কেমন যেন একটা গা ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। গা ঝাকুনি দিতেই আমার জ্ঞান ফিরলো আর বুঝতে পারছি যে আমি হাসছি।
আমাকে একটু দ্বিধায় পড়তে হল! আমি জাগ্রত; ঘুমাইনি কিন্তু কিছুক্ষন ধরে আমি হাসছি; অথচ আমি নিজে জানিনা আমি কেন হাসছি!
তবে আমার মুখে এখনো হাসি লেগে আছে! কিন্তু কেন ? উঠে বসলাম। ডানে তাকালাম।
আমার পাশের বেডে থাকা রোগীটি আজ নেই। আজ বিকেলেই সে রিলিজ পেয়েছে। আরেকজন ছিল দুদিন আগ পর্যন্ত।
সে মারা গেছে! অবশ্য তার সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি গতকাল এসেছি। বামহাতটা পুড়ে গেছে। একটা এমএস রড ওয়েল্ডিং করছিলাম। দুর্ঘটনাবশতঃ যে স্থানে ওয়েল্ডিং করছিলাম সেখানে আমার হাতটা পড়ে যায়! এখন কোন কষ্ট হচ্ছেনা হাতে। খুব হাটতে ইচ্ছা করছে। একটু রুমটার চারদিকে তাকালাম।
বার্ন ইউনিটের ১৩ নাম্বার রুমটাতে আছি আমি। এ রুমটা অনেক বদলে গেছে। আমার সাথে একজন রোগী ছিল। আমি এখানে আসার আগে তার সাথে আরেকজন ছিল। আজ তারা কেউই নেই। আমি একা। সেই দুজনের একজন হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে আর অন্যজন রিলিজ পেয়েছে পৃথিবী থেকে। যে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে তার নাম রমিজ ঠিকানা মহাঙ্গর থানার আশেপাশে কোথাও হবে। আর যে মারা গেছে সে পেশায় একজন ড্রাইভার। তার দুর্ঘটনাটা একটু অদ্ভুত রকমের-
সে খুব গভীর রাত করে তার গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে যখন সে একটা শ্বশ্মানের পাশ ঘেষে গাড়ি চালিয়ে আসছিল হঠাৎই তার গাড়িতে আগুন ধরে যায়! তারপর সেই ড্রাইভারকে উদ্ধার করে আনার ২১ ঘন্টা পর সে মারা গেল! শুনেছি লোকটা নাকি আগুনে পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রনা থেকেও অন্য একটা ব্যাপারে চিন্তিত ছিল! সে কি যেন সব দেখত আর আর্তনাদ করত; খুব অদ্ভুত আর করুণভাবে! এভাবেই সে মারা যায়!
আমি আবার আনমনা হয়ে গেলাম আর সেই আর্তনাদটা অনুভব করলাম। মনে হল চার দেয়ালে একটা প্রতিধ্বনি কম্পিত হল। আবারো ঠিক একইভাবে আমার ঘোরটা কেটে গেল।
আবারো একটা ব্যাপারকে পাগলামী মনে হল। একটা গাড়ি শ্বশ্মানের পাশ দিয়ে গেলেই যে সেটাতে আগুন লেগে যাবে এর কোন যুক্তি আছে ? যান্ত্রিক ত্রুটিও তো থাকতে পারে। আর আমার ভুতে বিশ্বাস নেই; আমি যুক্তিতে বিশ্বাসী। অবশ্য আমার মাথায় এসব চিন্তা বেশিক্ষন ঠেকছেনা। আমি বাইরে যাব। অবশ্য আমি চাইলেও বাইরে যেতে পারতাম না যদি নার্স থাকতো। নার্স গেছে ইমারজেন্সী বিভাগে। আসতে দেরী হবে। আর সাদেক গেছে আমার জন্য ঔষুধ আনতে।
ওরও আসতে কমে দেড় ঘন্টা লাগবে; যদিও এখন রাত দেড়টা বাজে। এই সুযোগে আমার হাটতে বের হওয়া। সাদেকের কথা ভাবলাম। কখনো দেখিনি তাকে নিজের স্বার্থটা খুজেছে। মানুষের জন্য যে মানুষই নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে সাদেক তার অনেক বড় প্রমাণ। আমি তার কোন আত্মীয় হইনা। তার সাথে আমার কদিনেরই বা পরিচয়। দশ কি এগারো মাস। অথচ সে আমার জন্য কি না করছে। হারাম করেছে সে নিজের ঘুম শুধু আমার জন্য।
পৃথিবীটাকে নতুন ভাবে দেখতে হবে; এমনটাই মনে হল। বেড হতে নামলাম। হাতে একটু যন্ত্রণা করছে। এটাকে তোয়াক্কা করলাম না। কয়েক পা হাটতেই ঠান্ডা অনুভব করলাম ভীষণভাবে। এমন হওয়ার কথা না এমন কারন এখন গ্রীষ্মকাল। হাসপাতালে থাকায় আমার অনুভুতি কিছুটা বদলে গেছে। রুম থেকে বের হলাম। হাসপাতালটা নীরব। মানুষজন আছে তবে কারো কারো সাথে তেমন কথা হচ্ছিলনা। হাসপাতালটা প্রাইভেট; কিন্তু অনেক পুরনো। অনেকটা সরকারী হাসপাতালের মত। আমার ডানপাশে বিশাল বারান্দা আরার বামে রোগীদের রুম। গভীর রাত বলে প্রায়ই সবকিছু আলো শুন্য। একটা ভুতুড়ে পরিবেশের মতোই লাগছে সবকিছু। আমি হাটছি করিডোরের মাঝখান দিয়ে। আমাকে যেই দেখছে সেই খুব অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে। সেই চাহনি গুলো আমাকে চিন্তিত করে তু্লছে। অবশ্য আমাকে কেউ রোগী মনে না করাতে মজা লাগছিল। দুই তলা থেকে নেমে এক তলায় এলাম। দুই তিনটে জায়গায় ৭-৮টা মানুষ আছে। আর সবকিছু নীরব নিস্তব্ধ।
এমন সময় দেখলাম একটা স্ট্রেচে করে সাদা কাপর মোড়ানো একজনকে বের করা হচ্ছে। আবার দুজনকে সেখানে স্ট্রেচে করে ঢোকানো হচ্ছে। যারা্ স্ট্রেচে করে বের করছে আর ঢোকাচ্ছে তাদের ভাবসাবে মনে হচ্ছে এগুলো লাশ। উপরে লেখা রুমটার নাম পড়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। সেখানে লেখা ছিল “মর্গ“। সব মানুষের কাছে এটা এক খারাপ জায়গা। ডাক্তারদের জন্য বলছিনা এ কথাটা। কত মানুষ যে এখানে সুন্দর একটা দেহ নিয়ে ঢুকে আর বের হয়.................!
নাহ আর ভাবিনা এসব নিয়ে! সাধারণ একটা ব্যাপার ভাবি। প্রতিদিন কত মানুষ এখানে মারা যায়; অনেকটা যেন মৃত্যুপুরী। আমার হাটার চিন্তাটা হারিয়ে যায়। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। আবারো উলটোপথে হাটি। এবার আমার বামে বারান্দা আর ডানে রোগীদের রুম। বারান্দার বাহিরে দুটো জলন্ত চোখ দেখে আতকে উঠি! একটু সামনে গিয়ে যখন দেখি একটা কালো বেড়াল; তখন একটু স্বস্তি পেলাম। তারপর আবার হাটা শুরু করি। আমার রুমটার দিকে আসতেই একটু অবাক হই। রুমের সামনের বাতিটি নষ্ট! বের হওয়ার সময় খেয়াল করিনি এটা। আরো অবাক হই রুমের বাতির আলো কমে যাচ্ছে! রুমটা অন্ধকার ভাবাচ্ছন্ন। লাইটটা নিভিয়েই দিলাম। বেডে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কে আগে আসবে? সাদেক নাকি নার্স। ভাবছি।
*********
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মনে হল আমার চারপাশে অসংখ্য মানুষ গুনগুন করছে। মাথা থেকে কম্বল সরালাম। চোখ তখনও খুলিনি। নাকে কিছু গন্ধ আসলো। চিহ্নিত করলাম। কিছু পোড়া গন্ধ, মেডিসিন আর একটা বিশ্রী গন্ধ। অনেক সময় লাগলো বুঝতে। কিন্তু এই গুনগুন শব্দ আর এই গন্ধগুলোর সংমিশ্রনে যে কি পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কল্পনায় আসছিল না। তাই বাধ্য হয়ে চোখ খুললাম। আর সম্মুখীন হলাম আমার জীবনের সবচাইতে লোহমর্ষক ঘটনায়।
দেখলাম আমি অনেক বিশাল একটা রুমে শুয়ে আছি আর আমার চারপাশে অসংখ্য সাদা কাপড় মোড়ানো লাশ! আর একটা জায়গায় লেখা “মর্গ“! আমি নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। শুধু অসহায়ের মত তাকিয়ে আছি। অনেক কষ্টে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে মোবাইলটা নিলাম আর সাদেককে ফোন করলাম। আর তখনই দেখলাম আমার আমার পায়ের কাছে দুজন কাফনের কাপড় পড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে! দুজনের চেহারা দেখা যাচ্ছে যাদের মধ্যে আমি শুধু একজনকে চিনতে পারি। একজন হচ্ছে রমিজ। বিকেলে যে এখান থেকে রিলিজ পেয়েছিল। সে আমার দিকে খুব অদ্ভুত আর করুণ ভাবে তাকিয়ে এগিয়ে আসছিল! আর তার পাশের লোকটা আমার কাছে আসছে অতিদ্রুত! আমার মুখের কাছে সে এসে ভয়ানক এক কন্ঠে আর্তনাদ করে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো।
আমার জ্ঞান ফিরতেই সাদেককে দেখলাম। সে খুবই চিন্তিত ছিল। আমাকে জ্ঞান ফিরতে দেখে সে চিন্তা মুক্ত হল। তবে সে আমাকে জা্নালো। সেটা হল গত রাতে সে ঔষুধ আনার সময় আমি তাকে কল দেই। সে রিসিভও করে। কিন্তু সে আমার কোন কথা শুনতে পায়না। আমি তাকে সব খুলে বলি। ওর চেহারা দেখে মনে হল আমার কথা সে বিশ্বাস করেনি। শুধু আমাকে শান্ত রাখার জন্য সে দেখানো বিশ্বাস করেছে আমি নিজেকে খুবই অসহায় বোধ করি।
চারদিন পর আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাই। ডাক্তার আমাকে বলেছে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিতে। সেটা তোয়াক্কা করিনা আমি। সাদেককে নিয়ে আমি ওই ড্রাইভারের পরিবারের সাথে দেখা করি যে ওই হাসপাতালে আমার রুমে মারা যায়। তাদের কাছে আমি ওই ড্রাইভারের একটি ছবি খুজি। তাদের দেওয়া ছবিটা দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই!
এতো সেই লোকটা যে সেই ভয়াবহ রাতে আমার উপর আর্তনাদ করে ঝাপিয়ে পড়ে! কিন্তু সে তো মারা গেছে অনেক আগে তাকে তো আমি কখনো কল্পনা করিনি দেখা তো দূরে থাক! আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলামনা দেখে সাদেক আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। কিন্তু ঘটনার এখনো শেষ হয়না।
দিন তিনেক পরে নিজেকে সুস্থ আর স্থির বোধ করায় আবারো খোজ করায় নামলাম। এবার লক্ষ্য সেই রমিজের যে আমার আগে সুস্থ ভাবে হসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছিল। খোজ পেতে কষ্টই হয়। তাছাড়া সাদেক এবার সাথে নেই। ওয়ার্কশপে আমার কাজগুলো তার ভারে পড়েছে। আমি এক সময় অবশ্য পেয়েও যাই রমিজের ঠিকানা অনেক নাটক করে শেষ পর্যন্ত তার বাসায় যাই। মনে হচ্ছিল এক অজানা শক্তিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। সেখানে গিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। তারপর রমিজের খবর জানতে চাইলাম। জানতে পারলাম সে খুবই মুমুর্ষভাবে বিছানায় পড়ে আছে। সারাদিন সে সব আবোল তাবোল বকে! তার কাছে গেলাম। আমাকে দেখে সে খুব খুশি হয়ে সে বলে, “আপনার অপেক্ষায়ই করছিলাম। ভালোই হলো আপনি আসছেন। আমি তো একা নিতে পারবোনা। এই নেন আপনার ভাগ বুঝে নেন।“ আমি কিছুই বুঝলাম না। কি অদ্ভুত কথা বলছে সে! কিন্তু এর থেকেও অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো যখন লোকটা আমার চোখের সামনেই মারা গেল!
তার পরিবারের সবাই বিলাপ করছে। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে উঠে দাড়ালাম। আমি আবার রমিজের দিকে তাকালাম। ওই ভয়ানক রাতে সে আমার দিকে সে যেভাবে তাকিয়ে ছিল ঠিক এই মুহুর্তে ঠিক একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম আমি।
আজ অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। ওই ঘটনাগুলোর পর আমি অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। অনেক ডাক্তার, সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে কোন ফল না পেয়ে এক হুজুরের শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমার ঘটনার ব্যাখ্যা দিলেন অনেকটা এইভাবেঃ সেই ড্রাইভার যে দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটার জন্য দায়ী অতিপ্রাকৃত একটা শক্তি যেটা সেই ড্রাইভারের উপর ভর করে ওই হাসপাতালের সেই রুমটাতে আসে যেটাতে আমি ছিলাম। তারপর শক্তিটা ভর করে রমিজের উপর। রমিজ মারা যাওয়ার পর সেই অশুভ শক্তিটা ভর করে আমার উপর! তবে শক্তিটা একটা অনির্দিষ্ট সময় পরপর আমার উপর ভর করে! সেটা ঠিক কত সময় পরপর তা ঠিক জানা যায়না। অবশ্য সেই হুজুর আমাকে একটা তাবিজ আর কিছু নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেয় আর বলে যদিও সেই শক্তিটা আর আমার ধারকাছে ঘেষতে পারবে না কিন্তু সেটা আমার উপর একটা চিহ্ন রেখে যাবে; তাতে কোন সমস্যা হবেনা।
ঐ তাবিজ আর নিয়ম কানুন গুলো মেনে চলার পর আমার আর কোন সমস্যা হয়না।
কিন্তু আমি ঘুমের মধ্যে উচ্চশব্দে হাসি অথবা ঘুমানোর আগে অনেক সময় জাগ্রত থাকতেই হাসি কিন্তু আমি বলতে পারিনা যে আমি হাসছি। তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। সাথে কেউ থাকলে ধাক্কা দেয় জানতে চায় আমি কেন হাসছি। আমি উত্তর দেই “কই? হাসছি না তো?“ অথচ আমার মুখে তখনো হাসি লেগে থাকে। কিন্তু কেন হাসি আমি নিজেও জানিনা! এটা জানি শুধু এটাই একটা অদ্ভুত চিহ্ন! এটা আমাকে বইতে হবে সারা জীবন...................
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:০২