এক.
আমরাইতো অভিজিৎ হত্যাকারী, হত্যাকারী হুমায়ুন আজাদের এবং রাজীব হায়দারের।কেননা আমাদের বড়ো একটি বই মেলা আছে। এ মেলাটি আমরা প্রাণপণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি এবং প্রতিবছর উদয়াপন করি একান্ত আবেগে-ভালোবাসায়। আর আমাদের ঘাতক অপেক্ষা করে মেলাটিকে ঘিরে শিকার ধরার জন্যে। এর প্রথম প্রকাশ্য শিকার প্রথাবিরোধী বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ।দ্বিতীয়জন বিজ্ঞান-যুক্তিবাদী লেখক মুক্তমনার প্রধান সংগঠক অভিজিৎ রায়। শাহবাগে আমরা ঘাতকদের ন্যয্য বিচার চেয়ে জমায়েত হয়েছিলোম উত্তাল স্রোতের মত। এটি ক্রমে হয়ে ওঠেছিলো ন্যায় প্রতিষ্ঠার গণজাগরণ মঞ্চ।এটির আবেগে এতোই উত্তাল ছিলাম আমরা যে মাটির গভীর থেকে আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো কথা বলতে শুরু করলো আমাদের আত্মার সাথে। আমাদের চিত্রশিল্পী তরিকুল ইসলাম শান্ত উত্তাল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অধরা স্বপ্নের সাথে মিশে গেলেন। লক্ষ মানুষের স্রোত ও মোটি মানুষের আত্মার সংযোগ কেন্দ্র যে শাহবাগ সেখান থেকেও শিকার চিহিৃত করলো আমাদের ঘাতক। শিকার হলেন মুক্তমনা ব্লগার রাজিব হায়দার রহমান।আমাদের সর্বশক্তিমান ঘাতকেরা কোন অলৌলিক ম্যাজিকের মাধ্যমে শিকার করেন না। তারা অলৌলিকের গায়েবি নির্দেশে কাজ করলেও এই মহামান্যদের শক্তির ভিত্তি তৈরী হয়ে আছে আমাদের মনের মধ্যে।তরে তারা শিকার করে বেড়ান সম্পূর্ন লৌকিকভাবে দক্ষ ও অব্যার্থ কৃতকৌশলে।ঘাতক জানেন তাদের শিকারগুলো যেন অপেক্ষা করছে শিকারীর খোঁজে, কেননা এরা নির্মম নন, মানুষকে বিশ্বাস করেন আর ভালোবাসতে জানেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এরা সবসময় ভীত সন্তস্ত থাকেন না।ফলে তারা অতর্কিতে শিকারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রাচীন কুঠারের আধুনিক সংস্করণ চাপাতি দিয়ে ঘাডের উপরে-কানের নিচে দানবীয় কায়দায় কোপ মারেন প্রথমে। কোপ মারতে থাকেন মস্তিস্ক থেকে স্নায়ুতন্ত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে মগজ বেরিয়ে আসা পর্যন্ত।সার্জিক্যাল অপারেশেনের মত খুবই নিরপেক্ষ এ কোপগুলো। তারপর তারা তাদের ঘৃনার বর্হিপ্রকাশ ঘটায় তথাকথিত নাস্তিকদের নাকে মুখে চোখে ধারালো চাপাতির কোপ মেরে।শেষে ওদের শরীরের অবশিষ্ঠ অংশ ক্ষতবিক্ষত করেন দোজকের শাস্তির ইহজাগতিক প্রদর্শন হিসেবে। অতপর তারা প্রস্তান করেন।আমাদের রাষ্ট্র-পুলিশ তথন জড়ভঙ্গিতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন, কেননা মহামান্য ঘাতকদের শক্তির ভিত রাষ্ট্রের বুকের মধ্যেও আছে। রাষ্ট্র নীরব কিন্তু নিরপেক্ষ নয়। রাষ্ট্রকে যদি জিজ্ঞেস করেন: দশকের পর দশক ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের মহামন্য ঘাতকেরা সৃষ্টি হলেন কিভাবে? রাষ্ট্র তথন কি উত্তর দিবে।
দুই.
ধরা যাক (ক)নামক শাসক দলের সময়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ঘাতকের আঘাতে খুন হলেন।তথন আমরা ভাবলাম (ক)নামক শাসক আমাদের অতি পরিচিত একজন অধ্যাপকের নিরাপত্তা দিতে পারলেন না তাঁর নিজস্ব ক্যাম্পাসে।অতএব(ক)নামক সরকার ব্যর্থ। আমাদের (খ)শাসক দল দরকার। কিন্তু (খ)নামক শাসক দলের সময়ে ব্লগার রাজিব হায়দার রহমান এবং মুত্তমনা বিজ্ঞান লেখক প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় যখন খুন হন তখন আমরা কোন সরকারকে নিরাপদ মনে করবো? সবার উপর তো আছে রাষ্ট্র; যে রাষ্ট্র আমাদের প্রতিপালক আর আমরা করদাতা প্রজা । অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আমাদের রাষ্ট্র ও আমাদের জন্য কিছু তথ্য দিয়েছিলেন তাঁর লেখনিতে। তাঁর ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ উপন্যাসটি যতটা না শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস তারচাইতে বেশি সত্য বাংলাদেশ সময়ের প্রামান্যচিত্র। রাষ্ট্রের জন্য আরো ভয়াবহ তথ্য, যে সত্যটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন সেটি প্রমানিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। অভিজিৎ রায় যে তথ্যগুলো প্রকাশ করছিলেন আমাদের ও আমাদের রাষ্ট্রের জন্য সেটি রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলো নাকি বিপক্ষে! একজন প্রবাসী প্রকৌশলী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় উৎসবে এসে কেন খুন হতে হলো পূর্ব থেকে মৃত্যূ পরোয়ানাকারী ঘাতকদের হাতে। রাষ্ট্র কেন পূর্ব থেকে কোন ব্যবস্থা নিলো না। তাঁর বলিদান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কি খুব প্রয়োজন ছিলো।নাকি এটি খুব প্রয়োজনীয় ছিলো একজন নাস্তিক বিধর্মী বিদেশি নাগরিকের বলিদানের মাধ্যমে আমাদের ধার্মীক আত্মার ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য। বাংলার মহামান্য ঘাতকগণ আপনারা প্রয়াত অভিজিৎ রায় – হুমায়ুন আজাদ – রাজীব হায়দারের মৃত্যুভার নিজের কাধেঁ তুলে নিয়ে পরকালের অশেষ সুখ লাভ করুন।আর অভিজিতের বিক্ষত দেহখানা দানকৃত মেডিক্যাল থেকে আপনাদের ওয়ারিশগণ ইহকালের রোগ-জ্বরা থেকে আরোগ্য লাভ করুন।এ মানুষগুলো ইহকাল ও পরকালে আমাদের অশেষ নেকি ও আরোগ্যের উৎস।কাজেই আমরাই তো এঁদের হত্যাকারী বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৪০