“নে, দুইশো ট্যাকা। কাইল রাইতেরডাসহ মিলাইয়া দিছি”, লুঙ্গির গিঁট থেকে বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল চেহারার মলিন দু'টি নোট এগিয়ে দিলো সারাদিন রিকশা চালিয়ে আসা আবুল।
মুচকি হেসে নোট দু'টো ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে কপট রাগ দেখিয়ে পরী বলে উঠলো, “এরপর থেইকা কিন্তু আর বাকীতে কাম চলবো না, মনে রাইখো কইলাম।”
“হইছে, হইছে মনে থাকবো। এহন আর কথা না বাড়াইয়া চল উত্তরদিকের নিমগাছডার নিচে আন্ধার আছে”, বলতে বলতে আবুল পরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সৃষ্টির আদিমতম খেলায় মেতে উঠতে।
মিনিট বিশেক পর শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঠোঁটে লেপ্টে থাকা লিপস্টিক মুছে নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের নিচে এসে দাঁড়ালো পরী। রাত বাজে দশটা ত্রিশ, ব্লাউজে থাকা কুঁচকানো নোটগুলো বের করে দেখলো সবমিলে তিনশো চল্লিশ টাকা। নাহ, আজ রাতে তাকে কম করে হলেও আরও দুইটা ট্রিপ মারতে হবে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের এপাশটায় টহল দেয়া দালালটা ঠিকই নজর রাখছে ওদের উপর। অন্তত একশোটা টাকা পকেটে পুরে দিতে না পারলে আজ আর নিস্তার পাবে বলে মনে হচ্ছে না। ল্যামপোস্টের হলুদ রঙা সোডিয়াম আলো পেরিয়ে ধবধবে সাদা আলোর জোয়ার আসলেও, নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরূপী এ প্রাণীগুলো আজও অন্ধকারেই ডুবে আছে।
“কিরে, আইজ তো আর কোনো নাগর আইবো বইলা মনে হয়না। বৃষ্টিও শুরু হইলো আবার। ফিইরা যাবি নাকি?”, পরীকে উদ্দেশ্য করে একহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা রূপসা বলে উঠলো।
“নারে, তোরা গেলে যা। আমি আরও ঘন্টাখানিক আছি।”
বৃষ্টির ফোঁটা থেকে গা বাঁচাতে ল্যামপোস্ট ছেড়ে বড় একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। ওদের সাথে বাড়ি ফেরার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও এই দুর্যোগের রাতে একা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে আরও একজন খদ্দেরের আশায়। মাসের আট তারিখ, এরমধ্যেই বস্তির মালিক এসে দুইবার কথা শুনিয়ে গেছে। কাল সকালেই তার ভাড়াটা দিয়ে দেয়া চাই। এদিকে ছোটবোনের পরীক্ষার ফিসের টাকাটাও ঝুলে আছে আজ এক সপ্তাহ ধরে। তাই আজ রাতে এত জলদি ফিরে যাওয়ার কোনো মানেই হয়না৷ বরং ওরা সবাই চলে গেলে একাকী কোনো খদ্দের পাওয়ার আশাটাও কিছুটা বেড়ে যায়।
কড়াইলের বস্তিটায় ছোটখাটো একটা ঝুপড়িতে বিকলাঙ্গ বাবা আর ছোট বোনকে নিয়ে পরীর সংসার। ট্রাক ড্রাইভার রইসউদ্দিন এক্সিডেন্টে দুই পা হারিয়ে এখন হুইলচেয়ার চেপে দিনভর ভিক্ষা করে বেড়ায়। মাঝেমাঝে ছোটমেয়ে জরীকেও সাথে নিয়ে যায় দু'পয়সা বেশি ইনকামের উদ্দেশ্যে। তবে পরী সামনে থাকলে সে সাহস রইসউদ্দিন করতে পারেনা। পরীর ভীষণ ইচ্ছা তার ছোট বোনটা যেন কোনোভাবেই তার মতো এমন অভিশপ্ত জীবনে প্রবেশ না করে৷ তার সর্বস্ব দিয়ে হলেও সে তার লেখাপড়াটা শেষ করাতে চায় তারপর নাহয় তার জীবনের গতিপথ সে নিজেই ঠিক করে নিবে। অন্তত তার মতো যেন স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বিয়ে করে মাতাল স্বামীর নির্যাতন সয়ে শেষমেশ শরীর বিক্রি করে পেট চালাতে নাহয়।
কানের পাশেই হঠাৎ একটা গাড়ির হর্ণে সম্বিত ফিরে পেয়ে পিছনে তাকালো। নিজের অতীতটাকে যতোই ধুয়েমুছে শিকেয় তুলে রাখতে চায় ততই যেনো বারবার আরও নগ্নভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। এখনো তেমনি পার করে আসা স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠায় নিজের অজান্তেই কখন গার্ডেনের পথ ছেড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে ফুটপাত ধরে এগিয়ে এসেছে নিজেরই মনে নেই। সময় তো আর আয়নার মতো থেমে থাকেনা, নদীর স্রোতের মতন বয়ে চলে। তবু দর্পনের প্রতিবিম্বের মতন এক একটি ছবি সময়ের স্রোতের মধ্যেও স্থির হয়ে থাকে।
গাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখলো মধ্যবয়সী এক যুবক হাত ইশারায় তাকেই ডাকছে৷ যাক, বেশ বড়লোক একটা পার্টি পাওয়া গেলো ভেবে মনেমনে কিছুটা খুশিই হলো সে। আলতো হাতে অপরদিকের দরজাটা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসলো পরী। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা যুবকটির দিকে তাকিয়ে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো সে।
‘কেমন আছো, রাহেলা?’, গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে সজল চোখে জিজ্ঞেস করলো যুবকটি।
আজ কতদিন পরে এই নাম ধরে কেউ তাকে ডেকেছে, তাও ঠিকঠাক মনে করতে পারলোনা। তবে তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন চোখে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো প্রশ্নকর্তার দিকে। সেই চোখে যতটা বিস্ময় ছিলো তার চেয়েও বেশি ছিল অভিযোগ।
গ্রামের আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই আটপৌরে এক জীবন ছিল রাহেলার। যেখানে উজাড় করা এক ভালোবাসা ছিল পাশের গ্রামের সেলিম নামে এক ছেলে। কিন্তু হঠাৎই একদিন সেলিম উধাও হয়ে যায় গ্রাম থেকে। এদিকে বাবার চিকিৎসায় শহরে এসে নিঃস্ব হয়ে রাহেলাকে বেছে নিতে হয় ছদ্মনামের এই অন্ধকার জগত।
‘তুমি, তুমি এতদিন পর কোত্থেইকা!’, অনেকটা জড়ানো কন্ঠেই প্রশ্নটা করতে পারলো সে।
‘সে অনেক কথা। সৎ মায়ের সংসারে বেকার জীবন কাটানো কতটা কষ্টের তা আমার চাইতে ভালো কেউ জানেনা। একটা সময় বাধ্য হইয়াই শহরে আসি জীবিকার খোঁজে। কিছুদিনের মধ্যে এই ড্রাইভিং এর চাকরীটাও পাইয়া যাই। কিন্তু গ্রামে ফিরে তোমারে আর খুঁইজা পাই নাই। লোকমুখে শহরে আইছো শুইনা এইখানেও তন্যতন্য কইরা খুঁজছি তোমারে।’
রাহেলার এই পরিণতির জন্যে কি সে নিজেও একইভাবে দায়ী নয়? কিন্তু আজকের জায়গায় দাঁড়িয়ে সে কি পারবে রাহেলাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিতে? এই দ্বিধাতেই কেটে গেছে গত দেশ বারোটা দিন। তার সিদ্ধান্তটা কি আদৌ ঠিক হবে? পরিবার, সমাজ তার আত্মীয়স্বজনের সামনে কি করে মুখ দেখাবে সে? এসব প্রশ্নই প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। তবে সব দ্বিধা আজ ছুঁড়ে ফেলে কড়াইলের বস্তিঘরটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেলিম।
অন্যদিকে রাহেলাও তার এই অন্ধকার জীবনের সঙ্গী করতে চায়না সেলিমকে। তাই নিজের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই সেলিমকে এড়িয়ে চলছে সে। কিন্তু হেরে যাচ্ছে বারবার নিজের কাছে নিজেই। নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে ভালোবেসেছিলো রাহেলা, হয়তো আজও বাসে। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে তার সামনে!
সকালবেলা ঘরের দরজা খুলে বের হতে গিয়ে দেখে সেলিম দাঁড়িয়ে। হাসিহাসি মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বিয়া করবি আমারে?’
নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে চোখের কোণায় যেনো মৃদু অশ্রুকণা টের পেলো রাহেলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২২ দুপুর ২:৩৩