এখন তো দেখি জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার সময় এসে পড়েছে । যেহেতু তিনি বলেছেন মাদরাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাইতেই হবে । কেননা, যুগের চাহিদা অনুযায়ী মাদ্রাসার সিলেবাসে অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান ঢোকানো গেলে জাতীয় সঙ্গীতে সমস্যা কী? এমনকি আদালত প্রশ্ন করেছেন— “আপনি দেখান পবিত্র কোরানের কোথায় আছে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না?”
আমরা আদালতকে এই প্রশ্ন করব না যে, আপনি দেখান পবিত্র কোরআনে কোথায় আছে, জাতীয় সঙ্গীত গাইতেই হবে? সঙ্গীতের বিষয়ে ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে, যা আদালতের জানা না-থাকার কথা নয় । এবং ইসলামের বিধান যে একমাত্র কোরআন নয়, তা-ও অবিদিত নয় তাদের ।
এটা ঠিক যে দেশের ধর্মীয়-শিক্ষা যুগের পথে সঠিকভাবে হাঁটতে পারে নি । কর্তৃপক্ষ মাদরাসার ধর্মীয় পুস্তকের যথাযথ সংস্কার না করে এবং আধুনিক সময়ে ধর্মের ব্যবহারিক জ্ঞানগত পাঠ্যক্রম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়ে কেবল বিজ্ঞান ঢুকিয়ে ছাত্রদের জাতে ওঠাতে চেয়েছিলেন । এই ব্যর্থতার ফলে ক’দিন পরপর জেনারেল শিক্ষার সাথে, বুদ্ধিজীবী আর বুদ্ধির ব্যাপারীদের সাথে তাদের আপস করতে হয়, জাতির নেতার ছবি টানাতে হয়, সরকারি আপ্তবাক্য তোতাপাখির মতো আওড়াতে হয় ।
এই আপসের পরিণতিতে সেখানে ধর্মের কতখানি বাঁশ গেছে আর আর কতটুকু বাকি আছে, আদালত কি একটু খতিয়ে দেখবেন? আদালতের দায়িত্ব কি শুধু ধর্মীয়-প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ঢুকানোর খোঁজখবর নেওয়া, ধর্ম আছে কি নেই, সে-দায় তাঁর নেই? তাহলে আদালতের প্রতি ধার্মিক মানুষের দায় কতখানি?
কওমির স্বীকৃতিটা পর্যন্ত আপস করে হয়েছে। মনে হয় যেন এরা তো আসলে যোগ্য নয়, করুণা করে দেওয়া হয়েছে মূলস্ট্রিমে আনার জন্য । এত বিশাল জনগোষ্ঠী কি মানবেতর জীবনযান করবে, তাদের খয়রাত না করলে বাঁচবে কেমনে, দেশের বোঝা হয়ে যাবে না—তাই খয়রাত করা হয়েছে ।
আচ্ছা, মাদরাসায় বিজ্ঞান ঢোকানো হলো কেন? ছাত্ররা মুসলিম এবং মুসলিমদের জ্ঞানে বিজ্ঞানে বলীয়ান হতে হবে—সেজন্যে? তো স্কুল কলেজের ছেলেরা মুসলিম না? নাকি তাদের ধর্মশিক্ষার দরকার নেই বলেই তারা স্কুলে পড়ছে? বিজ্ঞান কি হুজুরদের জন্যে নাকি মুসলিমদের জন্যে? বিজ্ঞান তো তামাম মানুষের জন্যে । একইভাবে ধর্মও যে সকল মানুষের জন্য—সেটা কি অস্বীকার করেন? বিজ্ঞান শেখা লাগলে ধর্ম লাগে না কেনো? একমুখী ধর্মবান্ধব বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থার করার জন্যে আদালত কেনো স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করছেন না?
সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুগের নাম করে । যুগ হাঁটছে কোন দিকে কারও নজর নেই । যুগের দরকার তো ইংরেজি শেখো । ইংলিশ মিডিয়াম যাও । ইংলিশ মিডিয়াম যে কোন দিকে যাচ্ছে, তার খবর নেই । যুগের দরকার মূর্তি গড়া, বানাও মূর্তি । লক্ষ টাকা খর্চা করে যে-মানুষরূপী মূর্তি বানানো হচ্ছে, সেই মানুষ কেমন আছে, সেই মানুষেরা মাথাপিছু যে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণী, গুম-খুন ও পরাধীনতার জাহেলিয়াতে যে তারা জেরবার—সেই খবর নেই । যুগ বলছে, পোশাক আলগা করো, তো ন্যাংটা হতে লেগেছেন । সংসারের পর সংসার ভেঙে ছোট ছোট শিশুরা যে এতিমের মতো অসহায় হয়ে পড়ছে, তার কী দরকার—আপনার দরকার যুগ ।
কী চান আপনারা? দীন-ধর্মহীন একটা রোবট জাতি তৈরি করতে? যদি বলি, এখন মুসলিম হিসেবে কী করে আমি একজন অমুসলিম কবির রচিত সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাই? আমাদের জাতীয় মসজিদ আছে, জাতীয় ইমাম আছে । তাহলে জাতীয় মসিজদের অনুষ্ঠানে কি জাতীয় ইমামরাও জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করবেন?
বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী-এমপিকে বলেন মসজিদে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে । তিনি প্রথমে গেয়ে মাদরাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার প্রচলন উদ্বোধন করুক । যদি তাতে তার কলজে কাঁপে, যদি তাতে তিনি রাজি না হন, তাহলে তার কাছে প্রশ্ন করুন যেই সঙ্গীত মসজিদে গাওয়া যায় না, সেটা কী করে মাদরাসায় গাওয়া হবে? আদালত কি জানেন, দেশের বিপুল সংখ্যক মাদরাসায় ক্লাসও চলে মসজিদের ভেতরে বসে?
আমরা পূর্বেই বলেছিলাম—মাদরাসায় কোরআন-হাদিস শেখানো হয় । তো একটা ছেলে কি জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে কোরআন পড়তে বসবে? নাকি এটা দরকার যে, সমস্ত স্কুল-কলেজ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সকালে কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হওয়া?
আমার তো মনে হচ্ছে, আমরা কোন জাতি—সেই প্রশ্নের মীমাংসার সময় এসেছে । আমরা কি মুসলিম নাকি বাংলাদেশি? জাতীয়তাবাদ কি আমাদের ধর্মের চেয়ে বড়, নাকি জাতীয়তাবাদ নিজেই ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে? জাতীয়তাবাদ যদি ধর্ম হয়, তাহলে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ইসলাম ছাড়া অন্যের কোনো ধর্মের বিধান মানতে আমরা রাজি নই ।
আর যদি যুক্তি তোলেন—অন্য মুসলিম দেশেও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় । তাহলে তাদের বলব, তাদের জাতীয় সঙ্গীত শুনে দেখুন, ধর্মের ভাবধারা সেখানে কতখানি জড়িয়ে আছে । সৌদিআরব, মিশর, তুরস্ক, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, আফগান, লিবিয়া, বাহরাইন, মালয়শিয়ার জাতীয় সঙ্গীত শুনুন । তারপরও যদি গাইতে বলেন, তাহলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত নতুন করে নির্বাচন করুন—যা আমরা মসজিদেও গাইতে পারব, যা স্বদেশের চেতনায় আমাদের যতখানি উদ্দীপ্ত করবে, ধর্মের প্রতি তার চেয়ে কোনো অংশে কম ঋদ্ধ করবে না ।
নইলে শুধু শুধু সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত না গেয়েও কারা দেশে সবচে’ কম অপরাধপ্রবণ এবং কারা গেয়েও দেশের বারটা বাজাচ্ছে সেই হিসাব করুন । হাদাকুমুল্লাহু রব্বুল আলামীন ।
সূত্র : https://bit.ly/2GyCaZC
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১২:২২