somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাত কবির গল্প :: যাদের জীবনে লেখা প্রতিটা কবিতাই ছাপা হয়েছে ম্যাগাজিনে

১২ ই অক্টোবর, ২০১২ ভোর ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আমি একজন আপাদমস্তক আধুনিক-কবিতা-কানা মানুষ । পুরনো কবিতাগুলো কিংবা বিখ্যাত কিছু কবিতাগুলোর মাঝে অনেকবার বিচরণ করলেও আধুনিক আপাত দুর্বোধ্য কবিতায় আমার ভীষণ অরুচি। আমি জানি এ হয়ত আমার অক্ষমতা, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসার তাড়নাও অনুভব করি না। ব্লগে কবিতার পরিমাণ আর আমার ব্লগাচারণের পরিমাণ বর্গীয় ব্যস্তানুপাতিক)
--------------------------------------------------------

২০০১ সালের কথা , কলেজ জীবনকালের একদম তুঙ্গে চড়ে বসে আছি। জীবনকে নব রঙে দেখছি , নতুন করে চিনছি। কলেজের কার্যক্রমে নিজেকে বেশি করে সম্পৃক্ত করার চেষ্টাও করছি। ফার্স্ট ইয়ার সবে মাত্র শেষ হয়েছে ।

আমাদের আইডিয়াল স্কুলের হাতে গোনা ২/৪ জন বাদে পুরো ব্যাচের ৩৫০ জনের সবাই সেবার নটরডেমে চান্স পেয়ে বসেছে। মোটের উপর নটরডেম কলেজকে সে বছর আইডিয়াল স্কুলেরই কলেজ শাখা বললেও ভুল হত না। অথচ সবার মাঝেই বোধ করি ফার্স্ট ইয়ারে ক্ষীণ একটা হীনমন্যতা কাজ করত। এর মূলে ছিল সেইন্ট জোসেফ স্কুল থেকে আসা ছেলেরা। পড়াশোনা থেকে শুরু করে নানান কার্যক্রমে তাদের গতিময় চটপটে ভাব-সাব দেখে মনে হত চোখে আঙ্গুল দিয়ে তারা দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে আমরা আদতে পাড়া-গাঁ থেকে এসেছি। বছর ঘুরে দেখা গেল , পাড়া গাঁয়ের আইডিয়ালের ছেলেরা কেবল রেজাল্টেই দোর্দন্ড প্রতাপ দেখাচ্ছে না , সহশিক্ষা কার্যক্রমেও আমরা অগ্রগামী। ফার্স্ট ইয়ার শেষ স্বভাবতই আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । জোসেফাইটরাও স্মার্টনেস খুলে আমাদের কাতারে মিশতে শুরু করল।

মানুষ যতই হীনমন্যতায় ভুগুক , সুযোগ পেলে ভাব দেখাতে ছাড়ে না। আর সেই পিচ্চিকালে তো আরও না। জোসেফ-বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে তখন এলিটিজম আমাদের উপরও ভর করে বসল। দৃষ্টি পড়ল আইডিয়ালেরই কয়েকজন ছেলের দিকে , স্কুলে যাদের উপর আমরা কিঞ্চিত ভার্চুয়াল ছড়ি ঘুরাতাম। তারা কেউ আমাদের কিঞ্চিত আন্ত:-আইডিয়ালীয় এলিটদের ছাড়িয়ে গেল কিনা , সে পর্যবেক্ষণ শুরু হল নিবিড়ভাবে ।

শিকার মিলে গেল কয়েকদিন বাদেই, নটরডেম সংস্কৃতি ক্লাবে। ক্লাবের মডারেটর ছিলেন বাংলা বিভাগের সোহেল আহমেদ। সোহেল স্যারকে এমনিতেও কলেজে কেউ দেখতে পারত না, সে কারণে সংস্কৃতি ক্লাবের উপর একটা রাগ জমা হয়ে ছিল সবার মাঝেই। দেখা গেল , ক্লাবের ছাত্ররা সকাল বিকাল স্যারকে তোয়াজ করে যাচ্ছে। তাদের মাঝে দলপতি গোছের একজন আমাদের স্কুলেরই , স্কুল লাইফে যাকে আমরা বিশেষ পাত্তা দিতাম না। দলপতিকে টার্গেট করে আমরা তাকে বানালাম ভার্চুয়াল ভিলেন "শুটকি টেরিয়ার ডয়েল" ।

সংস্কৃতি ক্লাব থেকে লিটল-ম্যাগ স্টাইলে প্রতি মাসে প্রকাশিত হত "ঢাকঢোল চিটচ্যাট" । সেখানে দেখলাম দলপতির দীর্ঘ সব কবিতা । আঁতে ঘা লাগল বন্ধুদের সবার। কেউ একজন পুরনো সংখ্যাগুলো নিয়ে এসে জানালো , দলপতি শুটকি গত একবছরে প্রতি সংখ্যায় কবিতা ছাপিয়েছে । ভার্চুয়াল উত্তেজনা তখন আমাদের পেয়ে বসেছে , এই ছেলে বেওকুফের মত আমাদের ছাড়িয়ে গেল , তার শোধ তুলতে হবে।

ভার্চুয়াল ব্যাপার , বুঝতেই পারছেন । তার উপর জীবনেও কারও সাথে ঝগড়া-ঝাটি হয়নি এমনতর মানুষ আমরা , তারা শোধ তুলব কি করে? ঠিক হল , ঢাক-ঢোলের পরের সংখ্যা আমাদের কবিতায় ভরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু বললেই তো হবেনা , কেবল একজন বাদে আমাদের গ্রুপের ক্লোজ ৭/৮ জন জীবনে কবিতা তো দূরের কথা এক লাইন গদ্যও লেখেনি । খোঁজ নিয়ে জানা গেল পরের রবিবার ঢাকঢোলে লেখা জমা দেয়ার শেষ দিন । বৃহস্পতিবার আদেশ জারি হল , উইকেন্ডে যেভাবে হোক , কবিতা লিখে আনতে হবেই হবে।

শুক্রবার সকালে মাথা খাটিয়ে আঁতি-পাতি করে আকাশ কুসুম ভেবেও একটা লাইন প্রসব করতে পারলাম না। হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল , ভাবলাম চেষ্টা করেই দেখা যাক। ঘরে "সংসদ বাঙালা অভিধান" ছিল, যেটা স্কুল থেকে হাতের লেখার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম। চোখ বন্ধ করে অভিধানের কোন এক পাতা খুলে কঠিন কঠিন শব্দ বাছাই করে কাগজে লিখে ফেললাম । প্রায় আধা ঘন্টা চেষ্টার পর এক পাতা কঠিন শব্দ জোগাড় হল , যার কোনটার সাথে কোনটার সম্পর্ক নেই । এবার জোর-জবরদস্তি শব্দগুলো পার্মুটেশন কম্বিনেশন করে মাঝে অব্যয় ক্রিয়া আর এক আধটা চেনা শব্দ যোগ করে ছোট ছোট লাইনে সাজিয়ে ফেললাম । ঘন্টাখানেক পরে কাগজে কিছু একটা লেখা হল , অনেক দূর থেকে দেখলে আকৃতিতে যাকে কবিতা বলে মনে হয়। এবার সাহস করে পড়লাম , মাথা-মুন্ড বুঝবে সাধ্যি কার , অর্থানুসন্ধান করতে গেলে বাঘা কবিরাও চিত হবে , আমি নিজে তো নস্যি। আমার কাজিনকে (যে কিনা কিঞ্চিত কবিতাপ্রেমী) পড়িয়ে টেস্ট করালাম , তার চোখে মুখের উচ্ছাস আমার দৃষ্টি এড়াল না । আমি তখন সাহসে টগবগ করছি ,মনে হল , একটা কবিতা জমা দিলে বাছাই না করতেও পারে , কোন ঘাগু ছেলের হাতে পড়লে কবিতার অর্থ উদ্ধার না করতে পেরে যদি ক্ষেপে ওঠে , কিন্তু দু'টো দিলে ফেলতে পারবে না। অভিধান থেকে বাছাই করা অবশিষ্ট শব্দ নিয়ে লিখতে লিখতে সমাজের অনাচার বিষয়ে স্যাটায়ার গোছের আরেকটা কবিতা দাঁড়ালো , যার কিছুটা হলেও অর্থ আছে , তবে অর্থ থাকার দোষে দুষ্ট হয়ে কবিতা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে।

পরের রবিবার নিয়মমত সবাই কবিতা জমা দিল, ৫ জন বাংলা আর দু'জন ইংরেজিতে। দিন পনেরো পরে সবার হাতে আসল নতুন "ঢাকঢোল" নবীন বরণ বিশেষ সংখ্যা । চাররঙা এ সংখ্যাটি বছরের অন্য এগারোটি সংখ্যা থেকে মেক-আপ, গেট-আপ , পৃষ্ঠাসংখ্যা , বাঁধাই তথা শান-শওকতে একদমই আলাদা । মলাট খুলে দেখা গেল আমাদের ৭ জনেরই কবিতা ছাপা হয়েছে , জীবনে লেখা প্রথম ঘাম-ঝরানো কবিতা কারও বৃথা যায়নি। এর মাঝে আমার দু'টো কবিতাই ছাপা হয়েছে । দুর্বোধ্য কবিতাকে ঘিরে চারিদিকে তখন উচ্ছাসের হিল্লোল সবার মাঝে , আরি কি অসাধারণ , কি অসামান্য । ভিলেন শুটকির সাথে দেখা হল , সেও কিনা মুগ্ধ । কিন্তু ঝামেলা হল অন্যটা নিয়ে , যেটা কিঞ্চিত বোঝা যায়। সেটা কিছুটা বুঝলেও স্যাটায়ার টোনটা ধরতে পারল না। কবিতায় স্যাটায়ার করে বলা একটাই সহজ লাইন ছিল -- "আমি দারিদ্র্যের কবি" । লোকে ভাবল আমি সত্যিই এমন কিছু দাবী করে বসেছি । আর যায় কোথায় , তারপর বছরখানেক অনেকেই ডাকত - "অ্যাইক্কবি , দারিদ্র্যের কাবি"।

দেশে গিয়ে পুরনো শেলফে ঢাকঢোলের সংখ্যাটা অনেক খুঁজেও পাইনি । আমরা ৭ জন ছড়িয়ে গেছি পৃথিবীর ৭ প্রান্তে । কেউ আর কখনও কবিতা লিখেছে বলে জানা যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১২ ভোর ৪:৫৩
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×