আমরা আমাদের প্রভুত্ব নিয়ে বড়াই করছিলাম। আমাকে ছাড়া সে কতটা অর্থব সেটা তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে সে কিছু সময়ের জন্য আমার দাসত্ব গ্রহন করলেও সম্বিত ফিরে ফেলেই তার প্রভুত্ব নিয়ে আলোচনা করছিলো। আমাদের এই সুদুরপ্রসারি আলোচনা কোনো সমাধান ছাড়ায় শেষ হয়েছিলো এবং হয় প্রতিনিয়ত। আমরা সবসময় নিজেকে প্রভু ভাবতেই পছন্দ করি। এবং সেটা যতটা পারি ইনিয়ে বিনিয়ে বারংবার আমাদের কথার মাঝে নিয়ে আসি কোনো পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই। এটাই আমাদের দৈনন্দিন কার্যাবালির এমন একটা অংশ কিংবা আমি বা আমরাই তার অংশ হিসাবে বেঁচে আছি যে বুঝতে না পারার ব্যর্থতাও আমাদের চোখে সফলতা হিসাবে ধরা দেয়। যে সফলতায় আমরা পরম আয়েশে ঢেঁকুর তুলি। আর স্তুতি করি নিজের। কখনোবা অন্যের স্তুতি করে ফেলি এবং সহাস্যে অপেক্ষা করতে থাকি কেউ যদি আমার এ বদন্যতাটার স্তুতি করে প্রতিদানে। কেউ করে, কেউ করে না। আমি বা আমরা তাতে ভাবিত নই কারন আমরাও স্তুতিটা বাটখারায় মেপে মেপে করি যে যতটুকু পাই সেটুকুই দেই কিংবা দেওয়ার চেষ্টা করি। এই চেষ্টাটা যে আমার বা আমাদের স্তুতিকারি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উঠে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথোপকথন নিত্যদিনের। যতক্ষন আমরা পাশাপাশি ততক্ষন চলে আমাদের আমিত্বের মুগ্ধতা বিনিময়। আমার বদন্যতায় কিভাবে সুমসৃণভাবে ঢালু পাহাড়টা অতিক্রম করেছিলো কোনো এক স্থবির প্রাণি, রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করি কিংবা সে জানায় তার বদন্যতায় কিভাবে উড়তে পেরেছিলো কোনো আবদ্ধ পাখি। আমরা আমাদের বদন্যতায় ঈর্ষান্বিত যে হইনা তা নয় তবে কখনো সেটা প্রকাশ করিনা কিংবা কুন্ঠিত হই অথবা স্তুতি করি নিজেকে তার ঘটনায় কোথাও প্রভু হিসাবে উপস্থিত করে। তারপর নিজের মনেই প্রশান্তির হাসি দিয়ে জানিয়ে দেই আমি কিংবা আমরা খুব ভালো আছি। যেখানে আমিই প্রভু সেখানে ভালো না থাকার প্রশ্ন আসেই না।
এটাই আমি কিংবা আমাদের দৈনন্দিন জীবন। নিজেদের প্রভুত্বের প্রশস্তি চলে পাড়ার মোড়ের জীর্ণ চায়ের দোকানের প্রায় ভেঙ্গে যাওয়া লম্বা টুলে বসে বসে। কখনোবা আমাদের প্রশস্তিতে যোগ দেয় শীর্ণ দেহের অধীকারি চা ওয়ালা, হয়তো সেও চায় আমাদের আশির্বাদ। আমাদের ঈশ্বরত্বের সমালোচনায় বাদ পড়ে না কেউ। শুরু হয় ছোট কোনো ঘটনা থেকে কিংবা কোনো ঈশ্বরের মত ঈশ্বর হতে চেয়ে। তার প্রশস্তি আমাদের প্রভুত্বকে খাটো করতে পারেনা। বরং সুখস্বপ্ন দেখে ফেলি আমরা। ভেসে চলি সুখের সাগরে। নিজেকে পূজারী পরিবেষ্টিত দেখতে পাই। আর পদলেহন করার চেষ্টা করি কিংবা নিজেদের মাঝেই প্রতিযোগীতা করি কে পাই সান্নিধ্য সেই মহান প্রভুর। যারা পায় তারা আরো প্রশস্তিতে মেতে উঠে, আর যারা পায়না তার বলে উঠে সেই প্রভু তাদের জন্যই প্রভু হতে পেরেছে সুতরাং সে কখনোই প্রভু নয়। বরং যারা তার পদলেহনে ব্যস্ত তারা সবাই বোকাদের সপ্তম স্বর্গে বাস করে ভেবে আস্বস্ত হই। পাওয়া না পাওয়াটা আমাদের জন্য মুখ্য নই বলে দম্ভের সাথে স্বীকারোক্তি দিলেও সেটা যে মনের কথা নয় সেটা প্রকাশে আমরা কুন্ঠিত থাকি সবসময়। আমরা কখনোই নিজেদের প্রভুত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নই সেটা কাউকে অসৎ, ক্ষমতালোভী, কুপ্রররচনাকারী বানিয়ে হলেও। নিজেদের পূজারীর সংখ্যা গণনায় পিছিয়ে পড়তেও আমরা রাজি থাকিনা, পাছে প্রতিযোগী বন্ধুর বিজয়ে উদযাপন করা লাগে সেই ভয়ে। হোকনা মিথ্যা অহমিকা তবুও আমরা নিজেদের কল্পনাতে ভাবতে ভালোবাসি আমাকে ছাড়া অচল অসংখ্য অনুসরনকারী। কখনোবা নিজদের মাঝে মতভেদের জন্য বাক বিতন্ডা ছড়িয়ে পড়ে। উষ্ণ হয়ে উঠে জীর্ণ দোকানটা, হয়তো কোনো পথিক কিছুক্ষনের জন্য হলেও আগ্রহ অনুভব করে আমাদের উষ্ণতায়, তারপর ফিরে যায় তার গন্তব্যে। কিছু সময়ের জন্যে হলেও আমরা শীর্ণ দোকানির মুখে হাসি এবং চোখে স্বপ্ন ফিরিয়ে নিয়ে আসি। তার চোখে হয়তো ভাসে জীর্ণতার পরাজীত প্রতিচ্ছবি। শুধুমাত্র দোকানটির পাশেই শুয়ে থাকা জারজ কুকুরটি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে আবার নিতান্ত অবহেলায় পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে কিংবা আশির্বাদকে তুচ্ছ্য তাচ্ছিল্য করে। যা আমরা দেখেও দেখিনা বরং শান্তি লাভ করি এই ভেবে যে সেটা নিছকই একটা জারজ শারমেয়।
আমাদের প্রভুত্বের ক্লান্তি চলে আসে সময়ক্ষেপনের সাথে সাথে। যখন ফেরার তাড়া অনুভব করি সাথে দ্বায়বোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখন প্রভুত্বকে ভুলে যেয়ে মানুষ হয়ে উঠি। যার দরুন ক্লান্ত, শীর্ণ দেহের অধীকারী দোকানির মুখের হাসি হারিয়ে যেয়ে ক্লান্তি ভেসে উঠে। তার স্বপ্নের করুণা আমরা করতে পারিনা বরং তার করুণার জন্য অপেক্ষা করি। কিংবা অপেক্ষাটা আমাদের জন্য অপমানজনক বলে তাকে ভুলিয়ে পরেরদিনের স্বপ্ন দেখিয়ে চলে আসি। আমরা আমাদের প্রভুত্ব নিয়ে সুখস্বপ্ন দেখি কিন্তু অন্যের স্বপ্নকে, শান্তিকে, ভালোবাসাকে নিজের ভাবতে অস্বীকার করে চলি প্রতিনিয়ত। কারন আমরা দাম্ভিক, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক প্রভু হয়েই জীবন চালাতে পছন্দ করি। সেই প্রভুত্বের মাঝেই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে এক একটা দিন পার করি এবং ভাবি এই বেশ আছি।