আক্রোশ, সদগতি, অর্ধসত্য খ্যাত ওম পুরি যে ভাল কমেডিয়ান হিসাবে বাণিজ্যিক ছবিকেও জমিয়ে দিতে পারেন, তা প্রথম খেয়াল করি কমল হাসানের চাচী ৪২০ ছবিতে। যারা ছবিটা দেখেছেন, তাদের আশা করি মনে আছে—ধনী পরিবারের হাউস কীপার বা বাটলার এর রিপুগ্রস্ত, ফিচেল আর ধান্দাবাজ চরিত্রে ওম পুরির কথা! আমি বিস্ময়ে চমকে গিয়েছিলাম ওম পুরির অভিনয় দেখে। এর আগে এ রকম হালকা (!) চরিত্রে তাকে কখনও অভিনয় করতে দেখি নাই। কিন্ত স্বীকার করতেই হবে ওম পুরির উপস্থিতি গোটা ছবিটাকে একটা দারুন উপভোগ্য ছবিতে পরিনত করেছিল।
আর ইদানিং ওম পুরি তো গাদা গাদা হিন্দি ছবিতে সব ধরনের চরিত্রেই চুটিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন।
নাসিরুদ্দিন শাহ অবশ্য অনেক আগেই মুল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে তার দক্ষতা দেখিয়েছেন। কখনও নায়ক হিসাবে তার হী-ম্যান ভাব (জ্বলওয়া, হীরো হীরালাল, হাম পাঞ্চ) কখন ও খল চরিত্রে (সারফারোশ, চাহাত, নাজায়েজ...আরো শত শত ছবি)। নাসিরুদ্দিন শাহ বহু বছর আগেই হিন্দি ছবির অন্দর মহলের ঘরের মানুষ হয়ে গেছেন।
ইদানিং আমি খুব ভাবি স্মিতা পাতিলের কথা... সেই ’৮৬ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্মিতা পাতিল যদি অকালে মারা না যেতেন—আমরা তবে এখন ফুলে ফেপে রমরমা হয়ে উঠা এই বলিউডে, কি ভাবে এবং কোন অবস্থানে উনাকে দেখতাম?
এই তিন জনের নাম একসাথে উচ্চারন করলাম, কারন এই তিন জনই প্রায় সমসাময়িক এবং তিন জনই পুনে ফ্লিম ইনস্টিটিউটের গ্রাজুয়েট। তিন জনেরই শুরু ৭০এর দশকে মুল স্রোতের বাইরে ভিন্ন ধারার ছবিতে, সে সময়ের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে এড়িয়ে। এখন যেমন মুম্বাইয়ের ছবির একটাই মুলধারা, সিনেমাগুলোকে বড় জোর ভাগ করা হয়- ভাল ছবি আর মন্দ ছবি, ওয়েল মেড অথবা ডাল (Dull) মুভি হিসাবে, আর আছে বি গ্রেডের কিছু মশালা মুভি। ৭০ আর ৮০ দশকে কিন্ত মুম্বাইয়ের ছবি স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—কমার্শিয়াল মুভি আর ভিন্ন ধারার মুভি। যেগুলোকে আর্ট ফ্লিম, প্যারালাল সিনেমা ইত্যাদি নানান অভিধায় চিহ্নিত করা হতো। শিল্পীদের মধ্যেও এই বিভাজনটা খুব স্পষ্ট ছিল, যারা এদিকে আছে-তারা ওদিকে নাই—জাতীয় ব্যাপার আর কি। নাম মাত্র পারিশ্রমিকে, লো বাজেটে এই সব নির্মিত ছবিকে শিল্পীরা সিনেমা আন্দোলন হিসাবেই দেখত। আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা মূল বিবেচ্য নয়, শিল্প সম্মত গনসচেতনতামুলক ভাল ছবি উপহার দিতে পারাটাই মুল স্বার্থকতা। অনেক সময় উৎসাহ দেওয়ার জন্য ইনসেন্টিভ হিসাবে এ সব ছবিকে ট্যাক্স ফ্রি (প্রমোদকর মুক্ত) ঘোষনা করতো ভারতের রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার।
বলিউডের বাণিজ্যিক ফর্মুলা ছবিকেও যে ওয়েল মেড ছবি হিসাবে মান সম্মত আর্ট ফ্লিমের পাশাপাশি বসানো যায়, তরুন নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া এটা প্রথম দেখান ১৯৮৯ সালে তৈরী পারিন্দা (নানা পাটেকর, মাধুরী, অনিল, জ্যাকি) ছবিতে। স্বম্ভবত আর্ট ফ্লিম আর কমার্শিয়াল মুভির ভেদটা ঘুচে যায় এ ছবির সময় থেকেই। এরপর থেকে আর্ট ফ্লিমের শিল্পী আর কমার্শিয়াল মুভির শিল্পীর বিভক্তিটাও মুছে যেতে থাকে...
কিন্ত আফসোস, স্মিতা পাতিল বলিউডের এই ভিন্ন ধরনের জমানাটা দেখে যেতে পারেন নাই।
বলিউডের টিনসেল জগতে স্মিতা পাতিল ছিল আমার প্রথম প্রেম... আমার কৈশোরের প্রথম মুগ্ধতা। মেয়েদের রুপের আসল কেমিষ্ট্রি যে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায়, মেধার ঔজ্জ্বল্যে, স্মিতা পাতিলকে দেখে আমার প্রথম সে বোধোদয় ঘটে। আসলেই তো- চেহারায় বুদ্ধির ছটা না থাকলে সে আবার সুন্দরী হয় কি ভাবে? দুনিয়ার বোকা সুন্দরীদের নিয়ে কে মাথা ঘামায়? মুম্বাইয়ের গড়পড়তা নায়িকাদের লক্ষ্য করুন... তাদের খুব কম সংখ্যকই পারে- চেহারা থেকে বোকা বোকা ছাপটা মুছে ফেলতে... এমনকি মাধুরী দীক্ষিতের হাসিকে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন—তাকিয়ে থাকুন, এক সময় দেখবেন সব কিছু ছাপিয়ে তার নির্বোধ, অপ্রস্তত এক জোড়া চোখ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে...
আমার সব সময়ই মনে হয়—অসম্ভব ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত আর আত্মপ্রত্যায়ী এক জোড়া চোখই স্মিতার আসল সৌন্দর্য্য। তথাকথিত গ্লামার বিহীন আপাত অগোছালো (শেষের দিকে বলিউডের মেকআপ আর্টিষ্টরা তাকে ঘষে মেজে কিছুটা জাতে তুলেছিলো) অতীব সাদামাটা চেহারা- অথচ এর বিপরীতে- তার মেদবিহীন দীর্ঘ ছিপছিপে তনু, নির্মল নিস্কলুষ সারল্যের হাসি, মেধার ঔজ্জ্বল্যে ঝলমলে তার স্বাধীনচেতা নারীর ইমেজ, স্মিতা পাতিলকে করে তুলেছিল ৮০র দশকের যৌবনদৃপ্ত নতুন আইকনে। যারা পরিস্কার ভাবে জানে সমাজে কোন অবস্থানে সে পৌছতে চায়—তার নারীত্ব তার লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে সে যেমন মোটেই বিব্রত নয়, চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে তার রয়েছে তেমনই পরিস্কার ধারনা।
ফলে পুরুষের প্রতি তার লাস্য, তার মোহময়তা তার শরীরি বিভঙ্গ—সব কিছুই এক অন্য মাত্রার, ভিন্ন প্রকৃতির...
স্মিতা পাতিলের ক্যারিয়ারের শুরু দুরদর্শনে (সরকারী টেলিভীষন) খবর পড়ার মধ্য দিয়ে। দুরদর্শনের এই অডিশন এবং কাজের শুরুটাও বেশ নাটকীয় ভাবে। দুরদর্শনে চাকরি করতো স্মিতার বোন অনিতার বান্ধবী জোৎস্না ক্রীপকার। কৌতুহলী স্মিতা টেলিভীষন স্টুডিওর অন্দরমহলটা কেমন তা দেখার জন্য তার বোন এবং তার বান্ধবীর সাথে হাজির হয় মুম্বাই দুরদর্শন কেন্দ্রে। ঘটনা চক্রে সেদিন ছিল দুরদর্শনে সংবাদ পাঠক/পাঠিকাদের অডিশন। অনিতার বান্ধবী জোৎস্নার আগ্রহে স্মিতা অডিশনে অংশ নেয় এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংবাদ পাঠিকা হিসাবে নির্বাচিতও হয়।
কিন্ত সমস্যা দেখা দিল নিয়োগপত্র দেওয়ার সময়, স্মিতা তখনও কলেজের ছাত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক বিধায় তার সাথে দুরদর্শন কোন চুক্তিপত্র স্বাক্ষর না করে তাকে দৈনিক ভাতার শর্তে চাকরীতে নিয়োগ দেয়। শুরু হয় সংবাদ পাঠে স্মিতার প্রথম ক্যারিয়ার। পরিচিত হয়ে উঠে দুরদর্শনের নতুন মুখ হিসাবে। ফ্লিমসিটি মুম্বাইয়ের অনেকেরই নজর পড়ে তার উপর...
চিত্রপরিচালক শ্যাম বেনেগাল তাদের মধ্যে একজন। তার নতুন ছবি ‘চরনদাস চোর’ এর জন্য তিনি পছন্দ করলেন স্মিতাকে। দেখা গেল বেনেগাল এর ইউনিটের সাউন্ড রেকর্ডিষ্ট হিতেন্দ্র ঘোষ স্মিতার পরিবারকে ভাল ভাবে চেনেন। শ্যাম বেনেগাল ঘোষের মাধ্যমে স্মিতার মা-বাবার কাছে তার অনুরোধ জানালেন। স্মিতার পিতা শিবাজীরাও পাতিল ছিলেন মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী, তার দল রাষ্ট্রীয় সেবা দলের শিশু শাখার হয়ে ছোট থেকেই স্মিতা ও তার বোন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেড়াত, কিন্ত তা সত্ত্বেও পাতিল দম্পতি তাদের মেয়ের ফ্লিম ক্যরিয়ার নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখালেন না। তবে শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন হয়ত এইটা ভেবে যে ‘চরনদাস চোর’ মুলতঃ ছিল শিশুতোষ কাহিনী।
‘চরনদাস চোর’ দেখে পাতিল দম্পতি রীতিমত মুগ্ধ। ছবিতে রাণীর ভূমিকায় স্মিতাকে এত মিষ্টি আর আকর্ষনীয় লাগছিল যে বেনেগাল যখন স্মিতাকে নিয়ে আর একটা ছবি বানানোর প্রস্তাব দিলেন বিদ্যা পাতিল, স্মিতার মা আর না বলতে পারলেন না। শুরু হলো স্মিতার নতুন ছবি ‘নিশান্ত’...
এই বার বেঁকে বসলেন কলেজের প্রিন্সিপাল, স্মিতার বিএ পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকী তখন—তিনি সাফ সাফ বলে দিলেন স্মিতা যদি পরীক্ষা বাদ দিয়ে এই ধরনের বালখিল্যতা নিয়ে মেতে থাকে, তবে তাকে এর জন্য কঠিন মুল্য চুকাতে হবে। বেনেগাল বোঝানোর চেষ্টা করলেন নিশান্ত ঠিক প্রথা মাফিক বলিউডের মশালা পিকচার নয়, এটা অন্য ধরনের ছবি যা প্রিন্সিপাল নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন। তৈরী হল নিশান্ত, স্মিতার দ্বিতীয় ছবি... ছবি সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রিন্সিপাল স্বীকার করলেন-হুমম... দারুন ছবি, এর জন্য দু চারটা ক্লাস মিস দেওয়া যায় বটে।
‘ভূমিকা’ ছিল স্মিতাকে নিয়ে শ্যামের তৃতীয় ছবি, যে ছবি স্মিতাকে সর্বভারতীয় পরিচিতি এনে দেয়। প্রথম বারের মতো স্মিতা সেরা অভিনেত্রীর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভুষিত হন।
এর পর থেকেই বলিউডের মুলধারার ছবি তথা কমার্শিয়াল ছবিতে অভিনয়ের অফার আসতে শুরু হয়, কিন্ত স্মিতার দৃঢ় সিদ্ধান্ত- যে সব ছবিতে নারীকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে এবং যা নারীর জীবন সংগ্রামকে মর্যাদা দেয় না এমন ছবিতে তিনি অভিনয় করতে পারেন না।
নিজের নারীবাদি চিন্তা ও এক্টিভিজমের সাথে তিনি কিভাবে আপোষ করবেন?
পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০০৯ রাত ১২:৪৯