আমর বিল মারুফ বা সৎ কাজের আদেশ ও ‘নাহি আনিল মুনকার’ বা অসৎ কাজের নিষেধ। এ কাজ দু’টি করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। বিশেষ করে যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তাদের জন্য ফরজ। তাছাড়া প্রতিটি মুসলিমকে জাগ্রত করা এবং দেশ ও সমাজ বিনির্মাণের জন্য এ এক মহাওষুধ। যুগে যুগে মুসলিম মিল্লাত যত দিন এ কাজের ওপর অবিচল ছিল, তত দিন সম্মানের আসনে সমাসীন ছিল। যখনই বিচ্যুতি ঘটেছে তখনি ধ্বংসের গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেনÑ ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির (পথ প্রদর্শনের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করো, অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো।’
উপরি উক্ত আয়াতে চারটি বিষয় লক্ষণীয় ১. শ্রেষ্ঠ জাতি। ২. মানবজাতির (পথ প্রদর্শনের) জন্য। ৩. সৎ তথা কল্যাণকর কাজের আদেশ এবং ৪. অসৎ তথা অকল্যাণকর কাজের নিষেধ। এই আয়াতে আল্লাহ মানবজাতির অবস্থান, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং জীবন চলার কর্মসূচি দিয়েছেন। এর একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় তখনই আসীন হওয়া সম্ভব যখন সৃষ্টির উদ্দেশ্যসাধন অর্থাৎ মানবজাতিকে হেদায়েতের পথ তথা আল্লাহ ও রাসূলের পথ দেখানো হবে। এ দায়িত্ব পালন ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহিয়ানিল মুনকার’ তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমে করতে হবে। তবে যেকোনো কাজ সবার পক্ষে সমানভাবে করা সম্ভব হয় না। আল্লাহ পাক সূরা ইমরানের ১০৪ নম্বর আয়াতে বলেনÑ ‘তোমাদের মধ্যে এমন এক দল হওয়া চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে। এরাই হলো সফলকাম।’ আল্লাহ পাকের পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং হজরত রাসূলে করিম সা:-এর অসংখ্য হাদিসে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালনের পথ-পলিসি, পদ্ধতি কর্মসূচি ও কর্মনীতি বলে দেয়া হয়েছে। এ সবের তোয়াক্কা না করে আজ আমরা মনগড়া যার যার ইচ্ছামতো ইচ্ছাতন্ত্রকেই সমাজ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছি। দেশ ও সমাজ আজ রসাতলে যাচ্ছে আর জাতি হিসেবে পচনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও বোধোদয় হচ্ছে না। আমরা কেউ কেউ ব্যস্ত আছি শুধুই ঈমান বাঁচানোর কাজে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যে আমাদের দায়িত্ব তা বেমালুম ভুলেই গেছি। দুষ্টের দলন ও শিষ্টের পালন সমাজে নেই বললেই চলে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পাপাচার, মিথ্যাচার আধুনিকতার নামে নগ্নতা-অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ ও মদ-জুয়াসহ ইত্যাকার কাজ আজ মহামারী আকার ধারণ করেছে। এক কথায় খোদাদ্রোহী শক্তির কাছে দেশ ও জাতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনে আমাদের ঈমান-আমল সবই হারাতে বসেছি।
আল্লাহপাক সূরা রায়াদ-এর ১১ নম্বর আয়াতে বলেনÑ ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে।’
ভাগ্য পরিবর্তনের শিক্ষা দিতে গিয়ে হজরত লোকমান আ: তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে বৎস! নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। সৎকাজের আদেশ করবে। অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকবে। তোমার ওপর যে বিপদ-আপদ আপতিত হবে তাতে ধৈর্য ধারণ করবে। এটা উন্নত মনোবল ও সৎ সাহসিকতাপূর্ণ কাজ।’ (সূরা লোকমান ১৭)।
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের কাজ না করলে দেশ-জাতির পরিণতি সম্পর্কে প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেনÑ ‘আল্লাহর কসম! হয় তোমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সৎকাজের আদেশ দেবে ও অন্যায় পাপকাজ হতে লোকদের বিরত রাখবে এবং জালিমের হাত ধরে রেখে তার জুলুম বন্ধ করে দেবে। তাকে অন্যায় পথ থেকে ফিরিয়ে সত্যের পথে পরিচালিত করবে এবং তাকে একমাত্র সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবে। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরস্পরের মনকে পরস্পরের সঙ্ঘাতে পাপ জর্জরিত করে দেবেন এবং শেষ পর্যন্ত পূর্বকালের পাপীদের মতো তোমাদের ওপরও অভিশাপ নাজিল করবেন।’ (আবু দাউদ শরিফ)
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস সামনে রেখে সমাজ কাঠামো ও জাতির ভিত্তিমূলের দিকে তাকালে আমর বিল মারুফ ও নাহিয়ানিল মুনকার না করার পরিণতির ভয়াবহ রূপ দেখা যায়। সমাজে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, কল্যাণকামিতা, মহব্বত, সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ববোধসহ মানবীয় আচার-আচরণ তো পরিলক্ষিত হয়ই না; বরং হিংসাবিদ্বেষ, শত্রুতা পাপ-পঙ্কিলতা; সর্বোপরি সর্বত্র খোদার গজবের চিত্র ফুটে উঠছে। বর্তমানে সমাজের সর্বত্র অশান্তি বিরাজ করছে। মানুষের তৈরি করা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদসহ বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এমতাবস্থায় আমর বিল মারুফের দায়িত্ব পালনের জন্য সত্য কথাটি জাতির সামনে তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি। আর নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালনের জন্য মানবরচিত তন্ত্রমন্ত্রের ব্যর্থতার ইতিহাস আর এর খারাপ দিকগুলো এবং সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এর প্রভাবের চিত্রগুলো তুলে ধরা অপরিহার্য কর্তব্য।
আল্লাহর প্রিয় হাবীব রাসূলে করিম সা: নিজের হাদিসের মাধ্যমে এ দাবিটিই পেশ করেছেন আমাদের প্রত্যেকের কাছে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে করিম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো প্রকার অন্যায় ও পাপকাজ অনুষ্ঠিত হতে দেখলে তার কর্তব্য হলো, নিজের হাত (বা শক্তি) দ্বারা তা পরিবর্তন করে দেয়া। যদি এরূপ করার শক্তি না থাকে তাহলে মুখ দ্বারা এর পরিবর্তনসাধন করা এবং সাহস না থাকলে মন দ্বারা এর পরিবর্তনের (চিন্তা, পরিকল্পনা) কামনা করা আর এটা হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’ (মুসলিম শরিফ)
আরো এরশাদ হয়েছেÑ ‘তোমরা অবশ্যই মারুফের আদেশ করবে, মুনকার হতে নিষেধ করবে এবং কল্যাণময় কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা যেকোনো আজাবে তোমাদের সবাইকেই ধ্বংস করে দেবেন কিংবা তোমাদের মধ্য থেকে সর্বাধিক পাপাচারী, দুষ্টু ও জালিম লোকদের ক্ষমতাসীন নিযুক্ত করবেন। এ সময় তোমাদের মধ্যকার নেককার লোকেরা মুক্তিলাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া-প্রার্থনা ও কান্নাকাটি করবেন। কিন্তু তাদের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল করা হবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ)
পরিশেষে বলব, আসুন আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে নাজাতের জন্য এবং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর বলে দেয়া ও রাসূল সা:-এর দেখিয়ে দেয়া পথপন্থা ও প্রক্রিয়ায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহিয়ানিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন করি এবং ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণবিপ্লবে শরিক হই।