আজ বাঙালী জাতির আরেকটি গভীর শোকের দিন ! বাঙালী জাতিসত্ত্বা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতর-বাহির করায়ত্ব করে পাকিস্তান কনফেডারেশনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথে ঘাতকরা রাতের আঁধারে পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের জঘন্যতম আরেকটি (পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয় পরিকল্পিত হত্যাকান্ড এবং তিনমাসের মধ্যে দ্বিতীয়) হত্যাযজ্ঞ ঘটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
বুলেটে ঝাঝড়া করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধকে সুনিপুনভাবে পরিচালনা করা প্রধান চার কুশিলবকে। লাশের উপর প্রশ্রাব করে, লাশ থেকে হৃদপিন্ড, নাড়ি-ভুড়ি ছুড়ে, নৃত্য করে, বেয়নেট খুচিয়ে করা হয় অানন্দ উদযাপন।
আর হ্যা, জানেন তো? এই হত্যাকান্ড এবং এই সম্পর্কিত নথিপত্র এমনভাবে ধ্বংশ করা হয়েছে যে, কিছুদিন আগেও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না হত্যাকান্ড ২তারিখে, ৩ তারিখে নাকি ৪ তারিখে ঘটানো হয়েছে!!! হত্যাকান্ডের কুশিলব আমাদের স্বজাতি।
১৯৫২ সালে ভাষার লড়াইয়ে পরাজিত, ১৯৬৪তে রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরাজিত এবং ১৯৭০ সালে ক্ষমতার লড়াইয়ে পযদুস্থ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের ভাষায়, রক্তের কালিতে, নিষ্ঠুরতার প্রলয়ে এই অঞ্চলে পশ্চিমা শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় পশ্চিমাগোষ্ঠি অস্ত্রের ভাষায় শাসনের সিদ্ধান্ত নেয়।
রক্ত, জীবন, সাহসিকতা দিয়ে বাঙালী যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করে তা ছিল হায়েনাদের জন্য অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য এবং নির্বাচনের ফলাফলের মতোই অনভিপ্রেত।
এটুকু পর্যন্ত যা হয়েছে, সবকিছুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্টির রাজনৈতিক অপরিক্কতা, লিপ্সা এবং প্রতিহিংসার ধারাবাহিকতায় খুব কমই ঘাটতি পাওয়া যায়। এখনো ওখানকার রাজনীতি!, নেতৃত্বের, রাষ্ট্রের কি অবস্থা অামরা সবাই জানি। ওদের স্বভাবিক রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী যুদ্ধ আরও কিছুদিন প্রলম্বিত হওয়ার কথা এবং ওদের ক্যাজুয়ালিটি পঞ্চাশ হাজারের মতো হওয়া উচিৎ ছিল।
কিন্তু; কি কারনে হঠাৎ যুদ্ধের মাঠ থেকে শর্তহীন আত্নসমর্পন করেছিলো পাকিস্তান? শুধুমাত্র জেনারেল জ্যাকবের বাকপটুতায় ধরাশায়ী হয়ে নিয়াজী আত্ন-সমর্পনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো? জাতিসংঘ কিছুদিন যুদ্ধ বন্ধ ( সিজ ফায়ার) রাখার জন্য প্রবলভাবে চেষ্টা করছিলো যা পাকিস্তান রাজী না হওয়ার কারনে সম্ভব হচ্ছিলো না! সেই বিষয়ে আলোচনা করতে জেনারেল নিয়াজির অফিসে গিয়েছিলেন জেনারেল জ্যাকব। উনি ফিরে আসেন নিয়াজীকে অাত্ন-সমর্পনে রাজী করিয়ে!! এখানে ইতিহাসবেত্তারা কেনো ম্যাগনিফাইং গ্লাস কেনো ধরছ
যতবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পাকিস্তানের ইতিহাস, স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা-প্রবাহ পড়ি, শুনি বা বুঝার চেষ্টা করি প্রতিবারই আমার কাছে ১৬ই ডিসেম্বর মিথ বলে মনে হয়। মনে হয়, অনেক বড় একটা ধোঁকাবাজী হয়েছে আমাদের সাথে। এই একটা মিথ/ সমীকরন সঠিকভাবে বিশ্লেষন না করার কারনে, বুঝতে না পারার কারনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। চার জাতীয় নেতা হত্যাকান্ড, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা, কিবরিয়া হত্যা, ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতা সম্ভোগ, আজও হায়েনার দল ও তাদের অনুসারীদের দাম্ভিকতা, ষড়যন্ত্র সব একই পথে এগিয়েছে।
ভারতের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানি মস্তিস্কে অবশ্যই বাহিরেরর কোন সুহৃদ পাকিস্তানের গাঁজাখুরি এবং ভ্রান্ত মাস্টারপ্লানটি একটু সংশোধন করে দেন। এটা সম্ভবত ডিসেম্বরের ৪-৬ তারিখের দিকে হবে। দিকভ্রান্ত, সকলদিকেই নিস্চিত পরাজয় এবং ধ্বংশের শংকায় থাকা পাকিস্তানি জানোয়ারগুলো বুঝে হোক অথবা না বুঝে ওদের সামগ্রীক রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিতীয়বার সফলতা লাভ করে। ( প্রথমবার অবশ্যিক ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে দ্বিজাতিত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে জন্মদিতে পারা)।
ওরা স্বাধীন বাংলাদেশের একটা পোট্রেট তৈরী করে। এই পোট্রেটে কে কোথায় কিভাবে থাকতে পারে তার তালিকা করে। সেই তালিকা মোতাবেক পরের কয়দিন চলে নিধনযজ্ঞ। স্বাধীনতা অনিবার্য মেনে রাষ্ট্র দখলের যে মাস্টার প্লান করা হয় সেখানে শত্রুর ধ্বংশ এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন দুটোই যুগপৎ ঘটানো সম্ভব। অসাধারন!!!
প্রাথমিক সাফল্য, কোনরুপ বিচার, শর্তছাড়া সকল সেনা ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। যা কিছু মুহুর্ত আগেও ছিলো অসম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই, যে মৌলিক বিষয়গুলো অর্জনের প্রয়াসে ত্রিশলক্ষ জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল; বাংলাদেশ নাম ব্যতীত রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য সকল মৌলকতায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয় এবং পরাজিত শক্তি নিজেদের স্থলাভিষিক্ত করে!!
রাষ্ট্রের ঊষালগ্নে তালিকা করে কর্মপটূ এবং দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে ফাঁকা করা হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং জাতিসত্বার সকল মৌলিক কূঠুরীসমুহ। এই মাস্টারস্ট্রোকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মৌলিক রক্ষাকবচ চৌকিগুলোর পূর্ন- নিয়ন্ত্রন নেয় পাকিস্তানের গুপ্তচরেরা ।
শেখ মুজিব সহ বাঙালী চেতনার যে বীঁজ সমূলে উৎপাটনের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন কত সহজেই না বাস্তবায়িত হয়! বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়।
সদ্য স্বাধীনদেশে বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সলীল সমাধী ভস্মীভূত করা হয় গৌরবের ইতিহাসকে পরিবর্তন এবং কুশীলব প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। পাকিস্তানি জানোয়ার গুলো এদেশের পাঠ্যবইয়ে হয়ে যায় "পাক-বাহিনী"।!!
অসাম্প্রায়িক, তেজদীপ্ত, আত্ননিয়ন্ত্রনের স্বপ্নে বিহব্বল জাতিকে যুদ্ধের মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দাওয়াই, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগ দুটি শব্দ বাঁদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস, ধর্মতন্ত্র ভিত্তিক নতুন জাতীয়তাবাদ নিয়ে রাষ্ট্রমঞ্চে আসেন মহান বীর, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো যাঁর স্বাধীনতার ঘোষনায় সমগ্র বাঙালী ঐক্যবদ্ধ মুক্তি-সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ-প্রদর্শক।
তিঁনি স্বাধীনতাবিরোধী ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী, পঁচাত্তরের ঘাতকচক্র, চোরাকারবারী, সুযোগসন্ধানী ধনাট্য, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী একিভূত করে সামরিক পোশাকে বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। আইন করে বন্ধ ঘোষনা করেন সকল হত্যার বিচার।
নতুন জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার পথে পরের চার বছরে হত্যা করেন একাত্তরের সন্মুখ রনাঙ্গনে বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্য লড়াই করা সামরিক- বেসামরিক সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। কারাবাস, বাস্তুচ্যুতি, অপঘাতের মাধ্যমে নির্যাতিত করা হয় প্রায় পয়ত্রিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।
প্রনোয়ন করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ তালিকা যখন প্রনোয়ন করা হয়, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত রাজাকার, পাকিস্তানের এদেশীয় বিস্বস্ত সহচর শাহ আজিজ। মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তি, যাচাইকরনের কাজটি পরিচালিত হয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যুদ্ধের পূর্বেই পাকিস্তানের পক্ষগ্রহন করা এবং একাত্তরের পুরোসময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাশ্রমের মিত্র মুসলিম লীগ। আজিজ সম্পর্কে এখানে বলতে গেলে লেখা বড় হয়ে যাবে। আপনারা উইকি বা গুগল করবেন প্লিজ।
আপাতত সমীকরন এ পর্যন্তই। আবার কখনো মন চাইলে লিখবো।
মুক্তিযুদ্ধ আজও গৌরব এবং অহংকারের দ্বিপ্তি ছড়াতে পারেনা। মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিবার প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কিছুদিন আগেই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার নিয়ে ট্রল হয়েছে। গুপ্তঘাতকদের এদেশে আজ প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ, দল এবং জনসমর্থন রয়েছে। এই শক্তি কি কোনদিনও নিঃশেষ হবে? আমরা কি কোনদিনও আশংকামুক্ত হবো?
যা আজ দেখছি, জানতে পারছি, দেশ যেখানে দাড়িয়ে এটা মিরাকল। মিরাকলের নাম শেখ হাসিনা। কোনোভাবেই, কোনো হিসাবেই যে মানুষটির ২০১৮ সালে বেঁচে থাকারই কথা নয়!!
"তোঁমাদের রক্ত ধূলোয় লুটোয়নি,
জীবন হয়নি নশ্বর,
দ্রোহের মূর্ছনায় শাণিত প্রজন্ম,
শকুনীরা আজ ভস্মর"