প্রিয় ও দুর্ভাগা সহযোদ্ধাবৃন্দ,
এমন একটা সময় আপনাদের কাছে লিখছি, যখন সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে “বিশ্বাসযোগ্যতা”! একই ব্যবস্থায় পরিচালিত আমাদের এই ছোট্ট সংসারেও তার ব্যতয় ঘটেনি। হয়ত এই পত্রখানার সামনেও প্রশ্নবোধক আঁকা হবে, মনের মাধুরী মিশিয়ে। তবুও লিখছি। লিখছি কারন, চেতনা, ভালবাসা শব্দগুলোকে শারিরীক ভঙ্গিতে পাশ কাটাতে পারি, কিন্তু মন, মস্তিষ্ক, বিবেক, শিক্ষা, সত্ত্বাকে অস্বিকার করতে পারিনা। দিনের সূর্যকে অবলিলায় অবজ্ঞা করতে পারি কিন্তু রাতের মিষ্টি চাঁদ না দেখার মত নির্লোভ হতে পারিনা। তাই লিখছি। কবিগুরুর কয়েক পংক্তি মনে পড়ল:
কাঁদালে তুমি মোরে, ভালবাসারই ঘায়ে,
নিবিড় বেদনাতে, পুলক লাগে গায়ে।
পরাণে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধাঁরা,
দু:খেরই মাধুরীতে করিলে দিশেহার।
আমি এবং আমার দেখা ডুয়েট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই অস্বচ্ছল। অর্থনীতি অস্বচ্ছল শব্দটি এতবেশি ব্যবহার করেছে যে, শব্দটি বলা হলে দারিদ্রসীমার নিচে বাসকরা একটা করুন সেলুলয়েড আমাদের চোখে ভাসে। কিন্তু ডুয়েট পরিবারের অস্বচ্ছলতার অভিধানে বুদ্ধি, বিবেক, জ্ঞান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ প্রতিশব্দগুলোও অন্তভূক্ত। এত এত অনটনের মধ্যেও আমরা স্বাধীনচেতা মানসিকতাটাকে প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে নিরবে লালন করেছি। লালন করেছি প্রতিবাদী চেতনাকে। ইতিহাস বলে হাজারো আদর্শের, পরিবারের, গ্রামের এবং বয়সের মানুষগুলো রুগ্ন এবং অদৃষ্টের দ্বারা বিড়ম্বিত এই বিদ্যাপীঠের অগ্রযাত্রার দিকপাল। গত তেত্রিশ (৩৩) বছরে এভাবেই গড়ে উঠেছে আজকের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কারোও করুনার নয়, আত্নত্যাগের মহিমায় ভাস্বর, ভালবাসার ডুয়েট।
এমন একটি ন্যায্য ও যৌক্তিক অভাব মোচনের সত্য প্রয়াসে আপনাদের জীবনের মূল্যবান সাতানব্বই (৯৭) দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, যেই অভাব একই সাথে ততোধিক বর্তমান এবং অপেক্ষমান হাজারো সমস্যার একমাত্র কারন। “পতাকা পেয়েছি মানচিত্র চাই” শ্লোগানটি আন্দোলনের ছিলনা। ছিল চেতনার, ভাললাগার এবং ভালবাসার। মানচিত্রবিহীন পতাকা কেবল দায়িত্বের ভারে নুজ্য হতে পারে, কিন্তু কর্তব্য অবহেলা করতে পারেনা। ফলাফলও যৌক্তিকভাবে খুবই করুন।
হাজারো সমালোচনা, অবিশ্বাস এবং আস্থাহীনতার একটি চুড়ান্ত প্রতিযোগীতার মূহুর্তে আন্দোলনের ঝান্ডা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন অপরিসীম বিশ্বাস, ভালবাসায়। আন্দোলনের শেষদিন পর্যন্ত অপার মমত্ববোধ, শ্রম এবং মেধাদিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগীতাও আপনারা করেছেন। এসবই অতীত। পত্রখানা যখন আপনার হাতে তখনও যদি আপনাকে জিজ্ঞেসা করা হয়, আপনার কাছ থেকে মানচিত্রের প্রতি আরও দৃঢ় সহমর্মিতা এবং আমার প্রতি তীব্র ঘৃনাই হয়ত প্রকাশ পাবে। নিজের হারানো সময়ের জন্য দু:খবোধ হওয়াটাও খুবই যৌক্তিক। অনেকে ব্যর্থ আন্দোলন এবং পন্ডশ্রমও নামেও বিশেষায়িত করেছেন।
আন্দোলনটি ছিল মানচিত্রের। সংগ্রাম ছিল নিশ্চয়তার এবং যৌক্তিকতা প্রমানের; যেখানে অস্ত্র আমাদের পতাকা। কখনও কি ভেবেছেন, সত্যিকারের পতাকার মর্যাদা আমাদের ছিল কিনা? আন্দোলন ৯৭তম দিনে গিয়ে পতাকার মর্যাদা আপনারা নিশ্চিত করেছেন এবং সংগ্রামের পথচলার দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন যেখানে আপনাদের অসীম ধৈর্য, ধারাবাহিক অহিংস বিক্ষোভ-কর্মসূচী ও লং-মার্চ ছিল যোগ্যতার পরিমাপক।
সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সকল প্রশাসনিক প্রধানবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ সমঝোতা আলোচনার মাধ্যমে আপনারা শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে আসেন । আজ তার ৪০০তম দিন। যার ২৯৫দিন ছিল সরকারী কর্মদিবস। ভূমি সংক্রান্ত নথি সরকারী এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে গিয়েছে। প্রতিটি ভ্রমনে প্রমান হয়েছে আপনাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা। সবগুলো কাগজ একত্রিত করা হলে হয়ত এক পি.এল এর খাতা হয়ে যাবে। একটি দিনের জন্যও সংগ্রাম থেমে থাকেনি। আমার জন্য পর্বতসমান এই দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিলেন প্রতিষ্ঠানটির জনক, মাননীয় উপাচার্য ড. মো: আলাউদ্দীন স্যার। উনাকে সার্বক্ষনিক সহযোগীতা করেছেন ডুয়েটের শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং অত্র প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (ছাত্র-কল্যাণ) ড. গনেশ চন্দ্র সাহা স্যার। গনেশ স্যার কে প্রয়োজনীয় মুহুর্তে সহযোগীতা করেছেন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ সহ সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীবৃন্দ।
সকল যুক্তি-তর্ক, পরিদর্শন, পরিমার্জন এবং সংশোধনীর পর গত ১৩/০৮/২০১৩ইং তারিখে মন্ত্রনালয় আনুষ্ঠানিক পত্রের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে ডুয়েটের জন্য ০৪একর জায়গা ডিরিজার্ভ করার বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর জন্য ফাইল নোটের প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়। আজ রবিবার, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আমাদের সংগ্রামের যৌক্তিকতার উপহার প্রাপ্তি হওয়ার কথা। কিন্তু না। এই প্রতিষ্ঠানের কোন পর্যায়ের কোন কিছুই সহজ এবং স্বাভাবিক ভাবে অর্জিত হয়নি। দুর্ভোগ কখনোও ডুয়েটকে পিছু ছাড়েনি। অযৌক্তিক ভাবে এবং নিয়মনীতি প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পত্র প্রেরনের বদলে ৪(চার) একর জমি প্রদানের যৌক্তিকতা জানতে চেয়ে আবারো প্রধান বন সঞ্চালক কে চিঠি প্রদান করা হয় গত ১০/০৯/১৩ইং তারিখে। যা আমরা জানতে পারি গত ১১/০৯/১৩ইং তারিখ বিকেলে। আমাদের প্রতি বরাবরের মত চেষ্টা শুরু হয়েছে অবজ্ঞার। আমাদের এই ভূমি ইস্যূ যে আমাদের প্রানের দাবী তা ভূলে গিয়ে করুনা দেখানোর চেষ্টা করছে দায়িত্বশীলরা। আব্দুল্লাহ আল মাসুম, আপনাদের মাধ্যমে তাদের জানাতে চায়, ট্রেনিং জমা দেই নাই। ৪০০দিন আগের সাধারন সৈনিকরা আজ অভিজ্ঞতায় পুষ্ট এবং হাজারগুন শক্তিশালী। চাইলে মন্ত্রনালয়ের সবগুলো দরজায় তালা দেয়ার ক্ষমতা ডুয়েট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাখে।
আমাকে আপনার ৯৭দিন দিয়েছেন। একটি দিনও শপথের বাইরে ভ্রষ্ট হইনি। আহ্বায়কের যে মহান দায়িত্ব আপনারা আমাকে দিয়েছেন, তা পালনের চেষ্টা করেছি। ভূল-ত্রুটি হওয়াও খুব স্বাভাবিক। অমার্জনীয় অপরাধ আমি করি নাই এই বিষয়েও আমি নিশ্চিত। আমি আমার বিদায় বেলায় আপনাদের কাছ থেকে আরও ৩০ঘন্টা সময় প্রার্থনা করছি। এই ত্রিশ ঘন্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্য প্রমানের জন্য, ত্রিশ ঘন্টা চাই ভূমির প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য, ত্রিশ ঘন্টা চাই প্রমাণের জন্য আপনারা ভূল করেননি। ত্রিশ ঘন্টা প্রয়োজন গত ৪০০দিনের উপসংহারের জন্য। সংগ্রাম ভূল ছিলনা। শেষ করব প্রথমে লিখা কবিতার পরের কয়েক চরন দিয়ে যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর আমার জন্য করুন সত্য!
তোমার অভিসারে, যাব অগম পারে,
চলিতে পথে পথে, বাজুক ব্যাথা পায়ে।
সকলি নেবে কেড়ে, দেবে না তবু ছেড়ে,
মন সহে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে!
আব্দুল্লাহ আল মাসুম
আহ্বায়ক, ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ, ডুয়েট।