মেশিন দিয় সদ্য কাঁটা মাথার চুলের ভেতর কখনো আঙ্গুল চালিয়ে দেখেছেন? আমি দেখেছি। দুই-দুইবার। আর প্রতিবারই হাত ঝিঁ ঝিঁ করে উঠেছে। কারেন্ট শক খেলে যেমন হয় ।
সে যাক, আমার চুলের কাহিনী শোনার জন্য নিশ্চই এখানে ঢুঁ মারেন নি। তার চেয়ে শুরু করা যাক, শুরু করি একটা কাল্পনিক কথোপকথন দিয়ে -
আনিসুল হকঃ ...তাইলে এই গল্পের নাম রাখা যাক, "রুবা" বা "রুবার জীবন"
ফারুকীঃ না না আনিস ভাই, পাবলিক এই নাম খাবে না, তার চেয়ে রকমারি একটা নাম চাই
ভাই-বেরাদারদের একজনঃ আর্রে খাবে খাবে, পাবলিক বলেই খাবে। হাহাহাহা
আনিসুল হকঃ রুবা হচ্ছে এই গল্পে একজন থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার...
ফারুকীঃ (আনিসুল হককে থামিয়ে) ইউরেকা, ইউরেকা...সিনেমার নাম এইটায় হোক
মজা করছি। নিশ্চই তাদের অন্য কোন কারণ থেকে থাকবে এমন নামকরণের। তবে কারণটা শুধুমাত্র বৈচিত্র আনবার জন্যই, আমার যদ্দুর মনে হয়। কারণ পুরো মুভিটা রুবার প্রেক্ষাপট থেকেই দেখানো হয়েছে। রুবার জীবন, তার বঞ্চনা, তার ছলনা, তার উপলব্ধি, তার প্রেম - সবকিছু রুবাকেই ঘিরে নির্মিত। তাই এই মুভির নামে রুবা থাকা অসম্ভব ছিলনা।
**পরে জেনেছি ফারুকী তার গ্রামারের উপর দুর্বলতার শোধ নিতেই এই নাম রেখেছেন। সে বলছিল গল্পটা হচ্ছে "সে" (স্ত্রীলিঙ্গতে)। তাই "সে" না বলেই এই নাম।
মুভিটা নিয়ে যে পরিমাণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুনেছি তাতে শুরুতেই অনীহা হচ্ছিল দেখার। মনে হচ্ছিল হয়তো "মেইড ইন বাংলাদেশ"-এর মতোন পুরো অখাদ্য বা ব্যাচেলর এর মতোন সেমি-অখাদ্য টাইপ কিছু হবে। তবে মুভিটা দেখে উঠার পরের অনুভূতি আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলবো, ভালো। এবং বাংলাদেশের সমসাময়িক অন্য মুভির তুলনায় অনেক গুণে ভালো। এই যেমন এইখানে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি নেই, বস্তাপচা নাচ নেই, এক্সট্রাদের নির্লজ্জ শরীর প্রদর্শনী নেই, অকথ্য গালিগালাজ এবং খিস্তি নেই, মুভির প্রিন্ট ৭০ দশকের না, কপি-পেষ্ট গল্পও না। তবে অবশ্যই শুধু এইগুলোর জন্য ভালো বলবো না। আরো যা ভালো আছে তার মাঝে আছে - দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক (বাঁশির কাজগুলো অদ্ভুত রকমের সুন্দর হয়েছে), মনোরম লোকেশন, ছবির প্রিন্ট (৩৬ মিমি এ নির্মিত), সিনেমাটোগ্রাফি, গল্প, সংলাপ, পরিচালনা, গান (গানগুলো বোধহয় সবারই ভালো লেগেছে), আর
অভিনয়।
আবুল হায়াতের অভিনয় এই ব্লগেই কোন একজন সহব্লগার দেখে মত দিয়েছেন, তার মতোন বিশিষ্ট এবং বিখ্যাত শিল্পী কি করে এমন নীচু চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। আবুল হায়াত কথাটা শুনলে নির্ঘাত মুখ টিপে হাসতেন। কারণ, তার মানে দাঁড়ায় ওনার অভিনয় একেবারে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে এবং যার মানে হলো গিয়ে তিনি আদতেই একজন ভালো অভিনেতা। এবং আমারও মনে হয় তিনি আরেকবার দেখিয়ে দিয়েছেন উনি আসলেই একজন উঁচু মানের অভিনেতা। মোশাররফ করিমও তার রুল দারুণ করেছে। তবে তপুই বোধহয় এই ছবির অন্যতম চমক। এমন স্বাভাবিক এবং সুন্দর অভিনয় করেছে যে সে তার জন্য আলাদা একটা তালি বরাদ্দ রাখতেই হয়। তিশার কথায় পরে আসছি। তার আগে অন্য দুজনের কথা বলি। প্রথমজন হচ্ছে তিশার খালাত বোনের চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটা। কি মিষ্টি একটা মেয়ে এবং কি মিষ্টি কণ্ঠটা তার এবং তিশার ১৩ বছরের রুল করা ইমদাদুল হকের মেয়েটা। বেশ লেগেছে এই দুইজনের অভিনয়ও। তিশার অভিনয় আমার কাছে বরাবর ভালো লাগলেও এই মুভিতে কেমন যেন মনে হয়েছে তার অভিব্যক্তি গুলো একটা সুরেই ঘুরেফিরে আবদ্ধ হয়ে ছিল। মানছি তার কাধে দায়িত্ব ছিল অনেক। বলতে গেলে প্রায় সব শটেই সে ছিল কিন্তু ভালো অভিনেত্রী হিসেবে সে এই সুযোগটাকে অন্য একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতো। একেবারেই যে পারেনি তা বলবো না। এই যেমন আবুল হায়াতের সাথে সিকোয়েন্স গুলো, শেষের দিকে তার অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়গুলো সে দারুণ করেছে। তাকে চরম রকমের বাজে লেগেছে যখন সে ভেঁও ভেঁও করে কান্না করেছে সেই শটগুলোতে।
ছবির সংলাপের কথা বলি। সংলাপগুলো যেই লিখেছেন তাকে একটা স্যালুট জানায়। কয়েকটা সংলাপের কথা বিশেষ করে বলতে হয় - তিশা যখন কচি খন্দকারের সাথে এক গাড়িতে বসে অলেখনযোগ্য একটা গানটা শুনছিল এবং তাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিশা বলে, "শুধু গান শুনালেই হয়ে যায় আপনার?" । আরেকবার তিশা যখন তার মার সাথে অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে, সেই সময়কার সংলাপগুলো। ফ্যান্টাবুলাস! সেই সিকোয়েন্স টাও হয়েছে অসাধারণ। আমার মতে মুভির সেরা সিকোয়েন্স ছিল সেটি। আরেকটি দৃশ্যের কথা বলি, তিশা যখন তার খালাত বোনের ওখান থেকে চলে আসছিল, তার খালাত বোন তখন তাকে ডেকে বলে, "আর শোন, রাগ টা একটু কমাস, হ্যাঁ"। আহ! সেই দৃশ্যটা। মুহুর্তের জন্য চোখদুটো আদ্র হয়ে উঠতে চাইছিল।
গল্পটা হচ্ছে একটা একাকী মেয়ের ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কিছু কথা। অদ্ভুতুড়ে কিছু নিয়ম-কানুন এবং আমাদের বর্তমান সমাজের নানান বৈষম্য এবং অসঙ্গতিও উঠে এসেছে মুভিটাতে। নিঃস্বার্থ প্রেমের নিদর্শন রয়েছে। আছে হতাশা, অনিয়ম, বঞ্চনা এবং কখনো কখনো ছলনার কিছু চিত্রও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তোবা অতিরঞ্জিত করেছে তবে সব মিলিয়ে বলতে হয় সমসাময়িক একটা গল্প।
এই একটু আগে এই মুভির উপর একটা আড্ডা দেখছিলুম। আনিসুল হক, ফারুকীর পরিচালনা সম্পর্কে বলছিলেন, ফারুকী ব্যাচেলার এবং মেইড ইন বাংলাদেশ থেকে নিজেকে অনেকখানি বদলে ফেলেছেন এই মুভি করতে। আমিও সেই কথার সাথে একমত হব। মনে হচ্ছে নাটকের ফারুকী সিনেমায় বেরিয়ে আসছে। আশা করি সে নিজেকে আরো নতুন নতুন রুপে নিয়ে আসবে আমাদের সামনে। এই ছবিতে পরিচালনার গুণীপনার জন্য তাকে স্যালুট জানায়।
গানগুলোর কথা আলাদা করে বোধহয় কিছু বলার নেই। প্রায় সবগুলো গানই ভালো লেগেছে। তবে বেশী ভালো লেগেছে দ্বিধা গানটায়।
ট্রেইলারঃ
আড্ডাটাঃ Click This Link
দেখে উঠে এই মুভিটাকে রেট করছিলাম ৬ আর ৭ এর মাঝামাঝি রেখে। পরে দেখি IMDB-এর রেটিং ৬.৩। ঠিকই আছে।
http://www.imdb.com/title/tt1514446/
অনইলাইন দেখতে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন। ধন্যবাদ সহব্লগার হুতুমপেঁচাকে মুভিটা দেখবার সুযোগ করে দেবার জন্য।
আমার দেখা ভালোলাগা কিছু মুভির তালিকা
আমার দেখা ভালোলাগা কিছু মুভির তালিকা - ২
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৪৬