২০১৪ সালের কথা আগষ্ট মাসে জামালপুর জেলার দেওয়াগঞ্জ উপজেলায় গেলাম । সেখানে আমার ভগ্নিপতির বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করার পর জানতে পারলাম জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে লাউচাপড়া নামে একটি অবসর বিনোদন কেন্দ্র আছে । আমি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ । অবসর বিনোদন কেন্দ্রের নাম শুনে বশে থাকতে পারলাম না । সরকারী ছুটির দিন আমি, আমার ভগ্নিপতি এবং আমার বোনের দেবর সুমন ভাই তিনজন মিলে ভগ্নিপতির অফিসিয়াল মোটর সাইকেল নিয়ে যাত্রা করলাম লাউচাপড়ার উদ্দেশ্যে ।
অপরিচিত এলাকা তাই যাত্রা পথের স্থান সমূহের নাম মনে রাখতে পারিনি । তবে দেওয়ানগঞ্জ থেকে লাউচাপড়া যেতে আমাদেরকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ । যেটুকো মনে পরে যাওয়ার পথে চমৎকার একটি (ভারত, বাংলাদেশ) সীমান্ত, সীমান্তের ওপারে (সম্ভবত জামাল শাহের মাঝার) মাঝার, বকশীগঞ্জ ইত্যাদি অতিক্রম করে চমৎকার সব স্থান দেখলাম । বিশেষ করে বকশীগঞ্জ থেকে লাউচাপড়া যেতে চমৎকার অরণ্য ভূমি অতিক্রম করতে হয়েছে আমাদের। অরণ্য ভূমির রূপ দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না । তবে কিছুটা বিরক্তি লেগেছে এ জন্য যে, যাত্রা পথের ভাল রাস্তার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে গ্রামের পথ বেয়ে কোথাও কাচা রাস্তা, কোথাও আধা পাকা রাস্তার পাওয়া যাচ্ছে । সঙ্গত কারণে বেশ কয়েকটি স্থানে মোটর সাইকেল থেকে নেমে আমাদের তিন জনকেই পালাক্রমে মোটর সাইকেল ঠেলতে হয়েছে। কিন্তু সেই দুঃখ মুছে গেছে যেতে যেতে প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দয্য দেখে । যাত্রা পথের প্রকৃতির আলো-বাতাস আর অপরূপ সৌন্দর্য মুহূর্তেই সকল গ্লানি মুছে দিয়ে মনের ভিতর বইয়ে দিলো আনন্দের ঢেউ।
বকশিগঞ্জ ছেড়ে আমরা যতোই সামনে এগুতে থাকলাম চারিদিকটা যেন ততোই সবুজ হতে লাগল। কোথাও কোথাও চলতি পথে সবুজের খেলা দেখতে দেখতে এক সময়ে এসে পৌঁছলাম চারিদিকে গারো পাহাড়ের সবুজ বন বেষ্টিত লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্রে।
দেওয়ানগঞ্জ থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে দুপুর এগারটায় আমরা পৌছলাম- প্রাকৃতির রূপ লাবন্য আর মনোমগ্ধকর ছোট বড় অসংখ্য সবুজ পাহাড় ঘেরা বকশীগঞ্জের গারো পাহাড়ের ২৬ একর বনভূমি জুড়ে গড়ে তোলা লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্রে । যেখানে প্রকৃতির উজার করা সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত ভারতের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি জনপদের সৌন্দর্য আনন্দ জুড়িয়ে দেয় প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের মনে। লাউচাপড়া যাওয়ার আগে জেনেছিলাম সেখানে- কাঠ ঠোকরা, হলদে পাখি, কালিম পাখি সহ অনেক ধরণের পাখি আছে । আছে সবুজ ঘাসের মাঝে কৃত্রিম লেক এবং পর্যটন কেন্দ্রে একশ পঞ্চাশফুট উচুঁ পাহাড়ের চূড়ায় ষাট ফুট সুরম্য ওয়াচ টাওয়ার। যথারীতি সবগুলো এলাকা ঘুরে দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম ওয়াচ টাওয়ার দিকে ।
সেখানে কিছু লোক অবস্থান করছিল । তাদের সাথে মিলে মিশে আমরা উপভোগ করতে লাগলাম লাউচাপড়ার অপরূপ সৌন্দর্য । এরপর ছোট ছোট পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে আঁকা বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে এক শ পঞ্চাশ ফুট উচু পাহাড়ের চুড়ার ষাট ফুট সুরম্য ওয়াচ টাওয়ারে উঠার জন্য দশ-বারোটি সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা যেতে লাগলাম । ওয়াচটাওয়ারে উঠার পর দেখলাম চারিদিকে সবুজ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনা। দূরে দেখা যায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আকাশ ছোঁয়া সব পাহাড়। চারিদিকটা কেমন যেন ছবির মতো মনে হচ্ছিল। ওয়াচটাওয়ারে দাড়িয়ে চারদিকে তাকানোর পর আমি প্রকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম অন্য কোথাও ।
টাওয়ারের চারপাশে শুধু আকাশ ছোয়াঁ উচুঁ উচুঁ পাহাড় । এ যেন সবুজ গালিচার মোড়া প্রকৃতি। জনাযায়- এসব পাহাড়ের নিচ দিয়ে নাকি প্রবাহিত হয়েছে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণার ধারা। যেখানে শোনা যায় অসংখ্য পাখির কলকাকলি। আমরা অনেক্ষণ বশে থাকলাম ওয়াচ টাওয়ারে । অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম চারপাশ- কোথাও গহীন জঙ্গল আবার কোথাও বৃক্ষহীন ন্যাড়া পাহাড়। এই পাহাড় এ দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে মিলেছে। যেখানে দেখা যাবে- সবুজ পাহাড়ের বুকে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত যাওয়ার অপূরূপ খেলা । লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র এতই সুন্দর যে, দেখে মনে হয়- কোন এক নিপুন চিত্রকর তার রঙের ভান্ডার উজার করে পরম যত্নে অংকন করেছেন মনোলোভা আলপনা। দীর্ সময় বশে থাকার পর অনুমান আড়াইটায় আমরা নামলাম ওয়াচ টাওয়ার খেকে । এরপর লাউচাপড়া পাহাড়ের বিরাট এলাকা জুড়ে উচু নীচু পাহাড় বেয়ে যেতে যেতে দেখতে লাগলাম- আকাশমনি বেলজিয়াম ইউক্যালিপটাস উডলট কড়ই গাছ সহ চেনা অচেনা নানা জাতের লতাগুল্ম আর বাহারি গাছ গাছালির সৌন্দর্য মন্ডিত সবুজের সমারোহ। উচু নিচু পাহাড় পেড়িয়ে নীচে নামতে নামতে আমরা ক্লান্ত হলে গেলাম।
তাই সবুজ ঘাসের মাঝে কৃত্রিম ভাবে তৈরী লেকের ধারে একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিলাম । ততক্ষণে রিমন ভাই (আমার ভগ্নিপতি) খোজ নিলেন ক্যান্টিন কিংবা রেষ্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের তালিকায় কিকি আছে । এ যাত্রায় আমাদের কপাল খারাপ । কারণ ঐদিন লোকসমাগম না থাকার কারণে কোন দোকান পাট খুলেনি । রিমন ভাই বাধ্য হয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু পেয়ারা কিনে আনলেন । আমরা পেয়ারা খেয়ে আবার ঘুরেতে লাগলাম লাউচাপড়ার অপরূপ এলাকা । কিন্তু পেটের ক্ষুধায় আমাদের কাছে পৃথিবী গদ্যময় মনে হচ্ছে । তাই এবার আমাদের যেতেই হবে ।
যদিও লাউচাপড়ায় রাত কাটানো জন্য রয়েছে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে একটি জেলা পরিষদ রেষ্ট হাওউজ এবং একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বাংলো তবুও সেখানে রাত্রীযাপন করার উদ্দেশ্যে আমাদের নেই । তাই যেটুকো সম্ভব শেষবারো মতো লাউচুপড়া দেখে আমারা যাত্রা করলাম বকশিগঞ্জ অতঃপর দেওয়ানগঞ্জের উদ্দেশ্যে ।
এ যাত্রায় দেখে এলাম জামালপুরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বেষ্টিত লাউচাড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র । সঙ্গে করে নিয়ে এলাম জীবনের স্মরণীয় একটি অভিজ্ঞতা
।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৬ ভোর ৬:৪৯