বসার ঘরটা বেশ এলোমেলো, তবে চমৎকার। অন্যান্য ধনী মানুষের বসার ঘরের মত দামী-নোংরা জিনিস দিয়ে ভরা নয়।দেয়ালে শিশু কিউপিডের একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি।দেখেই মনে হচ্ছে, সে আমার গায়ে তীর ছুড়েই খিলখিল করে হেসে উঠবে।
এককোণায় একটা একুরিয়াম, ভিতরে একটা কচ্ছপ আর একটা ব্ল্যাক স্যালমন।ঠিক উপরে একটা ফ্যামিলি ফটো দম্পতি আর একমাত্র ছেলের।
তারমানে আমাকে এই ছেলেটিকে পড়ানোর জন্য ডাকা হয়েছে।আমি ২ ঘন্টা ধরে ড্রয়িংরুমে বসে আছি।দু'টা কফি খেয়ে ফেললাম,কারো দেখা নেই!
তাড়াহুড়ো করে একজন আতংকিত ভদ্রমহিলা রুমে ঢুকলেন।দেখতে অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মত।
:মেহরাব, ভালো আছো?অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল।কিছু মনে করো না।আমরা তোমাকে ঘন্টা হিসেবে পেমেন্ট করবো!
:এইযে ২ ঘন্টা বসে থাকলাম,তার জন্যও?
:Sorry, I didn't want to hurt your ego. আমি তোমার সম্পর্কে সব বেশ জানি।ফেসবুক এবাউট থেকে পড়েছি।আসলে "আবিদ" তোমায় পছন্দ করেছে।তুমি তার ঘরে যাও।সে তোমায় পছন্দ করলে, তুমি তাকে পড়াবে।
:তারমানে আবিদ আমার ইন্টার্ভিউ নিবে?আমি পড়ানো শুরুর আগে ছাত্রের ইন্টার্ভিউ নিই,পছন্দ হলে পড়াই; নয়তো নয়।
:প্লিজ,মেহরাব! আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।তুমি তার ঘরে যাও।আমার ছেলেটা অন্য রকম।
:আপনার ছেলে কি "special child"?
ভদ্রমহিলা এবার কাঁদতে শুরু করলেন।
:আসলে আবিদ এমন ছিলো না।হঠাৎ করে তার কি হয়ে গেল?তুমি না দেখলে বুঝতে পারবে না!
:কি হয়ে গেল,আপনি জানেন না!
তার বাবা (একটা নাম করা ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক) রুমে প্রবেশ করলেন।
:দেখ বাবা,আমার ছেলের কি হয়েছে আমরা জানি না।তবে কিছু একটা হয়েছে।ছেলেকে শেষ স্পর্শ করে আদর করেছি। যে কেউ ছেলেকে স্পর্শ করলেই epilepsy হয়ে যায়।
:তুমি যাই কর, তাকে স্পর্শ করবে না।
:এমন কেন হয়?
:আমরা জানি না।
:আমার ছেলেকে আমি শেষ স্পর্শ করে আদর করেছি ১ বছর আগে।তার মায়ের স্পর্শ সহ্য হলেও আমার টা হয় না।ছেলে অসুস্থ হয়ে যায়।
আমি ছেলেটির রুমে প্রবেশ করলাম।
:come in.আমি আপনার প্রোফাইলের সব খুঁটিনাটি পড়েছি।সব সত্যি হলে,আপনি বেশ ভালো মানুষ।
:কিভাবে বুঝলেন?(আমি আমার ছাত্রদের আপনি করে বলি)ঐখানে আমি যেটা জানাতে চাই সেটাই লিখেছি।
:আসলে অন্তরে মধু না থাকলে,মুখে অত মধু উগরে দেয়া যায় না।
৫ম শ্রেণী পড়ুয়া ছাত্রের মুখে এমন কথা শুনে বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম।ছেলেটা যখন আমার সামনে এলো বেশ অবাক হলাম।ছেলেটা ছবির চেয়েও ১০০ গুণ সুন্দর।সৃষ্টিকর্তা কোন জিনিস একশো ভাগ পরিপূর্ণ তৈরি করেননি,এর কি খুত আছে কে জানে?হুমায়ুন আহমেদের হিমু এই শিশুর কাছে নচ্ছার!
টাকা বা কৌতূহল যার জন্যই হোক,আমি তাকে পড়িয়েছিলাম। মানে ৭ দিন আগ পর্যন্তও পড়াতাম। এখন পড়াই না,আর পড়াবোও না।
আবিদ বুদ্ধিমান ছেলে,বেশ বুদ্ধিমান।আমার খুব পছন্দের ছাত্র,আমাকেও বেশ পছন্দ করতো,তার মা-বাবা বলতেন।
আবিদ এখন ল্যাবএইড হাসপাতালে, আমার কারণেই!
সেদিন একটা বেশ কঠিন অংক চট করে সমাধান করে ফেলল।আমি খুশি হয়ে তার কাধে যেই বাহবা দিলাম, epilepsy হয়ে গেল।রক্তপাত দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম,গত ১ বছর এত সতর্ক থাকার পরও সেদিন ভুলটা হয়ে গেল।আমি আর যোগাযোগ করিনি, খুব ইচ্ছে করলেও করিনি।
আজ আবিদের আম্মু কল দিয়েছে।আবিদ আমার সাথে কথা বলতে চায়।
আমি হাসপাতালের গেটে আসতেই আবিদের বাবার সাথে দেখা হল।
:তুমি এসেছ।আবিদ গত ৪ দিন ধরে তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
:ওহ।
:যাই কর বাবা।একই ভুল আবার করো না।তার বিছানায় বসো না,তার খুব কাছেও যেয়ো না।
:তাহলে দেখা করার দরকার কি?আমি চলেই যাই।
:না না না,,দেখা কর।আমার ছেলেটা তোমার জন্য পাগল!
আমি রুমের দরজায় দাঁড়ালাম। বাইরে থেকেই রুমের সাজসজ্জা দেখে আমি মুগ্ধ। আসলে বড়লোকদের অসুস্থ হয়াও একটা উৎসব। হাসপাতালগুলো পাচতারা হোটেলের মত ঝকঝকে, রুমে নি:শব্দে এসি চলবে,দেয়ালে প্লাজমা টিভি,বেল টিপলেই নার্স। যেন সে অসুস্থ নয় অবকাশ যাপনের জন্য এসেছে।
:স্যার,ভিতরে আসুন।
:না, আসবো না।
:আমি জানি আপনি খুব রাগ করেছেন।সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,আমাকে আর পড়াবেন না!
:সব জানেনই তো, ডেকেছেন কেন?যা বলার বলুন,দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।চলে যাবো।
:স্যার, আপনি ভিতরে আসুন।
:না, আসবো না।আসলেই আমার আপনার বিছানায় বসতে ইচ্ছে করবে।আপনাকে স্পর্শ করে দেখতে ইচ্ছে করবে।আপনাকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করবে,তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবেন!সেটাতো সম্ভব না।পরে আবার আপনার epilepsy হয়ে যাবে,রক্তারক্তি আমার ভালো লাগে না।
:আপনি যদি বলেন,বিছানায় বসে,আমার হাত ধরতে দিলে আমায় আবার পড়াবেন তাহলে আসুন;বসুন।আমার আর কিছু হবে না।
আবিদকে দেখে খুব মায়া লাগলো। ঠোট কেটে বিচ্ছিরী অবস্থা, সেলাই করা।আমি তার বিছানায় বসলাম।সে কেপে উঠলো। যেই হাতটা ধরলাম,অমনি ওর হাত শক্ত হয়ে গেল।মুখটা অস্বাভাবিক হয়ে গেল। অকস্মাৎ সে আমায় জড়িয়ে কান্না শুরু করলো।
বেশ কিছু সময় কাদলো,আমি চুপ কর রইলাম।
:আচ্ছা, আপনার এমন কেন হয়? আমরাতো পছন্দের লোকদের জড়িয়ে ধরেই আদর করি।গালে চুমু খাই।আর আপনার কোথাও স্পর্শ করা যায় না।কি আজব বলুনতো?
আবিদ একটু কেঁপে উঠলো। আমি আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
সে কথা বলতে শুরু করলো।
"সেদিন চাঁদ রাত ছিল, তখন আমাদের বাসার ছাদে কাজ শুরু করা হয়েছে।বাবা মা মার্কেটে গিয়েছেন।আমি আর মামা বাসায়, আমরা নিচতলা থেকে পটকা ফুটিয়ে বাসায় এলাম।
মামা বাসায় এসে বললেন,চল একটা খেলা খেলি।তোমার চোখ বেধে দিব।তারপর একেকটা জিনিস তোমাকে ধরতে দিব, আর তুমি জিনিসটার নাম বলবে। যদি বলতে পার পুরস্কার আর না বলতে পারলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে।
আমার কাছে দারুণ খেলা মনে হলো। খেলা শুরু হল,আমি সব কিছুর নামই বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু মামা এমন কিছু একটা স্পর্শ করালেন, পিচ্ছিল-মাংশল আর লম্বা।হাতড়ে বুঝলাম এটা মামার দু'পায়ের মাঝখানে। জিনিসটা আমারও আছে তবে খুব ছোট। আম্মু এটাকে "মনাপাখি" বলে।
আমি বললাম,"পাখি..পাখি..মনাপাখি।"মামা মানলেন না।শর্তমতে মামার ইচ্ছেমত আমাকে কাজ করতে হলো।
আবিদ থেমে গেল।ভয়ে আতংকে জড়সড় হয়ে গেল।
মামা আমার পিছনে খুব ব্যাথা দিলেন।খুউব ব্যাথা,আমি খুব চেষ্টা করেছি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারিনি। চিৎকার করেছি, আমাদের বাসায়তো কেউ ছিল না!
রাতে মামা আবার আমাকে ব্যাথা দিলেন।আমি খুব চিৎকার করতে চেয়েছি, আমার মুখে চাদর গুজে দিয়েছিলেন।
ইদের দিন,আমি মাকে অনেক বার বলতে চেয়েছি মা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল না।
বিকেলে আমরা যখন নানু বাসায় বেড়াতে গেলাম,মামা আমাকে জোড় করে তার ঘরে নিয়ে গেল।আর আগের ব্যাথা দেয়ার কাজটা আবার করলো।আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম।সন্ধ্যায় জেগেই আমার সব মনে পরলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘর বেড়িয়ে এলাম।তবু আম্মু কিছুই জিজ্ঞেস করলো না।
সেদিন রাতে আব্বু যখন গুড নাইট কিস দিতে এলো, আমার আর কিছুই মনে নেই।সজাগ হয়ে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার ঠোঁট-জিহ্বা সেলাই করা।
এরপর থেকেই এমন হয়।কেউ আমাকে স্পর্শ করলেই আমার কি যেন হয়ে যায়।
ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া ছেলেটা একনাগাড়ে ঘটনাটা বলা শেষ করতেই ঘরে অত্যন্ত সুদর্শন একজন লোক প্রবেশ করলেন।আবিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমি সত্যিকারের বৃহন্নলা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলাম।
আবিদের বাবাকে বললাম,"আপনার ছেলের কাছে সকল পুরুষের স্পর্শ অত্যন্ত নোংরা আর এর দায় একমাত্র তার মামার।"
ভদ্রলোক আমার দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:০২