
১।
আজকে বিকেলে অনেকদিন পর রুলিতের ওখানে গেলাম। আমি আর ইর্বল। ইর্বল এত আলসে, কোথাও যেতে চায় না, সুযোগ পেলেই গ্যাট হয়ে বসে কি সব চিন্তা করতে থাকে। আমি উলটো, ঘরের মধ্যে আমার মোটেই ভালো লাগে না, ছটফট করতে থাকি, কিন্তু একা বের হওয়াও যায়না। আজকে জোর করে ধরে এনেছি ইর্বলকে, সে সারাপথ গোমরা মুখে পা টেনে টেনে হাঁটলো। পথে নানান কথা বলতে বলতে হটাৎ খেয়াল করলাম যে সে কিছু শুনছে না, আমার বেশ মন খারাপ হল। নিজের ভালো লাগার জন্য আরেকজনকে কষ্ট দিচ্ছি! আমি ঘুরে ওর হাত ধরে বললাম, “চল, ফিরে যাই।”
ইর্বল চমকে উঠে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “কেন? যাবে না? রুলিত তো বসে থাকবে!”
“থাকুক বসে!” অনিচ্ছাসত্বেও অভিমানে আমার গলা বুজে এলো। ইর্বল হাতের মুঠো খুলে একটা প্রজাপতিকে উড়ে যেতে দিয়ে সেদিকে অপ্রয়োজনীয় লম্বা সময় ধরে চেয়ে থেকে বলল, “ঠিক আছে, ওই যে ত্রাত্তা যাচ্ছে, তুমি ওর সাথে ফিরে যাও।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কোথায় যাবে!” সে আরও বেশি অবাক হয়ে বলল, “আমি যাই রুলিতের সাথে দেখা করে আসি!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম, “আচ্ছা, চল রুলিতকে দেখেই আসি।” ইর্বল কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ‘বুঝি না’ টাইপের একটা ঠোঁট উল্টানি দিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে চলতে শুরু করল।
রুলিত অবশ্য ইর্বলের মত নয়, সেও রাশভারী, কিন্তু সময়ে চটুল আর উচ্ছলও হতে জানে। আমাকে সে বেশ পছন্দ করে আমি বুঝতে পারি, আমাকে দেখলেই ওর চোখদুটো কোমল হয়ে ওঠে। যে একঘন্টা ছিলাম, রুলিত একাই মাতিয়ে রাখলো আমাদের, যদিও সে, আমি আর ইর্বল ছাড়া আর কেউ ছিলো না, এর মধ্যে ইর্বল পথে কুড়িয়ে আনা একটা ম্যাপলের পাতার উপর চোখ আর হাত বুলিয়েই সময় পার করে দিলো।
ফেরার সময় রুলিত আমার দুইহাত তার বিশাল একহাতে নিয়ে বলল, “তুমি সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসবে, এই সময়গুলোর জন্য আমি যে কতখানি অপেক্ষায় থাকি! মিনাতোকেও নিয়ে এস।” তারপর সে ইর্বলের সাথে করমর্দন করল। তার ছলছলে চোখ দেখে আমারও চোখ ভিজে উঠছিলো, ইর্বল দ্রুত আমাকে টেনে নিয়ে চলল, একটু পরেই অন্ধকার নামবে।
মিনাতো চোখেমুখে ক্লান্তি নিয়ে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো, আজকে নিশ্চই খুব খাটনি গেছে ওর – আবার তিনমাস পর সে একদিন ছুটি পাবে। আমি পাব আরও ছয়মাস পর। একসাথে বেড়াতে যাওয়া কি আর হবে আমাদের কখনো?
রাতের খাবারের পর খবর এল, কাকাশিমা আমাদেরকে নিয়ন্ত্রনকক্ষে ডাকছে, সবাই যেন একঘন্টার মধ্যে সেখানে যাই। নিয়ন্ত্রনকক্ষে যাওয়া মানেই কাকাশিমা’র কাছে নতুন কোন কাজের ফিরিস্তি শোনা নয়ত দায়িত্বের অদলবদল হওয়া – দুটোর কোনটাই খুব সুখকর নয়।
মিনাতো বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ঘুমুচ্ছি, ডেকে নিও।” তারপরই সে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ছোটভাইটার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুক মোচড় দিয়ে ওঠে, আমি মিনাতো’র ঘন কোকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম।
২।
নিয়ন্ত্রনকক্ষে কাকাশিমা’র সামনে এখন আমরা দশজন দাঁড়িয়ে আছি, সবার হাতে যার যার কম্পিউটার মডিউলটা ধরা। কাকাশিমাকে গম্ভীর দেখাচ্ছে, কিন্তু তার চোখের চাঞ্চল্য বলে দিচ্ছে সে বেশ উৎকন্ঠিতও। জ্ঞান হবার পর থেকে কাকাশিমাকে দেখে আসছি, সে শান্ত এবং ধীর স্থির। আমাদের যত শিক্ষা আর দক্ষতা সব ওর সান্নিধ্যে পাওয়া, তাই তার চঞ্চলতাটুকু আমাদেরকেও স্পর্শ করল, আমরা সবাই এর ওর মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা আঁচ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কাকাশিমা গলা খাঁকারি দিতে আমরা সবাই তার দিকে ফিরলাম।
“সবাই আছো তো, না? ঠিক আছে।” কাকাশিমা অস্থির ভঙ্গীতে তার হাত মুঠো করে ও খোলে। “সবাই তাহলে আছ!”
তার অদ্ভূত কথা শুনে আমরা অবাক হই, আমাদের মধ্যে শিনারা বেশ সাহসী, সে প্রশ্ন করে, “তুমি কি কিছু নিয়ে বেশি চিন্তিত, কাকাশিমা?”
“হ্যা।” কাকাশিমা একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, “আমাদের ওপর খুব বড় একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, খুব বড় দায়িত্ব, খুব কঠিন দায়িত্ব।”
আমার মন খারাপ হয়ে গেল, কাকাশিমা যখন বলে খুব কঠিন দায়িত্ব, তারমানে আমাদের কেউ কেউ সেই দায়িত্ব পালনের জন্য যথেস্ট সক্ষম নয়, আমরা কাউকে না কাউকে হারাতে যাচ্ছি। আমি পাশে দাঁড়ানো মিনাতোর হাত ধরলাম, সে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
শিনারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করে, “কি দায়িত্ব, আবারও স্বয়ংক্রিয় শক্তিন্তর কেন্দ্র বসাতে হবে যাতে আমাদের দু’একজন মারা পড়ে? তুমি যার কাছ থেকে দায়িত্ব পাও, সে যদি এতই শক্তিশালী হবে, তবে সে কেন নিজে শক্তিন্তর কেন্দ্র বসিয়ে নেয় না?” দ্রিহোলা ফিসফিস করে শিনারা কে থামতে বলে।
কাকাশিমা চট করে একবার আমাদের মাথার বহু উপরে জান্তব ত্রিমাত্রিক দৃশ্য-যন্ত্রটার দিকে তাকালো। তারপর শিনারাকে বলল, “দায়িত্ব আমি পাই না শিনারা, দায়িত্ব আমাদের সবাইকে দেওয়া হয়।”
মিনাতো অনুচ্চ স্বরে জানতে চাইল, “কি দায়িত্ব কাকাশিমা? আমাদের কি করতে হবে?”
“বলছি, সবাই মন দিয়ে শোনো। আমরা এখানে কতজন আছি?” সে সবার মুখের দিকে তাকায়।
“রুলিত আর আরিণ কে সহ একষট্টি জন।” একপাশ থেকে রোণ উত্তর দিল।
“উঁহু, সবাই নয়, আমাদের টীমে। আমরা কতজন প্র-পরিকল্পক আছি?”
“তোমাকে সহ এগার জন।”
“হু, ঠিক।” কাকাশিমা একটু থামে, “যে উদ্দেশ্যে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদের এই ছোট্ট সভ্যতাটা গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেটা শেষ হয়েছে। এখানে আমাদের কাজ শেষ।”
আমাদের সবার বেশ কিছুক্ষণ লাগলো কথাটা বুঝে উঠতে, তারপর একসাথে কয়েকজন শিষ দিয়ে উঠল। এখানে কাজ শেষ হয়ে যাওয়া মানে আমাদেরকে এবার মূল শহরে নিয়ে যাওয়া হবে। মিনাতো আমাকে জড়িয়ে ধরল খুশিতে। দুয়েকজন উচ্ছাস নিয়ে কিছু বলতে যেয়েও কাকাশিমার চোয়ালবদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।
“কাকাশিমা, আমাদের কি খুশি হওয়া উচিত নয়?” শিনারা জানতে চায়।
“তোমরা এখনও দায়িত্বটার কথা শোন নি।” সবাই চুপ হয়ে গেলে কাকাশিমা আবার শুরু করে, “মূল শহরে আমরা সবাই যেতে পারব না, অল্প কয়েকজন যেতে পারবে।”
“বাকিরা?”
কাকাশিমা না শোনার ভঙ্গী করে বলে চলল, “ওই অল্প কয়েকজনকে নিয়ে নেবার পর দ্বীপটা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।”
আমার মেরুদন্ডে ভয়ের একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল, দেখলাম সবাই একেবারে হতবাক হয়ে পড়েছে। অনেক্ সময় পরে আমি জানতে চাইলাম,
“যারা রয়ে যাবে তাদেরকে সহ?”
“হ্যা, তাদেরকে সহ।” কাকাশিমার চোখ আমাদের সবার উপর একবার করে ঘুরে আসে।
“সেই অল্প কয়েকজন কারা, কাকাশিমা? যারা মূল শহরে যেতে পারছে?” রোণ কাঁপাস্বরে জানতে চায়।
কাকাশিমা অভয় দেওয়ার ভঙ্গী করে একটা হাত তোলে, “সেটা এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, এখনও সবারই সুযোগ আছে।”
“সবারই? একষট্টি জনেরই?”
কাকাশিমা একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যা, একষট্টি জনেরই। তবে আমাদের, প্র-পরিকল্পকদের সুযোগটা বেশি। আমরা ভাগ্যবান, কারন দায়িত্বটা আমাদের উপরে। যারা সফলভাবে দায়িত্বটা পালন করতে পারবে, তারাই নির্বাচিত হবে।”
আমরা ভুলেই গেছিলাম যে একটা দায়িত্বের কথা কাকাশিমা বলছিল, এখন আবার মনে পড়ল। আমরা উদগ্রীব হয়ে শুনতে লাগলাম।
“আমাদেরকে একটা সমস্যা তৈরি করে দেওয়া হবে, খুব জটিল কোনো সমস্যা।” কাকাশিমা শুরু করে, “প্রত্যেক প্র-পরিকল্পকের কাজ আলাদা আলাদাভাবে সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা পারবে, তারা নির্বাচিত হবে।”
কয়েকজন বড় করে শ্বাস নিল, কারও মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কেউ কেউ জ্বলজ্বলে চোখে চোয়ালশক্ত করে রইল। আমি সহজেই আত্ববিশ্বাসী কয়েকজনকে আলাদা করে ফেলতে পারলাম তাদের চেহা্রার পরিবর্তন দেখে।
“কিন্তু আমরা এগারজন ছাড়া তো কেউ প্র-পরিকল্পনা জানে না, তাহলে অন্য টীমের সবার কি হবে?” শিনারা জানতে চায়।
“তুমি যদি চাও তো তাদের শিখিয়ে নিতে পার, তাদের জন্য সমস্যাটা একটু সহজ হবে। অন্য টীমের কেউ যদি প্র-পরিকল্পনা শিখে সমস্যাটা সমাধান করতে পারে তাহলে সে এবং তার শিক্ষক দুজনই নির্বাচিত হবে, নয়ত কেউ নয়। তবে যাই কর, সময় মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা, শুরু হবে একঘন্টা পর।”
“এটা অসম্ভব!” আমি চমক ভাঙ্গলে চিৎকার করি, “তুমি এত কম সময়ে পঞ্চাশ জনকে শেখাতে পারবে না, কোনোমতেই সম্ভব নয়। এটা অন্যায়, ভীষন অন্যায়।”
“ন্যায়-অন্যায় আপেক্ষিক ব্যাপার, অরিত্রো।” কাকাশিমা শান্তকন্ঠে বলে।
“তারমানে আমাদের স্বার্থপর হতে হবে, নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে? কি হবে আমি যদি এই নির্দেশ না মানি?”
কাকাশিমা চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “সবাই তার নিজের ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, অরিত্রো। সবাই। তুমি তোমার যা ইচ্ছা হয় করতে পার, বক্তৃতা দিয়ে আরও কয়েকজনকে তোমার মত জানাতে পার, ঐক্যমত গড়ে তুলতে পার, টীম ছেড়ে চলে যেতে পার। তুমি এখন ইচ্ছাস্বাধীন। প্রত্যেকেই তাই।
“তবে, ফলাফল কিন্তু বাহাত্তর ঘন্টা পরেই। হয় তুমি নির্বাচিত হবে নয়ত না। আর নির্বাচিত হওয়ার শর্তও কিন্তু পাল্টাবে না।” আমরা সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
“একঘন্টা পর সমস্যাগুলো আমি পাব, তারপর যার যখন ইচ্ছা এসে তা জেনে যেতে পার।” কাকাশিমা আবার একবার সবার মুখের দিকে তাকালো, তারপর ঘুরে বের হয়ে গেল।
সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলো, এইমাত্র শোনা কথাগুলো সবাই ঠিক নিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আমার ইর্বল আর রুলিতের কথা মনে পরল, ওদের কি হবে তাহলে, ওরা তো প্র-পরিকল্পক নয়? আমি কি ওদের শিখিয়ে ফেলতে পারব যাতে ওরা উৎরে যেতে পারে, এতটা ভালো শিক্ষক আমি? আচ্ছা, আমি নিজে কি সমাধান করতে পারব সমস্যাটা, কেমন কঠিন ওটা, খুব? আমি কি যথেষ্ট ভালো ওটার জন্য? মিনাতো? মিনাতো পারবে?
আমি ধপ করে মাটিতে বসে যাই। মিনাতো বসে আমার পাশে, আমাকে শক্ত হাতে ধরে রাখে। কি করব আমি এখন? প্র-পরিকল্পনা? শিক্ষকতা? নাকি, নাকি বিদ্রোহ করব কোনো লাভ নেই জেনেও?