৩. নতুন বাসা, নতুন সংসার:
এক সিনিয়ার ভাই বাসা ঠিক করে রেখেছিলেন। এখানে বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেবার দায়িত্ব ভাড়াটের নিজের। মানে আপনি বাড়ি ভাড়া করলেও বাড়িওয়ালা আপনার জন্য কারেন্টের লাইন অন করবে না। সব কিছুই ভাইয়ারা সামলে রেখেছিলেন। আমাদের জন্য সবাই মিলে একটা ছোট কার্টনে দরকারি টুকটাক মসলা-টসলা, চাল ডাল এসব দিয়ে একটা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
এখানে ফার্নিশড/আনফার্নিশড দু'রকম বাসাই ভাড়া পাওয়া যায় তবে আমাদেরটা আনফার্নিশড ছিল। সামারে অনেকেই শহর ছেড়ে যাবার সময় তাদের অদরকারি জিনিসপত্র গাছের তলায় রেখে যায়। (গাছের নিচে চেয়ার, ল্যাম্পশেড, পুরোনো ইলেকট্রনিক্স এসবও থাকে

এখানে বাসা ভাড়া ম্যানেজ করে রেন্টাল কম্পানি। (সবসময় এরা বাসার ঠিক মালিক না, আসল মালিকের কাছ থেকে নিয়ে এরা ম্যানেজ করে অনেক সময়)বাসায় ওঠার পর একটা বড় কাজ হল বাসার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা। এটার নামও আছে গালভরা: Move in Sheet। এটাতে বাসার কোথায় কোন খুঁত আছে সেগুলো লিখতে হয়। ভাড়ার একমাসের সমান টাকা দিতে হয় সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে; বাসা ছাড়ার পরে দেখা হয় ভাড়াটে কি কি করেছে, প্রতিটা জিনিসের জন্য একগাদা টাকা কাটে সে সময়। তাই আমরাও লেখা শুরু করলাম, চুলার উপরের লাইট ফিউজড, ল্যাম্পশেড ভাঙা, কার্পেটে দাগ.... শার্লক হোমস মার্কা কারবার আর কি। কারণ, কোন কিছু বাদ পড়লে পরে ঐটার জন্য আবার আমাদের টাকা থেকেই কেটে রাখবে ওরা।
আমাদের জন্য আরেকটা বড় সারপ্রাইজ ছিল এদের বাথরুমের সিস্টেম। আমাদের দেশের মত এদের বাথরুমের সবখানে পানি নিষ্কাশনের সিস্টেম রাখে না। বাথটাব আর বেসিন বাদে বাথরুমের বাকি যায়গায় পানি পড়লে সেটা যাবার কোন বন্দোবস্ত নেই

জানালায় নেট দেয়া - মশা নেই বললেই চলে তবে পোকা মাকড়ের অভাব নেই। আমরা প্রথমে বুঝতাম না, সন্ধ্যার পর ঘরে আলো জ্বলা অবস্থায় দরজা খুললেই পোকা-মাকড় ঢুকে পড়ত।
শুরুর দিনগুলোর কথা মনে আসলে খুব ভয় লাগে। এখন খুব চমৎকার সময় কাটাই টা বলা যাবে না, তবে তখনকার মত অনুভূতি আর নেই।
৪.মোবাইল দিবি কিনা বল:
এখানকার মোবাইল সেবা নিয়ে আমার কিছু ইউটোপিয়া ছিল। আহা, আইফোনের দেশ, থ্রিজি, ফোরজি সব ঘুরে বেড়ায় বাতাসে।

এখানে SSN বলে একটা জিনিস আছে, অনেকটা রোল নাম্বারের মত। যেটা না থাকলে অনেক কিছুতেই আটকে যেতে হয়। শুরুতে SSN পেতে কিছু সময় লাগে। তাই তখন প্রি-পেইডই ভরসা। প্রি পেইড নিতে গিয়ে দেখা গেল যে একমাস মোটামুটি কথা বলার জন্য বিল হল ৫০ ডলার, টেলিফোনের দাম ৩০ ডলার। তবে, সেট ফেরত দিয়ে রিফান্ড পাবার উপায় আছে।
একটা ফোন নেয়া গেল আর সেটা রাখা হল আমার আদার হাফের কাছে। আমি মোবাইল ছাড়া প্রায় দুইমাস মনের আনন্দে ঘোরাঘুরি করেছি। (সে এক বিশাল আরাম


কয়েক দিন পর SSN পেলাম। করলাম AT&T তে ফোনের জন্য দরখাস্ত। তারা রিজেক্ট করে একটা ফোন নাম্বার দিল কথা বলার জন্য। (AT&T ওভার দ্যা ফোন গ্রাহক সেবায় এই দেশে সবচেয়ে কুখ্যাত বলে স্বীকৃত)। ফোন করলাম, তাদের কথা হল অই মিয়া কি নম্বর দিলা (SSN), এর কোন হদিসই নাই। আমি বললাম, নতুন পেয়েছি। বিফল হয়ে কয়েকদিন পর আবার অ্যাপ্লাই করলাম, আবারও সেই একই কাহিনী। এবার অবশ্য বলল, তোমার SSN মনে হয় নতুন, ফ্যাক্স করে পাঠাও। সাথে তোমার পাসপোর্ট, ভিসা এগুলোও দিও। তাও পাঠালাম, কয়েকদিন পর বাসায় চিঠি আসলো: "আমাদের সার্ভিসের প্রতি তোমার আগ্রহ আছে জেনে আমরা প্রীত হয়েছি। তবে তোমাকে আমরা বিশ্বাসযোগ্য (Creditworthy) বলে মনে করছি না। এই মনে করাটা আবার আমরা করি নাই, তোমার ডাটা প্রসেস করেছে অমুক কম্পানি, তুমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারো। আমরা অবশ্যই জেন্ডার, জাতীয়তা, ধর্ম এইসবের বিচারে (Discrimination) তোমাকে আলাদা করে বাদ দেই নাই"



ওরে রে, সমস্যা কিরে ভাই? আমি তো আইফোন চাচ্ছি না। আমি অতি সাধারণসেট আর বেসিক সার্ভিসই চাচ্ছিলাম, সেটাই দিচ্ছে না।


পরে একজন আপার সহায়তায় অবশ্য সমাধান হয়েছিল। উনি নিজের SSN দিয়ে আমাদেরটা অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিলেন। (আপা, আপনাকে এখানে কৃতজ্ঞতা জনিয়ে দিলাম, আবারও

পাঠকদের আরেকটা কথাও জানিয়ে রাখি, এইখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই করুণ, অথচ বিল অনেক অনেক বেশি। বাংলাদেশের মত সস্তায়, এত ভাল নেটওয়ার্ক আর কোথাও পাবেন না। (অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন)
৫.ইন্টারনেট :
আমাকে এখানকার বড়ভাই পরামর্শ দিলেন যে, ওদের থেকে মডেম + ওয়াইফাই রাউটার না কিনে বাজার থেকে কিনে লাগিয়ে নাও, খরচ কম পড়বে। আমি তাই করলাম, মডেম কিনলাম অ্যামাজন থেকে ৬০ ডলারে, আর AT&T থেকে ৩এমবিপিএস ডিএসএল লাইন রিকেয়েস্ট করলাম, মাসে ১৬ ডলার।
আবারো রিজেকশন, তারা ভয়ে আছে আমি যদি মাসে শেষে এই ১৬ ডলার না দিই?

আমি ওদের থেকে বাকিতে কোন ইন্সট্রুমেন্ট নিচ্ছি না, শুধু বাসার বাইরে তারে কানেকশন দেবে। আমি তো ওদের কিছু নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না। (অথচ, এর বিপরীতে এরাই লাখ লাখ লোককে, লাখ লাখ ডলার ধার দিয়েছে, যেটা পরে আর উদ্ধার হয় নি। অথচ, আমাকে ১৬ ডলার বাকি দিচ্ছে না



অবশেষে, আমি ফোন করে ১০০ ডলার অ্যাডভান্স দিয়ে, ১ বছরের চুক্তিতে ইন্টারনেট পেয়েছিলাম।

৬.আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা কি অবৈধ?: এটা বিবিসিতে পড়লাম। দুই দেশের উকিলরা মারামারি করছে বিষয়টা নিয়ে। এটা আসলে টাইমপাস ছাড়া আর কিছুই না। ইংলিশ উকিলরা বলছে যে এভাবে করে হঠাৎ করে বিদ্রোহ করে বসার আইনত: ঠিক না। সবচেয়ে ভাল লেগেছে, এক ভদ্রলোকের কমেন্ট। সে বলেছে, ভাই দেশটা তো আসলে রেড ইন্ডিয়ানডের ছিল, যেটা বৃটিশরা দখল করেছে এবং এটাও আইনত ঠিক না।



[কৃতজ্ঞতা: এইসব ভাইয়া-আপাদের কাছে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। তাদের প্রাইভেসি নষ্ট না করার জন্য তাদের নাম দিতে পারলাম না। তবে, যদি আমার লেখাটা পড়েন, তবে জানবেন যে, আমার/ আমদের এই কৃতজ্ঞতাটা খুবই আন্তরিক।]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ১১:১০