১৯৪৫ সালের জুন মাসে যখন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কোতে জাতিসংঘ সনদে পঞ্চাশটি দেশ স্বাক্ষর করে। উপনিবেশ বিমুক্তির পরে ১৯৫৫ সালে সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৫। তারপরে জাতি গঠনের নানা ভাঙা-গড়ার মধ্যে এখন মোট রাষ্ট্র সদস্যসংখ্যা ১৯৪। এই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে এক চমৎকার ঘটনা হচ্ছে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভু্যদয়। এই রাষ্ট্রের কথা ১৯৪৭ সালের যুক্তবাংলার (মৃতবৎসা) কথার আগে আর কেউ চিন্তা করেনি। সমাজবিজ্ঞানীরা অবশ্য এদেশের ভাষার মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ সুপ্ত দেখেছিল।
আমাদের সমালোচনা করে বাইরের লোকে কখনো কখনো বলে থাকে হুজ্জতে বাঙাল। হিকমতে চীনের প্রতি-তুলনায় এই দুর্নাম। আমি 'হুজ্জতে' শব্দের বাংলা করেছি অজুহাতপ্রিয়। যাই হোক, বাঙালিরা শুধু হুজ্জতে নয়, হিকমতেও বটে। দেখুন না, ধমর্ীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে তারা লড়কে লেঙে পাকিস্তান ধ্বনি তুললো আর আট বছরের মধ্যে তা পেয়েও গেল।
তারা ভাষিক আত্মনিয়ন্ত্রণের নামে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর দশ বছরের মধ্যেই তা সংবিধানে স্বীকৃতি পেল। হিকমতেরা অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দুই অর্থনীতির কথা তুললো। স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফার কথা বলল। এক মহা উলস্নম্ফনে তাদের অবিসংবাদী নেতা ৭ মার্চ ঘোষণা দিলেন 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' আর বছর না যেতেই জানকবুল মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সামরিক সহায়তায় এবং সোভিয়েট রাশিয়ার ভেটোর কূটনৈতিক সাহায্যে দেশকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করল।
এহেন হিকমতে জাত হুজ্জতেও বটে। দেশে এক উদ্ভট ও অনুদার গণতন্ত্রের অনুশীলন করতে না করতেই দেশের স্থপতি পিতা, যাঁর নামে মুক্তিযুদ্ধ চালিত হয়েছিল, তাকে ও তার পরিবারের প্রায় সকলকেই এক সঙ্গে হত্যা করল। তিন মাস না যেতেই মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারীরাও জেলের অভ্যন্তরে নিহত হল। সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ভেবে একাত্তর সালে কিছু রাজাকার কারাগারে আশ্রয় নিয়েছিল। হুজ্জুতেরা সেই কারাগারকে বধ্যভূমি বানালো।
হুজ্জতদের সরকার দেশ শাসন করে কিন্তু নির্বাচনের তদারকি করতে পারে না। হিকমতেরা তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্ব আবিষ্কার করল। তাদের এই অনন্য অবদান পৃথিবীতে প্রথম। ফলে রাজনৈতিক নিম্নচাপ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। বিচারের শেষ আশ্রয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো। এক-এগারোর ধাক্কায় দেশের রেলটা লাইনচু্যত হল। এখন কী আবার দেশের গাড়িটা রেলপথে চলছে?
হুজ্জতদের সরকার বদলের পর বাজিকররা গানিমার (যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি) বখরা নিয়ে খুনাখুনি করে। দেশের প্রশাসনকে আমাদের লোক দিয়ে ভরে ঢেলে সাজাতে সাজাতে সঠিক পথে চালাতে দু'বছর কেটে যায়। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রক্রিয়াধীন থাকে। প্রত্যেক সরকারের প্রিয় কথা প্রক্রিয়া। প্রত্যেক সরকারের কথা আইন নিজের গতিতে চলবে। তবে সরকার খুনের মামলাসহ সব ধরনের মামলা প্রত্যাহার করতে পারবে। আর প্রত্যাহার করার সময় বা সুযোগ পেরিয়ে গেলে রাষ্ট্রক্ষমা তো আছেই।
হুজ্জতেদের এখনো অনেক কাজ শেষ করতে পারেনি। যে ভাষার বদৌলতে তারা রাষ্ট্রের মুখ দেখলো তাকেই তারা চেনে না। নিজেদের 'বাঙালি' নামের বানান ছয়ভাবে লেখে। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা রাষ্ট্রভাষা চালু করার শপথ নেয়।
হুজ্জতেরা দেশের শেষ আদালতের নির্দেশনা মান্য করে সাংবিধানিক বিধানমতো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্বাচন করেনি। জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবহেলা করে দেশের জলসীমা, মহীসোপান সীমা ও স্থলসীমা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে নির্দিষ্ট করেনি। হুজ্জতেদের অসমাপ্ত কাজের ফিরিস্তি দীর্ঘ না করাই স্বীয় ইজ্জতের জন্য স্বস্তিদায়ক।
তবে দেশের হিকমতে কৃষক ও শ্রমিকরা প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে ঊধর্্বমুখী রেখেছে। দেশের হিকমতে প্রবাসীরা দেশমায়ের জন্য ক্রমাগতভাবে অধিকহারে টাকা পাঠাচ্ছে। দেশের হিকমতে বিজ্ঞানীরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে, কৃষিবিজ্ঞানে উলেস্নখযোগ্য আবিষ্কার করেছেন। দেশের হিকমতে ছেলে এবার এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। দেশের ক্রিকেটাররা যে টেস্ট মর্যাদা বৃথাই পায়নি তার পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এমন হিকমতে দেশ, এমন হুজ্জতে দেশ তুমি তো কোথাও খুঁজে পাবে না!
*****কৃতঞ্জতা স্বীকার: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (লেখাটি উনার, আজকের ইত্তেফাকে প্রকাশিত। দুঃখিত, ভদ্রলোকের অনুমতি ছাড়া কপি পেস্টের জন্য)*******