প্রিন্সের এই দুইবোনের নাম গ্লোরি আর ম্যাজেস্টি। কেবল নামেই সার। দেখতে কিন্তু মোটেই ভিনদেশি শ্বেতাঙ্গ টাইপের নয়; আপাদমস্তক বিশ্রী গাইয়া। বালক বয়সে বড়দের অজ্ঞতায় নানান ধরনের অবহেলার শিকার হয় মানুষ। সেই রকম অবহেলার ফলেই আমাকে এখন গোশতের সরু পর্বত উপত্যকার মধ্যে সটান বসে থাকতে হচ্ছে। তবু যেহেতু প্রিন্সের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে আজ কপ্টারে চড়ার সাধ পূরণ হলো, তাই অবহেলাটা গায়ে মাখা গেলো না।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, হেলিকপ্টারে বসেই আমার প্রথমে মনে পড়লো পৃথিবীর সবচে’ সংক্ষিপ্ততম যান সাতক্ষীরার সাইকপ্টারের কথা। আদতে সাইকেল, এলাকার মানুষ আদর করে হেলিকপ্টার ডাকে। কপ্টারের মতোই সামনে দুজন ও পিছনে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার হো হো করে হাসতে ইচ্ছে হলো। বুড়িগোয়ালিনীতে যখন সেই সাইকপ্টারে চড়ি আমি সেদিনও আমার এমন করেই হাসতে ইচ্ছে করেছিলো। কিন্তু সেদিনের মতো আজও হাসিটা মেলে দেবার সুযোগ হলো না। কেননা, আজকের এই হেলিকপ্টার যাত্রা কোনো প্রমোদ ভ্রমণ নয়, কপ্টারে আরও একজন নিষ্প্রাণ মানুষ আমাদের পায়ের কাছে শুয়ে যাত্রা করছেন; তিনি প্রিন্সের মা।
প্রিন্স যে হেলিকপ্টার চালায়—এই তথ্যটা আমি জানতে পেরেছিলাম প্রিন্সের মায়ের থেকেই। তিনি আরও জানিয়েছেন— আসলে কপ্টার চালানোতে প্রিন্সের খুব একটা আগ্রহ নেই। সে বিমানের পাইলট হতে চায়। কারণ সম্ভবত এটাই যে, কপ্টারের পাইলট শুনলে মানুষ ততটা চমকিত হয় না, যতটা হয় বিমানের পাইলট শুনলে। তাহলে সে কপ্টারে উঠতে গেলো কোনো? হতে পারে শিখতে গিয়ে সুযোগের কোথাও একটু জটিলতা হয়েছে। তাই আপাতত কপ্টারেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাকে।
এই মহিলা কারণে অকারণে আমার ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণের মধ্যে একটা তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, কোরানের প্রতি তার ভক্তি অশেষ। আমি যেহেতু কোরানের ১৬টি পারা মুখস্ত করেছি, সুতরাং আমার ভক্ত হয়ে তিনি কোরান ভক্তির প্রমাণ দিচ্ছেন। প্রিন্সের মা যতটা আমার ভক্ত, ততটাই আমি ভক্ত প্রিন্সের। প্রিন্স পাইলট—এটাই যে সেই ভক্তির একমাত্র ও অদ্বিতীয় কারণ, সেটা না বললেও চলে। সুতরাং আমাদের মধ্যকার কথোপকথনের উদাহরণ প্রায়ই এমন হয়ে ওঠে—
—আচ্ছা, তুমি কি ১৬ পারা পুরো মুখস্ত বলতে পারবা?
—হুমম, পারবো। আমাদের মাঝেমধ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্ত শোনাতে হয়।
—আমাকে একদিন একপারা শোনাবা।
—আচ্ছা, শোনাবো। আন্টি, প্রিন্স ভাই কি একা একা হেলিকপ্টার চালাতে পারেন এখন?
—পারে। নিয়মিত মহড়া দিতে হয়। কিন্তু পাশে একজন কো-পাইলটের সিটে বসে থাকেন তখন।
—আপনি কি তাকে চালাতে দেখেছেন?
—দেখি নি। আমি আর ওর আব্বু যাবো একবার মহড়া দেখতে।
এই কথোপকথনের মধ্যে অবধারিতভাবেই ঢুকে পড়বেন প্রিন্সের জটাচুলো বাবা। হয়তো তখন তাদের ঘরের টেলিভিশনে আজান বেজে যাচ্ছে। তিনি আজানের দোয়া মুখে আওড়াতে আওড়াতে বলবেন— আচ্ছা, তুমি তো একজন হাফেজ, তাই না...
—না, আমি তো এখনও হাফেজ হই নি..
—কেনো, তুমি ১৬ পারা মুখস্ত করেছো না? বেশি অংশ তো হয়ে গেছে। অতএব তোমাকে আল্লা কবুল করে নিয়েছেন। তুমি হাফেজ।
—(আমি নিশ্চুপ থেকে সুখটা উপভোগ করি।)
—তাহলে তুমি বলো, এই যে বলা হচ্ছে ‘ইন্নাকা লা তুখলিফুল মিয়াদ’। এর অর্থ কী?
—নিশ্চয় তুমি ভঙ্গ করো না অঙ্গীকার। আমি মুখস্ত বলে গেলাম। প্রিন্সের বাবা দার্শনিকের মতো একটা ভঙ্গি করে বললেন— আল্লা কি কখনো তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন?
—না।
—তাহলে এই কথা কেনো বলা হলো? মনে হচ্ছে যে, তিনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন বলে একটা আশঙ্কা আছে, তাই তাকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ করো না।
এই উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ১৬ পারার হাফেজ বরাবরের মতো নিশ্চুপ থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মঞ্চে পর্দা নামে। অর্থাৎ আমি নতমুখে বাসায় প্রস্থান করি।
প্রিন্সের মা-বাবা দুজনই সাদাসিধে। সংসারে তাদের একমাত্র অসুখটা হলো, প্রিন্সের বাবার দুই বিয়ে। আরেক বউ যশোরের শিক্ষা অফিসার। আশ্চর্য ! প্রিন্সের এই আলাভোলা জটাচুলো বাবাটা দুই দুইটা বউ বাগিয়ে ফেললো কী করে? প্রিন্সের মন ভালো থাকলে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা যেতো। কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত থমথমে। প্রিন্সের পাশে বসা তার মামার টুকটাক কথা ছাড়া আর কারও মুখে রা নেই।
আমি গোশতের পাহাড় ঠেলে জানালা গলে নিচে উঁকি দেবার চেষ্টা করলাম। সন্ধ্যা নদীর তীর ঘেঁষে উড়ছে কপ্টার। অদূরেই আমার শৈশবের স্কুল। কৃষ্ণচূড়ার পাশে মাথা নোয়ানো শহিদ মিনার। তারপর পাক খেয়ে আবার নদীর মধ্যে গিয়ে পড়লো কপ্টারটা। রোটরের ফড় ফড় আওয়াজটা অবিকল পাখির ডানা ঝাপটানোর মতোই মৃদমন্দ সুর তুলে চলেছে। মরুভূমিতে উটের থপ থপ শব্দ, ট্রেনের ঝিকঝিক কিংবা স্পিডবোটের ঠকঠকানির সঙ্গে এর অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবার সময় ঢুলু ঢুলু চোখে স্বপ্নও দেখেছি যে, স্পিডবোটে বসে আছি। পদ্মা থেকে বাঁক ঘুরে আড়িয়ালখাঁয় ঢোকার সময় বোটটা কাত হয়ে তলিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ‘এই পানি উঠছে তো, পানি উঠছে’ চিৎকার করতে করতে জেগে উঠে দেখি পাশের যাত্রীরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু আজ নদীর বুক বরাবর উঁচুতে উড়তে উড়তে আমি সবিস্ময়ে অনুভব করছি একটা ছইখোলা নৌকায় ভেসে চলার অনুভূতি। সেই রাতের মতো, আমি আর আমার চারজন আত্মীয়-বান্ধব যে রাতে এমনই একটা নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছিলাম স্রোতের অনুকূলে। ভাসছি আর চলছে সমানতালে আড্ডা। ফেরার পথে চালক একমাত্র আব্দুর রহমান। আমরা ভেবেছিলাম, ভাসতে ভাসতে আর কত দূর যাবো? একসময় স্রোতের রোখ পাল্টে যাবে, তখন স্রোতই আমাদের ফিরিয়ে আনবে। এই ভাবনার গলদটা ধরা পড়ে গভীর রাতে তিন নদীর মোহনায় সেঁধিয়ে যাওয়ার পর। সাঁপের মতো হিশ হিশ করছে নদী। আমরা পাঁচজন যাত্রী ভয়ে কুঁকড়ে উঠছি বারবার। শেষে নৌকার পাটাতনের কাঠ খুলে উজানের সঙ্গে বাঁধিয়েছি অসম যুদ্ধ।
—ভাইয়া পানি খাবো। গ্লোরির সকাতর প্রার্থনা।
শোকের সময় মেয়েরা আরও বেশি আহ্লাদি হয়ে ওঠে। প্রিন্স মাইক্রোর কেবিনেটের মতো একটা পকেট থেকে বোতল বের করে দিলো। কেনো যেনো এই মুহূর্তে প্রিন্সের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো আমার। রাজপুত্রের মতো চেহারা নয় মোটেই। একজন পাইলটের মতোও লাগে না ওকে। সাধারণ একটা ছেলে। আমার সাথে প্রথম আলাপ হলো ক্রিকেট মাঠে। মুরাদের প্ররোচনায় প্রায়ই হেফজখানার জানালা গলিয়ে আমাকে মাঠে যেতে হয়। বাসায় নানুর পুরোনো একটা প্যান্ট আছে। বেল্টের বাঁধনে কষে পায়ের গোছা পর্যন্ত বটে সেটাই খেলার ট্রাউজার হিসেবে চালিয়ে দিই। সেবার প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই আউট করে দিলাম প্রিন্সকে। সেই থেকে প্রিন্স আমার বন্ধু। আমার চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও আমি কখনো সখনো তার কাঁধে হাত রেখে হাঁটার কোশেশ করি। মাদরাসার বন্ধুরা আমাকে ঈর্ষার চোখে দেখে।
কেবল প্রিন্স নয়, চালকদের সঙ্গে কোনো অদৃশ্য কারণে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। নানার পাজেরোতে চড়ে গ্রামে যাওয়ার পথে ড্রাইভার শাহাদাতের সঙ্গে আমার ভাব জমতে দেখে নানিজান যারপরনই ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকাই লঞ্চের চালকের পাশের আসনে বসে সারারাত গল্প করতে করতে ঢাকায় এসেছিলাম একবার। আব্বু আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। সেবার জেনেছিলাম, লঞ্চে চালক থাকেন দুজন। একজন ইঞ্জিনরুমে আর একজন সামনে হেলিকপ্টারের মতো ককপিটে বসে হাল ধরে থাকেন। লঞ্চের চালক হরহরিয়ে ফররুখের কবিতা বলেন—
যেনো সুলেমান নবীর শিকলে বন্দি বিশাল জিন
ছাতি চাপড়ায়ে কেঁদেছিলো কাল সারারাত সারারাত
এই চালক শ্রেণির বাইরে একমাত্র শুটার মামুনের সঙ্গে আমার সখ্যতা হয়েছিলো। সেটাও ওর নিখুঁত বন্দুক চালনা দেখে। মামুনের এয়ারগানের গুলি ছোঁড়া দেখেই নাকি ওকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন এক আজনবি সেনা-অফিসার।
হেলিকপ্টার খুব উঁচুতে ওড়ে না বলে নিচের মানুষ, গাড়ি, ঘর, গাছ ও নদী দেখে অবাক লাগে না। শুধু মনে হয় থিয়েটারের বিশাল পর্দায় ভেসে ভেসে যাচ্ছে একটার পর একটা দৃশ্য, অ্যামাজনের স্লাইড শো’র মতো। স্টীমারে সন্দ্বীপ যাওয়ার সময় সুবিশাল সাগর দেখে যেই নি:সঙ্গতা বোধ হয়েছে, সেই স্বাদও কপ্টারের পাওয়া গেলো না। কেবল চান্দের গাড়ির ছাদে বসে টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে কক্সবাজার গিয়েছিলাম যেবার, একধারে ইনানী বন আর কড়াতকাটা পাহাড়ের সারি আরেকধারে সমুদ্রের হিমেল বাতাস শুঁকতে শুঁকতে যে সুখ পেয়েছিলাম, কপ্টারে চড়ে সেই সুখটা যেনো নতুন করে চাগিয়ে উঠেলো।
জানালার পাশে আরও একটা হেলিকপ্টারের ডানা ঝাপটাতে দেখা গেলো। অন্যটা কোথায় জানা নেই। মোট তিনটা হেলিকপ্টার এসেছে প্রিন্সের সাথে। রাজপুত্র আগমনের মতোই কারবার। কিন্তু ঘটনা সম্পূর্ণ অন্যরকম। গতকাল শেষরাতে প্রিন্সের মা আত্মহত্যা করেছেন দাম্পত্য কলহের জেরে। আরও একবার তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন বলে শুনেছি। প্রিন্সের মামা আফসোস করে বললেন— তখন যে দড়িটা দিয়ে ফাঁস লাগিয়েছে, সেই দড়িটা পুরিয়ে ফেলা হয়নি বলেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।
অনেকেই দেখলাম তার কথার সত্যতা স্বীকার করছেন।
খুব ভোরে প্রিন্স যখন স্কুলমাঠে কপ্টারের ককপিট থেকে লাফিয়ে নেমে এলো, আমি সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন। ভেবেছিলাম, এত বড় রাজকীয় ব্যাপারের মধ্যে প্রিন্স বোধহয় আমাকে চিনবেই না। তা ছাড়া আশেপাশে অজস্র স্বজন জড়ো হয়ে আছে তার। কিন্তু প্রিন্স সোজা আমার ছোট্ট বুকেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সারাক্ষণ আমার হাত ধরে রইলো। তারপর মায়ের লাশটা কপ্টারে তোলা হলে আমাকে নিজেই দুইবোনের মধ্যে বসিয়ে দিলো। সেই থেকে দুইবোন আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে শিশুর মতো। শুধু প্রিন্সের বাবাকে দেখা গেলো না কোথাও।
বাবার হদিস নেই, মায়ের লাশ বয়ে নিচ্ছে পাইলট ছেলে— এখানে কোনো দর্শন আছে কি না কে জানে। তবে আজ এতবছর পরে সেই ঘটনা লিখতে লিখতে একটা বিষয় মাথায় বেশ জোরালোভাবে ডাক দিচ্ছে— আমি আজীবন এমন করে কেবল যাত্রীই হয়ে রইলাম, কখনো চালকের আসনে বসা হলো না।