লালটিপ দেখতে বসছিলাম। লালটিপ একটি পুরোনো মুভি (নতুন মুভি যেভাবে বের হচ্ছে!!); আমার ভাগ্যের ফের, আমাকে ট্রেইলার দেখে আলোচনা করতে হয় মুভি দেখি যখন এটার কথা সবাই ভুলে যায় তখন। ট্রেইলার দেখতে দেখতে এতো পাকা হইয়া গেছি যে ট্রেইলার দেখেই অনেক কিছু বলে দিতে পারি। আর অন্যান্য দেশের মুভি সম্পর্কে না বলতে পারলেও বাংলাদেশের মুভিগুলোর ট্রেইলার দেখে বলা যায়। খুব সম্ভব বাংলাদেশ এক মাত্র দেশে যেখানে মুভির ট্রেইলার হয় ৫ মিনিট! যাহোক, লালটিপের কথা বলছিলাম।
লাল্টিপ নিয়ে বেশ অনেক রিভিউ, মারামারি-কাটাকাটি-গালাগালি হয়েছে। বেশ কিছুতে আমাকে অংশগ্রহন করতে দেখা গিয়েছে। সহব্লগার দূর্যোধন এর এপিক রিভিউ আমার চলচ্চিত্র দর্শন -লালটিপ তো ফেসবুকেই শেয়ার হয়েছিলো এক হাজারের উপর। স্বপন আহমেদের লালটিপ রুপ নিয়েছিলো দূর্যোধনের লালটিপ এ... আজকে কিছুটা দেখে আমি আপনাদের সিনেমা সংক্রান্ত কিছু কথা বলবো - একটু খেয়াল করে শুনুন।
অন্যান্য সব কিছু বাদ দিলেও একটা সিনেমায় প্রধান হয়ে দাঁড়াবে - গল্পের পথ ও গতি। অর্থাৎ, গল্প কিভাবে এগুচ্ছে, চরিত্ররা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে, তাদের মাঝে ডায়ালগ ও অ্যাকশন (মুভমেন্ট) এর লেংথ কি বেশী না কম, গল্পের বর্ননা কি স্লো না ফাস্ট ইত্যাদী ইত্যাদী। এখন আসুন আরেকটু ভাঙ্গি।
-- সাধারনত যে কোন গল্পে বেশ কিছু ভাগ থাকে। সিনেমায় এই ভাগগুলো হলো সিকোয়েন্স। কিছু সিকোয়েন্সে একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক থাকে; কিছু সিকোয়েন্স সম্পূর্ন আলাদা হয়। একজন ফিল্মমেকারের উচিত শুরুতেই প্রতিটি সিকোয়নেস অর্থবহ করা; অথবা বলা ভালো - অর্থবহ সিকোয়েন্স গল্পে রাখা। এরপর কানেক্টেড সিকোয়েন্সগুলোর সাথে কানেকশন তৈরী করা। ধরুন, লালটিপের শুরুতে ধাপাধাপ বেশ কিছু সিকোয়েন্স দিয়ে চরিত্রগুলোর পজিশন এবং সিচুয়েশন সম্পর্কে ধারনা দেয়া হলো - এটা এক অর্থে ভালো - কিন্তু এটা ভালো লাগেনি কারন সিকোয়েন্সগুলো একটা আরেকটার সাথে কানেক্টেড ছিলোনা। দর্শক বিরক্ত হয়েছে এই ভেবে - কইত্তে আইলো এইটা! আগের অমুকের কি হইলো! এর সাথে আগেরটার সম্পর্ক কি! - ইত্যাদী প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হয়েছে বলে। এসব প্রশ্ন কেউ জোরে জোরে ভাবেনা - এগুলো সাবকনসাশ মাইন্ড খেলে থাকে; আর তাই এসবের কারনে শুরুতেই দর্শক বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। আরেকটা ছোট্ট ব্যাপার হলো - গন্তব্য। ছোট্ট হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটা সিকোয়েন্সে সেই সিকোয়েন্সের এবং তার চরিত্রদের গন্তব্য ডিক্লেয়ার করে দিতে হয়। এমন না যে এটা 'MUST DO' - অনেকেই এটা মানেন না; কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা ভিন্নভাবে উপস্থাপনা করেন। উদাহরনঃ লালটিপের শুরুতে ইমন ও ফ্রেঞ্চ মেয়েটা কথা বলতে থাকে - মেয়েটা ইমনকে অফার করে তাকে কোথাও নিয়ে বেরিয়ে আসতে। এখানে খেয়াল করলে দেখবেন - ইমন রাজী হওয়ার সাথে সাথে দুজনকে দেখা যায় কোন একটা রেস্টুরেন্টে। কিন্তু সেই যে তারা এক জায়গায় ছিলো - সেখান থেকে তারা কি করলো, কোথায় গেলো, কিভাবে গেলো - এর কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। এটা লক্ষ্যনীয় যে, তাদের দুজনের সেই সিকোয়েন্সের পরিনতি যে দেখানোই লাগবে এমন নয়; না দেখালেও চলে। কিন্তু আপনি যখন এরক্কম কাজ বারবার করবেন তখন সেটা বাজে দেখাবে এবং বিরক্তির সৃষ্টি করবে। মনে রাখা উচিত - সিনেমা শুধুই কিছু সিকোয়েন্সের সমষ্ঠি নয়; এমনকি এটা সুন্দর সুন্দর কিছু দৃশ্যের সমষ্ঠিও নয়; একটা সিকোয়েন্সের সাথে আরেকটা কো-রিলেশন থাকতে হবে।
আসুন, আরো একটু ভেঙ্গে দেখি। প্রতিটা সিকোয়েন্স হয়ে থাকে বেশ কিছু শট এর সমন্বয়ে সৃষ্টি। এখানেও ক্যারেক্টারদের কানেকশন, তাদের ডিরেকশন, ডায়ালগ অথবা পজ (pause) এর টাইম লেংথ, চরিত্রদের নিজেদের রিলেশন, আশে পাশের দৃশ্য খেয়াল রাখতে হয়। ধরুন দুজন কথা বলছে - আপনি এতো দ্রুত শট পরিবর্তন করতে থাকলেন যে দর্শক চরিত্রদের চোখ দেখতে পারলোনা, দেখতে পারলেও বুঝতে পারলোনা। Once again, দর্শক বিরক্ত হবে। 'চরিত্রের চোখ শুট করো' নামে ফিল্মমেকিং এ একটা ফ্রেজ আছে। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, একটা সিকোয়েন্সে অনেকগুলো ভিন্ন ধরনের শট থাকে (উদাহরনঃ ক্লোজ, মিড, ওয়াইড, লং, বার্ডস আই)... কিন্তু আপনি এটা খেয়াল করেন না যে কেনো এক শটের পর আরেক শট আসে। এটা খেয়াল করে অর্থাৎ এটা ঠিক করে ডিরেক্টর। কারন সে গল্প কোন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখাতে চায়, সেটা সেই ঠিক করে। কিন্তু এটা খুব কমন দুটো শট পাশাপাশি বসালেই হবেনা, একটার সাথে আরেকটার রিলেশন থাকতে হবে; খেয়াল রাখতে হবে যে দর্শকদের চোখে যেনো ধাক্কা না লাগে। উদাহরনঃ আপনি প্রথম শট নিলেন লং, এরপরের শট নিলেম ক্লোজ; লং শটে দেখলাম বিশাল মাঠে একজন দাঁড়িয়ে আছে আর আশেপাশের অনেককিছু এবং এর পরের শটে দেখলাম সেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার শুধু মুখমন্ডল। খেয়াল করে দেখুন - এই যায়গায় দর্শক একটা ধাক্কা খাবে। তাই সাধারনত লং আর ক্লোজ শটের মাঝে একটা মিডিয়াম শট রাখা হয়। এটা যে হতেই হবে এমন না; কিন্তু আপনাকে এটা মাথায় রাখতে হবে। আর তাই আমি বলি - শুট করার আগেই আপনাকে আপনার ফিল্ম মনের পর্দায় নিখুঁতভাবে দেখা শিখতে হবে।
সিনেমা বানানো সোজা; ভালো সিনেমা বানানো কঠিন - বেশ কঠিন।
মাহদী হাসান
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার
সিনেমা পিপলস