৫ই আগস্ট আওয়ামী রেজিমের পলায়ন বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন পরবর্তী দেশে এক প্রকার ক্ষমতার ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, এটা আমরা বাংলাদেশীরা সবাই কম বেশি জানি । ছাত্রছাত্রীরা এই ক্ষমতার শূন্যতা পূরণ করার জন্য সেই ক্ষমতার সিংহাসনে বসিয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসকে । দেশে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার । সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস যখন প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করছেন, তখন বাকি উপদেষ্টার পদগুলো পূরণ করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন পেশার অনেক নামী বরেণ্য যোগ্য ব্যক্তিত্ব দ্বারা । এমনকি যে ছাত্র আন্দোলন স্বৈরাচারী আওয়ামী রেজিমকে ক্ষমতার লোভ থেকে সরাতে পেরেছে, তাদের মধ্যে দুইজন প্রতিনিধিও সেই সরকারের উপদেষ্টা পদে আসীন হয়েছেন ।
প্রাথমিক আলোচনার পর এখন আসি মূল আলোচনায় । আজকে ২৬ই আগস্ট । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলের আজকে ২১ দিন । কিন্তু উপরের ছবিটি দেখে আপনি হয়তো কিছু অনুমান করতে পেরেছেন । স্বৈরাচারী আওয়ামী রেজিম ক্ষমতায় ছিল টানা ১৭ বছর । এই ১৭ বছরে তাদের প্রভাব গাছের শাখা উপশাখার মত ছড়িয়ে পড়েছে সরকারী বেসরকারী সকল স্তরে । আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারী বেসরকারী পেশাজীবী, ছাত্রছাত্রী ছাড়াও সাধারন জনগণ - সর্বত্র এই আওয়ামী রেজিমের দ্বারা প্রভাবিত ছিল । একটানা ক্ষমতায় বসে থাকার কারণে ডালপালার মত হতে থাকে সুবিধাভোগীদের দলভারী । লীগের মধ্যে আওয়ামী লীগ নামধারী ছাড়াও ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিকলীগ ইত্যাদি আরও কত কত নামে আওয়ামী রেজিমের পাল্লা বেশ ভারী ছিল । যার পতন ঘটে হাজার হাজার নিরীহ ছাত্রজনতার প্রাণত্যাগ এবং আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে ।
কিন্তু আওয়ামী রেজিমের দোসররা যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভালো চোখে দেখবে না সেটা জানাই ছিল । এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী দোসররা ফন্দি আঁটে কিভাবে বা কি কর্মকাণ্ড হাতে নিলে সাধারন জনগণ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর ভরসা হারাবে আর মনে মনে ভাববে আগেই তো ভালো ছিলাম । তাদের প্রথম প্ল্যানিং (৫ই আগস্টের পর থেকে) ছিল ধর্মীয় কোন্দল বাধানো । বিশেষ করে, এমন কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া যাতে এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রতি নষ্ট হয় । ঐ সময় আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান কিংবা আত্মগোপনে চলে যান কিন্তু পালাতে পারে না ছাত্রলীগ সমর্থনকারী কর্মীরা । তাদের দিয়েই এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করার পায়তারা হয় । প্ল্যান অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপসনালয় অর্থাৎ মন্দিরগুলোতে হামলা করে মূর্তি কিংবা স্থাপনা ভাঙচুর করে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর দোষ চাপাতে পারলেই ধর্মীয় দাঙ্গা বেধে যাওয়া খালি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে । ডিজিটাল দুনিয়া, এখানে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টেলিগ্রাম, লিংকডইন ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম এই ছাত্র জনতার কাছে পুরোপুরি সহজলভ্য এবং জনপ্রিয় । কিভাবে জানি এই সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী রেজিমের এই প্ল্যান ফ্ল্যাশ হয়ে যায় । মুসলমান ছাত্র জনতা এমনকি মাদ্রাসার ছাত্ররাও দলবেধে পালাক্রমে মন্দির পাহাড়া দিতে শুরু করে ২৪ ঘণ্টা ধরেই । এর পরও কয়েক জায়গায় মন্দির ও স্থাপনা ভাঙচুর হয়, তবে শোনা যায় সেটা আওয়ামী রেজিমের সাপোর্টকারী জনতা যারা হিন্দু ছিল তাদের উপর আক্রমন আসে, এখানে ধর্মীয় ইস্যু ছিল না । যাই হোক, এভাবেই হিন্দু মুসলমানের সম্প্রিতি তাদের এই প্ল্যান এখানেই নস্যাৎ করে ।
হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে দেশে বাড়তে থাকে চুরি ডাকাতি । বলা নেই কওয়া নেই, রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এক যোগে এই ইস্যুর জন্ম হয় । এই সকল ডাকাত শ্রেণীর অনেকেই ধরা পড়ে যান ছাত্র জনতার কাছে । তাদের অনেকেই স্বীকার করেন, তারা আওয়ামী রেজিমের সমর্থনকারী নেতার কথায় এই কাজ করছেন, আবার কয়েকজন যে ছাত্রলীগের সমর্থক সেই তথ্যও বেরিয়ে আসে । এই ডাকাতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা এক ধরনের ত্রাসে আক্রান্ত করে সকলকেই ।এর প্রমাণ মেলে মহল্লা মহল্লায় মসজিদে রাতের বেলায় মাইকিং করে সকলকে সতর্ক করা কিংবা রাত জেগে ডাকাত পাহাড়া দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে । কিন্তু সুকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ তাদের এই প্ল্যানিং কে সফলতার মুখ দেখতে বাধাদান করে ।
এই ঘটনার পরবর্তীতে আবারও আরেকটি দুষ্ট প্ল্যানিং করা হয় । আওয়ামী সাপোর্টকারী কিছু হিন্দু নেতা ও ভারতীয় বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ার ইন্ধনে শাহবাগে নেমে আসে এ দেশীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক বিশাল জনতা । তারা শাহবাগে এসে দাবী জানাতে থাকে তাদের মন্দির ভাঙচুরকারী চক্রকে প্রতিহত করার । খুবই যৌক্তিক দাবী । কিন্তু তখনও মুসলমান ছাত্র জনতা মন্দির পাহাড়া দিয়েই চলছিল । এদের অনেককেই টিভি মিডিয়ার সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, যাদের অনেকেই ঠিক ভাবে নিজের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত বলতে পারছিল না । তবে এই একত্রিত হয়ে দাবী পেশ করার যে প্রক্রিয়া, সেটা ছিল এই নতুন বাংলাদেশ যাকে কিনা বলা চলে বাংলাদেশ ২.০, সেটার একটি খারাপ প্রবাহ তৈরি করা । এর পরবর্তীতে নতুন সরকারকে জিম্মি করে একের পর এক দাবী উত্থাপনের যে ধারা এখনও চলমান, তার শুরু এখান থেকেই । পরিশেষে দ: মুহাম্মদ ইউনুসের ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বলা কথা, "তোমরা হিন্দু মুসলমানের আলাদা অধিকার চেও না, তোমরা মানুষের অধিকার চাও", এর মাধ্যমে এই প্ল্যানিংও ভেস্তে যায় আওয়ামী রেজিমের সমর্থনকারী এই সকল মুখোশধারীদের ।
একের পর এক প্ল্যানিং ভেস্তে গেলেও নতুন নতুন প্ল্যানিং আসতেই থাকে । যেমন এর একটি ছিল আওয়ামী রেজিমের সমর্থনকারী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের দ্বারা অন্যান্য বিচারপতিদের নিয়ে গোপন মিটিং এর ডাক, এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কে অবৈধ ঘোষণার পায়তারা । সেই ষড়যন্ত্রও ফাঁস হয়, ছাত্র জনতা এই ষড়যন্ত্র রোধ করে । আরেকটি ছিল ১৫ই আগস্ট কে ঘিরে সারাদেশের আওয়ামী রেজিম সমর্থনকারী নেতা কর্মীরা প্রতিবিপ্লব করতে পারে অর্থাৎ পালটা আবারও আক্রমন করে দেশকে অচল করতে পারে, এমন একটি ষড়যন্ত্রও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে নস্যাৎ করে ছাত্র জনতা । কিন্তু আওয়ামী রেজিমের সমর্থনকারী সুশীল শ্রেণী এসব দেখে কিছু করতে না পেরে তারা মন খারাপ করতে থাকেন, হতাশ হতে থাকেন, এরই ধারাবাহিকতায় তারা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে জপ করতে থাকে, "এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?" দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে নেগেটিভ ইস্যুগুলোকে হাইলাইট করে তারা জুড়ে দেয় এই বিশেষণ । আসলেই অসহায় ব্যক্তিবর্গ তাদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ আর কিইবা করতে পারে ।
(বাকিটা দেখুন এই লেখার ২য় পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১২:০৭