[এই সিরিজের আগের পোস্টটি রয়েছে এখানে: view this link]
৩) অমুসলিমদের অবিশ্বাসী মনে না করা।
মুসলিমদের মাঝে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত বিষয় মনে হয় এইটা। অনেক উদারপন্থী সেক্যুলার হিউম্যানিস্ট মুসলিম হয়তোবা এই পয়েন্টটা শুনে ভ্রু কুঁচকাবেন – ভাববেন তা কি করে হয়। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে এই পয়েন্টটির যথার্থতা যে কারো কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে ইনশা’আল্লাহ্! আসুন আমরা নীচের পয়েন্টগুলো ভেবে দেখি:
ক) এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গেলে যে কারোই মনে হবে যে, ইসলাম একটা exclusive ধর্ম। মুসলিমরা নিজেদের সবার থেকে আলাদা মনে করেন এবং ভাবেন যে, তারাই ঠিক – তারাই শুধু জান্নাতে যাবেন, কিন্তু অন্যদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুঃসংবাদ। তারপরে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে, আসলে সকল ধর্মই exclusive, আর সেই exclusivity-র মাত্রা প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইসলামের চেয়ে অনেক অনেক বেশী।
সাধারণভাবে প্রসার, প্রভাব ও ভিত্তির নিরিখে যেগুলোকে world religion বা superior religion বলা হয়ে থাকে, সেগুলো তো বটেই, বরং যে সব ধর্মাবলম্বীদের এই সব world religion -এর অনুসারীরা ইংরেজী ভাষায় heathen বা pagan বলে সম্বোধন করে থাকেন, তারাও এই exclusivity-র ব্যাপারে কম যান না। আমার নানীর বাড়ীর গ্রামাঞ্চলে, দূর-সম্পর্কে আমার এক নানার মায়ের মাথায় একটু গন্ডগোল ছিল – অথচ, নানা ছিলেন আত্যন্ত মেধাবী। একদম সাধারণ ঘরের ঐ আধ-পাগল মায়ের সন্তান, আমার সেই ইয়াতিম নানা নিজ মেধাবলে একের পর এক সিঁড়ি টপকে সরকারী চাকুরীর সর্বোচ্চ প্রান্তে পৌঁছে ছিলেন! যাহোক, ঐ মহিলা একদিন আমার নানী-বাড়ীর লোকালয়ে মিষ্টি (লবঙ্গ, জিলাপী ইত্যাদি) বিক্রী করে জীবিকা উপার্জনকারী এক “পাল” পরিবারের রান্নাঘরে ঢুকে পড়লে, তারা ঐ ঘরের সমস্ত বাসন-কোসন বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কারণ মুসলিমদের তারা untouchable জ্ঞান করতো। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিমচন্দ্রের মত ব্যক্তিত্বরা যে উপমহাদেশের “মোছলমানদের” ম্লেচ্ছ বা যবন ডাকতে কোন রাখঢাক করেন নি – সেটা ঐ exclusivity-র বোধ থেকেই। যারা সৈয়দ মুজতবা আলীর “নেড়ে” গল্পটি পড়েছেন, তারা সহজেই বুঝবেন আমি কি বলতে চাইছি। সে দিক থেকে মুসলিমরা কখনোই অন্য ধর্মীয়দের “অস্পৃশ্য” মনে করে নি - বরং খাদ্য-দ্রব্য হারাম না হলে, মুসলিমরা যে কারো ঘরে, যে কারো হাতের রান্না খেতে পারে।
এটা সবার জানা যে, চাইলেই ইহুদী বা হিন্দু ধর্মে কেউ ধর্মান্তরিত হতে পারেন না। আবার ইসলাম এবং খৃষ্টধর্মের দরজা অন্যদের জন্য সবসময়ই খোলা – যে কেউ চাইলে এই দু’টি ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে পারেন। এমনিতে খৃষ্টধর্মের প্রচারকদের দেখলে মনে হতে পারে যে, বিশ্ব মানবতার জন্য ভালোবাসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তারা। কিন্তু আসলে তারা evangelism –এর তাড়নায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপরে নানারকমের ভালোবাসার ফাঁদ পাতেন – যদিও ভেতরে ভেতরে ভিন্নধর্মীদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখেন তারা এবং তাদের devil, beast, savage, satan ইত্যাদি নানা উপাধি দিয়ে থাকেন। কেউ চাইলে আন্তর্জালে একটা সার্চ দিলেই দেখবেন যে, আমাদের রাসূল (সা.)-কে villify করতে কত শত সহস্র ওয়েব-পেজ উৎসর্গ করেছেন তারা – আর কত মিথ্যাচারে সে সব পাতা ভরে তুলেছেন [কেউ চাইলে ক্যারেন আর্মস্ট্রং লিখিত মুহাম্মদ (সা.)-এঁর জীবনীর “Muhammad the Enemy” অধ্যায়টা দেখতে পারেন – তিনি রাসূল (সা.)-কে নিয়ে পশ্চিমা মিথ্যাচারগুলোর প্রধান প্রধান কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন সেখানে] । অথচ ঈসা (আ.) বা মূসা (আ.)-কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কোন বিশ্বাসী মুসলিমের একটি লেখাও খুঁজে পাওয়া যাবে না ইনশা’আল্লাহ্! exclusive হলেও বিশ্ব-ধর্মগুলোর মাঝে ইসলামই সবচেয়ে উদার বলা যায় – একদিকে এই ধর্মে প্রবেশ করা মাত্র যে কেউ যেমন এই ধর্মাবলম্বীদের সবার একজন হয়ে যায় এবং মুসলিম হিসেবে আর সকলের মতই তার কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তেমনি অপরদিকে জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা ইসলামে একেবারেই নিষিদ্ধ একটা ব্যাপার (দেখুন: কুর’আন, ২:২৫৬)।
খ) রাসূল (সা.)-এর নবুয়তের ২৩ বছর কাল ধরে ইসলাম একটু একটু করে পূর্ণতা/বিকাশ লাভ করেছিল বা বলা যায় evolve করেছিল। এই সময় আহলে কিতাব (ইহুদী/খৃষ্টান) সহ সকলের ইসলামে আত্তীকরণের সহজ সুযোগ ছিল – এবং অনেকে সেই সুযোগ গ্রহণও করছিলেন। বিশেষত রাসূল (সা.)-এঁর মদীনা জীবনের প্রথমদিকে ১৭ মাস সময়, যখন জেরুজালেমের দিকে মুখ করে (অর্থাৎ জেরুজালেমকে কিবলা করে) মুসলিমরা সালাত আদায় করতেন – ঐ সময়টাকে আহলে কিতাবদের জন্য (বিশেষত ইহুদীদের জন্য) একটা window of opportunity বলে উল্লেখ করেছেন অনেক স্কলার। রাসূল (সা.) আশা করেছিলেন যে, আহলে কিতাবগণ স্বভাবতই তাঁর নিয়ে আসা সত্য ধর্মে প্রবেশ করবে। তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, তিনি সকল মানবকুলের জন্য প্রেরিত শেষ নবী। যেমন দেখুন নীচের আয়াতে আল্লাহ্ বলেন:
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
“বল, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যাঁর রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে।“ (কুর’আন, ৭:১৫৮)
এছাড়া নীচের হাদীসটি থেকেও আমরা জানতে পারি যে মুহাম্মদ (সা.)-কে গোটা মানবকুলের জন্যই নবী হিসাবে পাঠানো হয়েছে:
জাবির ইবন আবদুল্লাহ আল আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমাকে পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কাউকে দেয়া হয়নি; ১/ প্রত্যেক নবীকে বিশেষ ভাবে তার গোত্রের প্রতি পাঠানো হয়েছে, আর আমাকে পাঠানো হয়েছে লাল-কাল সবার প্রতি ২/ আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে, আমার পূর্ববর্তী কারও জন্য তা হালাল ছিল না; ৩/ আমার জন্য সমগ্র ভূপৃষ্ঠ পবিত্র, পবিত্রকারী ও মসজিদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে সুতরাং যেখানে যার সালাত (নামায)-এর ওয়াক্ত হবে, সেখানে সে সালাত (নামায) আদায় করে নিবে ৪/ আমাকে প্রবল প্রভাব দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, যা এক মাসের ব্যবধান থেকে অনুভূত হয়; ৫/ আর আমাকে সুপারিশ করার অনুমতি দান করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম অধ্যায়ঃ মসজিদ ও সালাতের স্থান হাদিস নাম্বারঃ ১০৪৪)
তাছাড়া কুর’আনের আরো অন্য আয়াতসমূহ থেকে আমরা জানতে পাই যে, একটু একটু করে যাবতীয় বিধি-বিধান সমেত আল্লাহ্ মানুষের জন্য তাদের জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং ইসলামকে তাদের জন্য একমাত্র দ্বীন হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। রাসূল(সা.)-এঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে, বিদায় হজ্জ্বের মাঠে নাযিল হওয়া একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ
“....আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।.... “(কুরআন, ৫:৩)
গ) উপরে আলোচিত পটভূমিতে, আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা যে ইসলাম তা স্পষ্ট করে কুর’আনে আল্লাহ্ বলেন:
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآَيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা মতানৈক্য করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত।“ (কুর'আন, ৩:১৯)
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।“ (কুর'আন, ৩:৮৫)
একই ধারণা রাসূল (সা.)-এর হাদীসে প্রতিফলিত হয়:
“আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদের জীবন। এ উম্মতের যে কেউ চায় সে ইহুদি হোক বা নাসারা হোক - আমার রিসালাতের কথা শুনলো, অথচ আমি যা নিয়ে এসেছি তার উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, সে অবশ্যই জাহান্নামের অধিকারী হবে।“ (সহিহ মুসলিম)
উপরের পয়েন্টগুলোর সারমর্ম সাদামাটা ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় যে, রাসূল (সা.)-এর মিশন শেষে, ইসলামের মানদন্ডে, পৃথিবীর দ্বীন/ধর্মগুলো মাত্র দু’টোতে এসে ঠেকে – দ্বীন আল-ইসলাম এবং দ্বীন আল-কুফর – হয় কেউ একজন মুসলিম, আর তা না হলে সে একজন কাফির বা অবিশ্বাসী। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, “কাফির” কোন গালি নয় – বরং এটা কারো ঈমানগত একটা অবস্থার নাম। যে আল্লাহ্ ও আখেরাতে তথা ইসলামে বিশ্বাস করে সে যেমন মুসলিম/মু’মীন, তেমনি যে বিশ্বাস করে না সে একজন কাফির। এটা একটা বিশ্বাসগত বিভাজন রেখা যা কি না গোত্র, বর্ণ, জাতিসত্তা বা মানচিত্রের variable নয়। কেউ যদি এই বিভাজনে বিশ্বাস না করে, তবে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে – তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। তার মানে এই নয় যে আমরা অবিশ্বাসীদের প্রতি একটা মার-মার কাট-কাট দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করবো! আল্লাহ্ আমাদের বলেন:
لَا يَنْهَاكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।“ (কুর’আন, ৬০:৮)
এই ব্যাপারে আরো জানতে দেখুন:
view this link
view this link
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:০৩