ফাহাদ ইবনে হাই স্যার বলেছেন গল্পের প্লটের জন্য আমাকে প্রথমেই ভিন্ন ধর্মী চিন্তা করতে হবে। প্রচন্ড কল্পনা-প্রবণ হতে হবে, কল্পনা শক্তিকে ধারালো করতে হবে। শুধু তা নয় বাস্তব-সম্মত কল্পনার জন্য আমাকে ভ্রমণ করতে হবে এবং অর্জন করতে হবে বাস্তব-সম্মত অভিজ্ঞতা। মস্তিষ্ক কেমন যেন ঢোলের মতো খালি হয়ে গেছে। লেখার জন্য তীব্র বাসনা অশান্ত করে দিচ্ছে। না লিখলে হয়তো অসম্পূর্ণতা অনুভব হতেই থাকবে। তাই চললাম মস্তিষ্কের জন্য এক টুকরো অভিজ্ঞতার সন্ধানে।
প্রথমেই যাব দের কিলোমিটার দূরের কমলাপুরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন। যেমন বড় তেমন বিস্তর এর চারপাশের বসতি। লাইনের দুই পাশের বস্তিতে অথবা গৃহহীনদের ঝোলায় হয়তো অনেক প্লট পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
কাঁধে ছোট ব্যাগ, তার ভিতর রয়েছে লিওর সুশার্ড এর বিখ্যাত মাইন্ড রিডার বইটি সাথে রয়েছে বিদ্যুত মিত্রের সেবা প্রকাশনীর কিছু বই। একটা লক করা ডাইরি। ছাত্রের উপহার দেয়া ধাতুর কলম। ভার্সেলোনার লগো ডিজাইন করা মানিব্যাগটাকে স্বাস্থ্যকর করে তুললাম, পথিমধ্যে যেন অর্থ সংকট না হয়। বলা তো যায় না এক টুকরো অভিজ্ঞতার মূল্য কত দেয়া লাগে।
সকাল শেষে দুপুর। বসে থাকলাম গোপীবাগের কাছে রেল লাইনে। দেড় কিলোমিটার হেঁটে আসতেই হাঁপিয়ে পড়েছি। মাথার উপর মাছি ভন ভন করছে। চারপাশে অবিশ্রান্ত কোলাহল। কোলাহলগুল দুই পাশের ব্যস্ত অস্থায়ী নোংরা বস্তিগুল থেকেই আগত। কাপড় দিয়ে, পলিথিন দিয়ে সবগুল বস্তি তৈরি। সারিবদ্ধভাবে বস্তিগুল রেল লাইন বরাবর গেছে। মাঝে মাঝে কোথাও দেয়ালে আয়না লাগিয়ে, পাশে চেয়ার বসিয়ে কেউ কেউ নাপিতের কাজ করছে। কেউ কেউ মাথায় ফেরি করে মাল বিক্রিতে ব্যস্ত। আর মেইনরোডের যানবাহনগুলর ব্যস্ততা।
ছোট নগ্ন শিশুগুল দল বেঁধে কী যেন আবিষ্কারে মগ্ন। না, প্লট পাচ্ছি না কোথাও। রোদে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। যাওয়া যাক একটা বস্তির ভিতর।
‘‘হ্যালো! কেউ আছেন?’’
‘‘হ্যাঁ, ভিতরে আসুন।’’
‘‘এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন?’’
‘‘বসুন। এখানকার লোক নাই। আসলে তিনি পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবে।’’
‘‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না আপনি এই পরিবেশের?’’
‘‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।’’
‘‘আমার জন্য? আপনি জানতেন আমি আসব? আপনি আমাকে চিনেন?’’
‘‘কেনো চিনব না? আমিইতো তোমার সৃষ্টিকর্তা।’’—বলেই মধ্য বয়স্ক পাতলা টিশার্ট পরিহিত লোকটা রহস্যময় হাসি দিল। আমি খানিক আঁতকে উঠে বললাম—
‘‘মানে?’’
‘‘যে গল্প তুমি লিখছো সেই গল্প আমার। আমিই গল্পের লেখক। তুমি আমার গল্পের চরিত্র।’’
‘‘মানে আমি একটা গল্পের চরিত্র?’’
‘‘হুঁ।’’
‘‘তুমি প্লট খুঁজতে গল্পের এই পর্বে আমার কাছে আসবে আমি জানতাম। এই দেখো আমার ডায়রী যে গল্প এখন চলছে। তোমাকে দিয়ে আমি আমার প্লট মেলাবো। এসো দুজন বসে আলাপ করি।’’
‘‘তাহলে এই গল্প এখন কে লিখবে? আপনি না আমি?’’
‘‘তুমিই লিখবে। তোমাকে দিয়ে আমি লেখাব।’’
তারপর আমাদের আলাপ হয়। আমরা বসি, গল্প করি। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে আয়েশ করে চা খেয়ে প্লট মিলিয়ে দুজন আবার চলতে থাকি। হঠাৎ করেই লেখককে তাকিয়ে দেখি কেমন চিন্তিত মনে হলো। আমি বললাম, ‘‘স্যার কী অসুস্থ?’’
তিনি আমার চোখের দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘‘আমার মনে হয় কী জানো? আমিও এই গল্পের একটা চরিত্র। কোথায় যেন লেখক আমাদের জটিল করে তুলছেন।’’
‘‘কী বলছেন স্যার? গল্পের ভিতরেও গল্প? কীভাবে!’’
‘‘আমার তাই মনে হচ্ছে আমরা দুজনই এই গল্পের চরিত্র মাত্র। লেখক খুব চতুরতার সাথে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে লিখছে।’’
‘‘তাহলে বলতে চাইছেন পুরোটাই গল্প।’’
‘‘হয়তো গল্পই।’’
‘‘তাহলে লেখক আমাদের দিয়ে এখন কী করাবে? কীভাবে গল্প শেষ করবে?’’
‘‘লেখকই জানে। তবে হয়তো একটু সামনে এগোলেই লেখকের দেখা পাব। এই জায়গাটা নিয়ে হয়তো লেখকের লিখবার প্রয়াস বেশি। যদি সেটা হয় তবে নিশ্চয়ই তিনি স্বশরীরে জায়গা দর্শন করেই লিখতে বসছে। ধুর মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। চলো সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরাব। সিগারেটের ধোঁয়ার মত ব্যাপারটা স্বচ্ছ করতে হলে সিগারেট পান করতে হবে। চলো এগোই।’’
এই পর্যন্ত চায়ের দোকানের এক কোণায় বসেই টাইপ শেষ করে ল্যাপটপটা ব্যাগে রাখলাম। হিসেব মতো এখনই দুই লেখক এই দোকানে সিগারেট কেনার জন্য আসবে। ওইতো এলো। তাদেরকে বেশ চমকে দেয়া যাবে। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। বয়ো-জ্যেষ্ঠ লেখকটি যুবকটির কানে কানে বলল, এই হয়তো আসল লেখক। তারা ভেবেছে আমি তাদের কথা শুনতে পাইনি। অথচ আমি জানি এখনি তারা আমার দিকে আসবে। এইতো এলো, আসছে, আসছে তারা আমার দিকেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:২৬