আমার চারপাশ সবুজ ছিলো। সবুজের অভায়রণ্যে নিজেকেও সবুজ মনে হতো। সবুজ শীতল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিতাম। প্রশ্রয় পেতাম স্নিগ্ধ ছায়াতে। চপল মায়াবি হরিনের পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজেও দুরন্ত হয়ে উঠেছিলাম। ভোরের আলোতে উষ্ণ ওম আর বিকালের মায়াময় আলোতে প্রাণভরে বেঁচে থাকার উপকরন পেতাম। শুয়োপোকার মাঝে খুঁজে পেতাম ভবিষ্যতের প্রজাপতি। তাদের রঙ্গিন ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়ানো উপভোগ করতাম নিজের মত করে। ডানা ভাঙ্গা শালিক দেখলে মোচড় দিয়ে উঠত বুকের বামপাশটাতে। শুশ্রুষা না পারলেও মমতা ছিলো তাদের প্রতি। রাত্রির জোৎস্না প্লাবিত আলোয় সুখময় ছিলো জোনাকির রূপকথা সৃষ্টিকারি মিটিমিটি আলো, সুরময় ছিলো ঝিঁঝিঁর অনবরত সঙ্গীনির আহ্ববান। মুক্ত ছিলো বিহঙ্গ, মুক্ত ছিলাম আমি। শুধু ভয় ছিলো অচেনা কীটগুলোর প্রতি। এই অস্বাভাবিক ভয় কিংবা লোভ আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো সবসময় আলোকিত থাকা অংশটিতে। যেখানে আমি দূর থেকে দেখতাম আনন্দের সব উপকরন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবসময়। তাই বিলম্ব হয়নি সিদ্ধান্ত নিতে। একদিন খুব ভোরে এই পাখ-পাখালি ভরা সবুজ অরণ্যকে বিদায় জানিয়েছিলাম, বিদায় জানিয়েছিলাম পায়ের নিচে পরম মমতায় আগলে রাখা সবুজ ঘাসকে। বিদায় জানিয়েছিলাম সুঘ্রানে মাতিয়ে রাখা শিউলি, বকুল, হাস্নাহেনাকে। বিদায় জানিয়েছিলাম তারস্বরে উচ্চারিত সুরের পাখি কোকিল শ্যামাকে। ভয় লাগানো কিংবা মায়া লাগানো সুরের পাখি ডাহুককেও জানিয়েছিলাম বিদায়। পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আলোকময় অংশে যেখানে রাত হয়না, তাই ভীতসঞ্চারকারি জন্তুর হাত থেকে বাঁচার আশায়।
সবুজ যেখানে শেষ হয়েছিলো সেখানে আমাকে রেখে আসতে হয়েছিলো সবুজের সোদা গন্ধ, কারন সেটা আলোকিত অংশে বিবেচিত হয় দুর্গন্ধ। আমি আলোকিত অংশের মনোযাতনার কারন হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম না, তাই মুক্ত করে দিয়েছিলাম সবুজে বুনন পোষাকটিকে। একটু একটু করে পরিষ্কার করেছিলাম কাদা-মাটি জলকে। নিজেকে সাজিয়েছিলাম আলোকিত অংশে পাওয়া অপুর্ব মোহনীয় সব সুগন্ধযুক্ত বস্তু দিয়ে। সাজিয়েছিলাম নাম না জানা আরামদায়ক মসৃন কাপড়ে। সবুজে বেড়ে উঠা হৃদয় বদলে নিয়েছিলাম কনক্রিটে তৈরী টেকশয় কারুকার্যময় হৃদয়। যার দেয়ালে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হলেও মায়া সৃষ্টি হতোনা। বদলে নিয়েছিলাম শ্লথ গতির পায়ের বদলে দুরন্ত চাকাওয়ালা ইঞ্জিন, যা অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে যেকোনো চপল হরিনকে। যদিও তার দরকার ছিলোনা কারন এখানকার হরিনেরা চপল হলেও স্থির থাকতেই বেশি ভালোবাসত। প্রতিদিন আমি তাদেরকে একই ভঙ্গিমায় দেখেও মুগ্ধ ছিলাম। এখানেও গাছ ছিলো কোনো এক সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে, সেখানে যেয়ে মাঝে মাঝে বিবর্ন পাতাতে বাতাসের আন্দোলিত করে যাওয়াটাকেও অতিরিক্ত মনে হতো। সকাল কিংবা বিকালের আলো পাওয়া হতোনা ব্যস্ততার কারনে, দুপুরের তেজদীপ্ত আলো মনে করিয়ে দিত জীবনকে সাজানোর অনেক বাকি। তাই শেষ করো যত পারো তোমার কাজ, স্থির থেকোনা। ভাবুলতা এখানে বিলাসিতা। সন্ধ্যার স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোকমালা জোনাকিদের মনে করিয়ে দিলেও তাদের থেকে বেশি আলোকিত ভেবে শান্তি বিরাজ করতো শঙ্কাযুক্ত মনে। এখানের প্রজাপতিদের বাড়তি উপদ্রব মনে হতো তারচেয়ে বরং শুয়োপোকাদের অনেক ভালো মনে হতো যা সৃষ্টি করতে পারতো কোমল সুতা।
তবে আমি ফেরার পথ খুঁজি নাই তা নয়, তবে খুঁজে পাওয়ার জন্য সবুজের গন্ধ জানতে হয়। তা আমার নসরান্ধ্র ভুলে গিয়েছিলো অনেক আগেই। পথ খুঁজে, ফেরার জন্য সবুজের প্রবেশ পথে দেখাতে হয় সবুজ হৃদয় তা আমি খুইয়ে ছিলাম আলোকিত অংশে প্রবেশের সাথে সাথে। এখন আমি মনে মনে খুঁজে ফিরি আমার হারিয়ে যাওয়া হৃদয়, শরীরের সোদামাটির গন্ধ কিংবা স্বপ্ন দেখি সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ রাত ১১:৪১