভাষা তো মরি মরি। নিজের লেখা ? না কপি করা?
বাবার কাছে কি করে বুঝাই- হলের বন্ধুদের কাছে তাদের প্রেমের কত নিবিড় বর্ণনার কথা শুনতে শুনতে প্রেমহীন জীবনের প্রতি ঘেন্না চলে এসেছে। বান্ধবীদের সাথে হলের বন্ধুদের কত রোমান্টিক সম্পর্কের গল্প শুনি! ইংরেজির ইয়ারমেট জামাল তার বান্ধবীকে প্রথম চুম্বনের পর একটা এক্সপায়ার্ড ১০ টাকার লটারির টিকেট দিয়ে এসেছে; তার প্রথমে চুম্বনের অভিজ্ঞতার কত রোমান্টিক বর্ণনা প্রতিদিন শুনতে হয়। বাবাকে এগুলো কি করে বুঝাই?
আর কতো দিন মেরা নাম্বার কব আয়েগা - বলে হা হুতাশ করবো? যোসেফিন কে লেখা নেপোলিয়নের চিঠি, বা অজানা প্রেমিকাকে লেখা বিটোফেনের চিঠি এরকম আরো অনেক চিঠি থেকে টুকলিফাই করে, বাজার থেকে কেনা ফুল আর প্রজাপতির ছবি ওয়ালা খামে, নীল কাগজে চিঠি লিখে আশপাশের পছন্দ করা যায় এমন কলেজপড়ুয়া ছয় জনকে দিয়েছি, গত দুদিন আগে। যদি একটাও ভাগের ভাগ্যে লাইগা যায়! রিজেক্টেড হবো এটা ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু চিঠি বাবার কাছে ফেরত আসবে সে কথা তো ভাবি নি।
যা হোক, বর্তমানে ফিরে আসি। বাবার জিজ্ঞাসা- তোমার বয়সের ছেলে প্রেমপত্র লিখতে পারে, এটা স্বাভাবিক; কিন্তু একসঙ্গে ছয় জনের সাথে প্রেমকরা তোমার কি ইমমোরাল মনে হয়না? আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসায় বুকে ভরসা পাই। মৃদু প্রতিবাদ জানাই। আমি মোটেও ছয়টা প্রেম করিনি। ছয়জনকে চিঠি দিয়েছি ।রেসপন্স কয়জন করবে জানা ছিল না। একাধিক রেসপন্স পেলে আগে আসলে আগে ভিত্তিতে এগুনোর ইচ্ছে ছিলো।
বাবার স্বগতোক্তি- ছেলের কনফিডেন্সের বড়ই অভাব। এরপর আমাকে বললেন- স্ত্রী চরিত্র সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে। একজনকে চিঠি দিলে হয়তো শুধু রিজেকশন আসতো; কিন্তু এখন ছয়জনকে চিঠি দিয়ে ছয়জনকেই ক্ষেপিয়ে দিয়েছো। তোমার কথা এলাকার অন্য মেয়েরাও জেনে গিয়েছেবলেই মনে হয়। এই এলাকায় তোমার প্রেমের কোন ভবিষ্যৎ দেখিনা। মুহিতকে খবর দিয়েছি। কাল সকালে চলে আসবে। ব্যাগ গুছিয়ে নাও। কাল দুপুরের খাওয়া গ্রামেই হবে। যাচ্ছ, ধান বিক্রি না করে ফিরে আসবেনা । আশাকরি এর মধ্যেই তোমার বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে।
আমার ভৌতিক অভিজ্ঞতার সূচনা পর্ব। ঘটনা প্রায় তিরিশ বছর আগের। আরো দুই বা তিন পর্ব হবে। কাল এক বা একাধিক পর্ব দেবার ইচ্ছে আছে।
আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ২৫
দ্বিতীয় পর্বঃ কাটে না সময় যখন আর কিছু তে, টুয়েন্টিনাইন খেলাতেও মন বসে না
তৃতীয় পর্বঃ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪০