(প্রথম পর্ব)
একটি রাষ্ট্র অনেকগুলো ভিত্তির উপর দন্ডায়মান। এই অঙ্গগুলোই রাষ্ট্রের মৌলিক কর্মসম্পাদনে সাহায্য করে। এটিই রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র। অধ্যাপক গার্নার বলেন, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় রাষ্ট্র হলো এমন একটি জনসমাজ, যা সংখ্যায় অল্পাধিক বিপুল, যা স্থায়ীভাবে কোন নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড অধিকার করে থাকে, যা বাইরের কোন শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন অথবা প্রায় স্বাধীন এবং যার এমন একটি সংগঠিত সরকার আছে যার প্রতি প্রায় সকলেই স্বভাবত আনুগত্য স্বীকার করে।” “The state is a community of persons more or less mumerous, permanently occupying a definite portion of territory, independent of external control and possessing an organised government of which the great body of inhabitants render habitual obedience”). উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত একটি সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “কোন নির্দিষ্ট ভূ-ভাগের মধ্যে আইনের মাধ্যমে সংগঠিত জনসমূহকে রাষ্ট্র বলে।” “A state is a people organised for law withim a definite territory”.
ম্যাক আইভার (Mac Iver) বলেন, “রাষ্ট্র এমন একটি সংঘ, যা সরকারের ঘোষিত আইন অনুসারে কার্য করে। সরকার আইন ঘোষণা করার এবং তা পালন করবার শক্তির অধিকারী। ঐ শক্তির সাহায্যে সরকার নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলার বাহ্যিক ও সার্বজনীন অবস্থা বজায় রাখে।” “The state is an association which acting through low as promulgated by a govermnment endowed to this end with coercive power, maintaining within a community territorially demarcated, the universal external condition of social order”. অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারন্ড লাস্কি (ঐধৎড়ষফ খধংশর) রাষ্ট্র সম্বন্ধে বলেছেন, “আধুনিক রাষ্ট্র ভূখন্ডে অবস্থিত এমন এক সমাজ, যে শাসকগোষ্ঠী ও শাসিত-এ দু’ভাগে বিভক্ত এবং নিজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত অন্য সকল সংস্থার ওপর প্রাধান্য দাবি করে।” “The modern state is a territorrial society divided into government and subjects, claiming within its alloted physical area supremacy over all other institutions.”.
উপরিউক্ত যে-কোন সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে আমরা রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান জনসমষ্টি, ভূমি, সরকার এবং সার্বভৌম ক্ষমতা। রাষ্ট্রগঠনে এদের প্রত্যেকটি একান্ত প্রয়োজনীয়। ইসলামী রাষ্ঠ্র ব্যবস্থার কাঠামোতে এর সবটাই স্বীকৃত। কিন্তু কেউ কেউ ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তাকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রের যতগুলো শর্ত আছে আল্লাহর মনোনিত জীবনব্যবস্থার মধ্যে সবটাই উপস্থিত। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করতে গিয়ে আল্লাহর আল-ইসলামকে বাদ দিয়ে নিজেরাই আজ প্রভুর আসনে বসেছে।
বিশিষ্ট কলামিস্ট এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন-“ধর্মের ইতিহাস ও আবেগকে বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায় না। বাংলাদেশে ইসলাম না থাকলে, পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্তিত্ব রচিত হতে পারত না। কারণ, বাঙালি হিন্দুরা চিরকালই ভারতীয় জাতীয়তাবাদে আস্থা রেখেছেন, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে কোন পৃথক দেশ অথবা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেননি। বাংলাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেঃ ভারত ও পাকিস্তান। এই দু’টি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় হিন্দুত্ব আর মুসলিম চেতনাকে নির্ভর করে। ১৯৭১ সালে আবার পাকিস্তান ভেঙে জন্ম নেয় পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন হতে চেয়েছে, কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধ (Value system) পরিত্যাগ করতে চায়নি”।
”সম্প্রতি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামই বহাল রইল। এই নিয়ে সারা দেশে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ না করেই রিটটি খারিজের আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর দু’সদস্য হলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। আদেশে আদালত বলেন, ‘এ বিষয়ে আর শুনানির কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত পড়ে এসেছি। রিটকারী সংগঠন (স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি) সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রিট করার অধিকার রাখে না। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী ও জগলুল হায়দার আফ্রিক। সরকার পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। সংশোধনীতে ২(ক) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করিবেন। আইনটি একই বছরের ৯ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত হয়।
স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনসহ দেশের ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনকারীদের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। মৃত ১০ জন হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। আবেদনকারীদের মধ্যে এখন জীবিত পাঁচজন হলেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মে. জে. (অব.) সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এদের মধ্যে আবার বদরুদ্দীন উমর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে রিট আবেদন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহারের ঘোষনা দেন। তিনি রিট আবেদনটি পুনরুজ্জীবিত করায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, রিট মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হলেও আমাকে জানানো হয়নি। আমার নামও তার সঙ্গে জড়িত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি, রাজনৈতিকভাবেই আমরা সে সময় আন্দোলন করেছিলাম এবং আন্দোলনের অংশ হিসেবে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন যে পরিস্থিতিতে মামলা করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই।
দীর্ঘদিন পর ২০১১ সালের ৮ জুন হাইকোর্টে একই বিষয়ে সম্পূরক একটি আবেদন করে রিটের শুনানির আবেদন করা হয়। পরে ওই আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম মর্যাদা দেয়া কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রিট আবেদনকারীদের অপর একটি আবেদনে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন। পরে ওই রুল শুনানির জন্য আদালতে উপস্থাপন করা হলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বৃহত্তর এই বেঞ্চ ২৭ মার্চ দিন ধার্য করেছিলেন। ২৭ মার্চ ২০১৬ সোমবার আদালতের আদেশে খারিজ করে দেয়া হলো।” আদালতে থেকে বেরিয়ে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী সুব্রুত চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, দুপুরে আমরা মামলার শুনানির জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু আদালত শুনানি গ্রহণ করেনি। আদালত বলেছেন, যে সংগঠনের নামে এই আবেদনটি করা হয়েছে, তারা এই আবেদন করার যোগ্যতা রাখেন না। এর ফলে আগের মতোই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল থাকল। রিট বাতিলের বিষয়ে আপিল করবেন কি-না সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, রায়ের অনুলিপি পেলে এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর আগেও বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মে অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একজন আইনজীবী গত বছর রিট আবেদন করলে হাইকোর্টে তা খারিজ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ খারিজের আদেশ দেন। ওই বছরের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী। রিটে আইন সচিবকে বিবাদী করা হয়েছিল। পরে শুনানি শেষে সেই আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট।
যে সকল দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম (১) বাংলাদেশ ২) জিবুতি ৩) ইরাক ৪) পাকিস্তান ৫) ফিলিস্তিন ৬) তিউনিসিয়া ৭) আফগানিস্তান ৮) আল-জেরিয়া ৯) ব্রুনেই ১০) কোমোরোস ১১) জর্দান ১২) লিবিয়া ১৩) মালদ্বীপ ১৪) মালয়েশিয়া ১৫) মৌরিতানিয়া ১৬) মরক্কো ১৭) মিশর ১৮) কাতার ১৯) সৌদী আরব ২০) সোমালিয়া ২১) সংযুক্ত আরব আমিরাত ২২) ইরান ২৩) ওমান ২৪) কুয়েত ২৫) ইয়েমেন ২৬) বাহরাইন। যে সকল দেশে রাষ্ট্রধর্ম --- খ্রিস্টান ১) কোষ্টারিকা ২) লিশটেনস্টাইন ৩) মাল্টা ৪) মোনাকো ৫) ভ্যাটিকান ৬) অ্যানডোরা ৭) আর্জেন্টিনা ৮) ডোমিনিকান রিপাবলিক ৯) এল সালভাদও ১০) পানামা ১১) প্যারাগুয়ে ১২) পেরু ১৩) পোল্যান্ড ১৪) স্পেন ১৫) গ্রীস ১৬) জর্জিয়া ১৭) বুলগেরিয়া ১৮) ইংল্যান্ড ১৯) ডেনমার্ক ২০) আইসল্যান্ড ২১) নরওয়ে ২২) ফিনল্যান্ড ,২৩) সুইডেন ২৪) টোঙ্গা ২৫) টুভালু ২৬) স্কটল্যান্ড ২৭) ফ্রান্স ২৮) হাঙ্গেরী। যে সকল দেশে রাষ্ট্রধর্ম --- বৌদ্ধ ১) কম্বোডিয়া ২) শ্রীলঙ্কা ৩) থাইল্যান্ড ৪) মায়ানমার ৫) ভূটান। রাষ্ট্রধর্ম ইহুর্দী ১) ইসরায়েল। (সূত্র: Encyclopedia (link-http://goo.gl/nb7ami)
যারা আজ কথায় কথায় বলেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন তাহলে কোন চেতনার ভিত্তিতে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? তার মুল ভিত্তি কি ছিল? আসলে মুক্তিযুদ্ধ কখনই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হয়নি এটাই সত্য কথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি কখনই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলো না, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার নামগন্ধও ছিলো কি সেখানে? মুক্তিযুদ্ধ কেনো হয়েছিলো বা কেন হতে যাচ্ছে ? এ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান একটি বক্তব্য সবচেয়ে গুরুত্ব রাখে। এ সম্পর্কে ১৯৭১ সালে ৪ঠা জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘গণপ্রতিনিধিদের শপথ: শোষণমুক্ত সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার সংকল্প’ শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রেসকোর্স ময়দানে গণপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠানের খবর। সেই শপথের সময় বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আমরা শপথ করিতেছি- আমরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামীলীগ দলীয় নব নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি, পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নামে; .............................আমরা শপথ করিতেছি- জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এই দেশের আপামর জনসাধারণ আওয়ামীলীগের কর্মসূচি ও নেতৃত্বের প্রতি যে বিপুল সমর্থন ও অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করিয়াছেন, উহার মর্যাদা রক্ষাকল্পে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করিবো” (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৬১২) বঙ্গবন্ধুর আলোচনার দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতিহারের উপর যে বিপুল গণসমর্থন এসেছিলো, সেই গণসমর্থন রক্ষা করতেই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ হয়। এখন কথা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতিহারে কি ছিলো ?
নির্বাচনী ইশতিহারে কি বলা হচ্ছে-“মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ করুন----৬-দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী ইসলাম বিপন্ন করে তুলছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে সেই মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মতো আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে-অঞ্চলে এবং মানুষে-মানুষে সুবিচারের প্রত্যাশী কোনও কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারেনা। আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোনও আইনই এ দেশে পাস হতে বা চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারেনা " (সূত্র: আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতিহার ১৯৭০, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, পৃষ্ঠা: ২৬৫) অর্থাৎ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে: কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোনও আইন হবে না-- এই নীতির উপর ভিত্তি করেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো, স্বাধীন হয়েছিলো বাংলাদেশ।
জাতি হিসেবে আমরা কাগজে কলমে ব্রিটিশ বেনিয়ার কবল থেকে মুক্তি পেলেও তাদের চিন্তার কবল থেকে রেহাই পাইনি। এটি আবার প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশদের আনন্দের বর্ণনা তাই আজো এভাবে- “We must at present do our best from a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons Indians in blood and colour, but in English in tastes, in options in morals and intellect.” অর্থাৎ, যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা শাসন করছিল তাদের সাথে শাসক ইংরেজদের মধ্যে দূতের কাজ করা এবং রক্তে ও গায়ের রঙে ভারতীয় হলেও মেজাজে, চিন্তাভাবনায়, নৈতিকতায় ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ইংরেজ হয়ে যাবেÑএমন একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। যারা ধ্যানে চিন্তা-চেতনায় নাস্তিকতাকেই লালন করে থাকেন তাদের পক্ষে কি সার্বজনীন কোন নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব? আর তাইতো ব্রিটিশদের কেনা গোলামরা এমন এক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করল যা এদেশের মানুষের ঈমান-আকিদা, তাহজিব-তমুদ্দুনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
আজকে এদেশের নাগরিক হয়ে ভিন দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য কেউ কেউ প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালান। দেশের কৃষ্টি-কালচার,তাহজিব-তমুদ্দুন এমনকি ৯০ ভাগ মানুষের সেন্টিমেন্টওে বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেও তারা দ্বিধা করেনা। এটিই বৃটিশদেও পরিচালিত শিক্ষারই ফল।বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা বিতর্ক চলে আসছে। অনেকেরই ধারণা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার কারণেই এদেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বার বার নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আসলেই কি এমন ধারণা সত্য? যারা মনে করেন শুধুমাত্র রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার কারণেই আমাদের দেশের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নানাভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার তা ঠিক নয়।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক, ভারত বিশ্বের অন্যতম উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রÑ সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বলতে কিছু নেই সেখানকার প্রায় আশি শতাংশ জনগোষ্ঠীই হিন্দু বাকি বিশ ভাগের প্রায় চৌদ্দ ভাগই মুসলিম জনগোষ্ঠী। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়ার পরও দিন দিন দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়েই চলছে। সরকারি হিসাব মতে ২০১৫ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে ৭৫১টি এতে কমপক্ষে ৯৭ জন প্রাণ হারিয়েছে আহত ২,২৬৪ জন ? বাড়িতে গরুর গোশত রেখে খেয়েছে এমন গুজবে দেশটির উত্তর প্রদেশের কোনো এক গ্রামে গত বছর মোহাম্মদ আখলাক নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় মুসলিম সাংসদ থেকে গরু ব্যবসায়ীর ওপর হামলার কথা প্রকাশ হয় ভারতের নানা সংবাদ মাধ্যমে। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গার কথা কারোই অজানা নয় যে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল কমপক্ষে ১২০০ মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান।
চলবে------------
সুত্র: Click This Link
ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৭:১২