রিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। জ্যাম পড়ল। রিক্সাওয়ালা ঘুরে কথা শুরু করল-
রিক্সাওয়ালা- অমুক জায়গায় গেছিলাম। অনেক ভাড়া পাইলাম। তারপর অনেক ঘুরলাম। কোন বড় ক্ষ্যাপ পাইলাম না।
আমি- মানে মাঝখানে আর কোথাও যান নাই?
রিক্সাওয়ালা- না, এহন আর বড় ক্ষ্যাপ পাওন যায় না। অমুক জায়গায় ১৪০ টাকায় রাজি হইলাম। একটু পর সিএনজি স্ট্যান্ড দেইখা থামাইতে কইল। ২০ টাকা দিয়া নাইমা গেল।
আমি- আপনি দূরে দূরে যান? ছোট জায়গায় যান না, না?
রিক্সাওয়ালা- হ, বড় ক্ষ্যাপ নেই। এইডাই তো নিয়ম। এহন আর বড় ক্ষ্যাপ পাওন যায় না। নটরডেম এ গাড়ি দিছে, ইডেনেও গাড়ি দিছে। একসময় ইডেনে খাড়াইলে অনেক ক্ষ্যাপ পাওন যাইত। মতিঝিলেও পাওয়া যাইত। আগে এমন ও সময় গেছে ক্ষ্যাপ নিয়া কুল পাইতাম না। যাইতে না চাইলে মাইনষে রাগ হইয়া যাইত।
আমি- হুম, “যাবি না ক্যা?” বলত।
রিক্সাওয়ালা- হ, যাবি না ক্যা কইত। রিক্সা ধাক্কা দিয়া ফালায় দিত। এমন অবস্থা আছিল। রিক্সাওয়ালাগো সময় আছিল জিয়ার আমলে। দেশ স্বাধীন হইছে তো বেশি সময় হয় নাই। গাড়ির সংকট আছিল। আমদানি তো করে নাই। মুড়ির টিন চলত রাস্তায়। তখন আমদের কিছু করার সুযোগ আছিল। কিছু করি নাই। খাইছি আর সিনেমা দেখছি ।
আমি- (মনে মনে – তখনকার মুড়ির টিন(মানে বাস) এখনকার বাসের চেয়ে ভালোই ছিল) হু, ভালো সময় থাকলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনা। খারাপ সময় আসলে হায় হায় করে।
রিক্সাওয়ালা- মাথা ঝাকানো + হাসি।
আমি- আপনি যুদ্ধ করছেন?
রিক্সাওয়ালা- ঠিক যুদ্ধ না। কিছু লাগলে দিছি। বন্দুকে তেল দিছি। সাহায্য করছি। আমি বন্দুক ও চালাইছি।
আমি- কোনটা ব্যবহার করছেন?
রিক্সাওয়ালা- রাইফেল ব্যবহার করছি। বেশি চলত স্টেনগান। মেশিন গান কম আছিল। স্টেনগান দিয়া বেশি দূর গুলি করা যাইত না। অনেকে দো নলা বন্দুক ব্যবহার করত। তবে রাইফেলের কারণেই যুদ্ধে জিতা গেছে। এইটা না থাকলে সহজ হইত না। অনেক দূরে গুলি করা যাইত। বোল্ট অনেক শক্ত আছিল। ২৫০ ফিট দূরে গুলি করা যাইত। গাছের আড়ালে গিয়া গুলি করত।
(হয়ত সে ৩০৩ বন্দুকের কথা বুঝিয়েছে।)
আমার ৫ মামা আছিল। সবাই যুদ্ধ করছে। আমার নানা ও যুদ্ধ করছে।
আমি- সবাই একসাথে নাকি বিভিন্ন জায়গায়?
রিক্সাওয়ালা- দ্যাশের একেক জায়গায় করছে।
আমি- সেইসময়টা অনেক কষ্টের ছিল। ছবি দেখছি। রাস্তায় মরা মানুষ পরে আছে।
রিক্সাওয়ালা- অনেক কষ্ট! কত মানুষ মইরা পইরা আছিল! সেইসময় যুদ্ধ না করলে মানুষের মনের মধ্যে কেমন জানি লাগত। এক ঘরে দুই শিয়ানা পোলা থাকলে যদি যুদ্ধে না যাইত তাইলে তো মনে হইব ওরা মুসলিম লীগ করে। যুদ্ধে যাইত মানুষ। অস্ত্র না থাকলেও শাবল নিয়া গ্যাছে দেখছি।
আমি- আপনার বয়স কত ছিল তখন?
রিক্সাওয়ালা- এইতো দশ হইব।
আমি- ট্রেনিং নিতে কি ভারতে যাইত সবাই?
রিক্সাওয়ালা- না, দ্যাশেই ট্রেনিং নিত। কমান্ডার টাইপের লোকেরা ভারতে গেছিল। হ্যারা পরে বীরপ্রতীক হইল। জিয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাগো লিস্ট নষ্ট হইছিল। ভারতের কাছে যেই লিস্ট আছিল সেইটাই রইয়া গেছিল। আজকাল টিভিতে কিছু ভুয়া লোক আহে কথা কইতে। ওরা কিচ্ছু জানে না। সব ভুয়া। সেই সময়ের খবর ওরা জানে না।
(একটু পর)
বাংলাদেশের ছবির( না কি যেন বলেছিল। শুনতে পারি নাই) সাথে ইন্দিরা গান্ধির ছবি থাকা উচিত। এই একটা মহিলা আমগো লেইগা অনেক কিছু করছে। ও না থাকলে স্বাধীন হইতে পারতাম না। ওই তো কূটনীতিকভাবে সারা বিশ্বে আমাগো পক্ষে লড়ছে। ও না থাকলে রাশিয়া থেইকা অস্ত্র আইত না দ্যাশে। আমগো তো প্লেন ও আছিল না।
আমি- ঠিক, যার যা প্রাপ্য তাকে দেয়া উচিত। সে তার স্বার্থের জন্যই করুক আর আমাদের জন্যই করুক, আমাদের উপকার তো হইছে !
রিক্সাওয়ালা- হ, হ্যায় যাই করুক। আমরা একটা স্বাধীন দেশ তো পাইছি। ৫০ বছর নাইলে ১০০ বছর পরে উন্নত হইবই।
(একটু পর )
(হেসে) একটা কথা কই। আমি একটা মিলিটারি মারছি।
আমি- গুলি কইরা নাকি খালি হাতে?
রিক্সাওয়ালা- পিডাইয়া। আমরা পোলাপান মিল্লা হেইডারে মারছি। ওরে অন্য জায়গা থেইকা ধইরা আনছে। খাওয়াইছে, নামাজ পরাইছে। তারপর একদিন নিয়া যাইতাছিল। আমরা দেইখা ফালাইছি। পরে ওরে সবাই মিল্লা পিডাইয়া মারছি। অনেক কইছে ছাইড়া দিতে। আমরা ছাড়ি নাই। বড়রা দেখছে আর আমরা মারছি।
(একটু পর)
খোকারে কিছু কয় নাই কারণ ও হইতাছে চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধা। তারপর কাদের সিদ্দিকি ও ।
(গন্তব্যে এসে পড়েছি।)
স্বাধীনতা পাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার।
আমি- হ্যা, নয় মাসে পাওয়া অনেক বিরাট ব্যাপার। কত দেশ তো অনেক বছর পরে পায়।
রিক্সাওয়ালা- হুউউউ !
(ভাড়া দেয়ার পর)
আমি – আসেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে হাত মিলান।
উৎফুল্ল হয়ে হাত মিলাল। হয়ত আমাকে আল্লাহ হাফেজ বলেছিল। শব্দের কারণে শুনি নাই ঠিক কি বলেছিল।
(কিছু কিছু আলাপ আমার মনে নেই। তাই সেগুলা উল্লেখ করতে পারলাম না। আমার মুক্তিযোদ্ধা পেলে গল্প করার সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছা হয় না। আমার তাদের ভালোই লাগে। এই প্রথম সামনা সামনি কারোও সাথে কথা হল। যা মনে ছিল তাই তুলে দিলাম।)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৫