somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোটা আন্দোলন

১৫ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এককালে সাউথ আফ্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ক্রিকেট দল ছিল। হান্সি ক্রনিয়ের সময়ের কথা বলছি। বর্ণবাদের অভিযোগে ২২ বছর নির্বাসন শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেই ওরা দাপট দেখাতে শুরু করে। বারবার ভাগ্যের কাছে পরাজিত হলেও ১৯৯৮ সালে বিশ্বের প্রথম "নক আউট ওয়ার্ল্ডকাপ" (পরবর্তীতে সেটাই আজকের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রূপ নেয়) ওরাই জিতেছিল। ৯৯ সালের বিশ্বকাপে ওরাই হট ফেভারিট দল ছিল। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেই অদ্ভুতুড়ে টাই না হলে ওরাই হয়তো সেই আসরের চ্যাম্পিয়ন হতো।
তো সাউথ আফ্রিকায় তখন সাদা খেলোয়াড়রাই বেশি খেলতেন। এমন নিয়ম ছিল না যে কালোরা খেলতে পারবে না। নিয়ম ছিল, যে ভাল খেলবে সেই সুযোগ পাবে।
১৯৯৯ সালের দিকে ওদের সরকার কোটা সিস্টেম চালু করলো। দলে মিনিমাম এতজন কালো খেলোয়াড় রাখতেই হবে।
ক্যাপ্টেন ক্রনিয়ে "রেসিস্ট" কখনই ছিল না। ক্রিকেট ছিল ওর জীবন, ক্রিকেটই ওর ঘর সংসার। দলের অভিভাবকও সে। প্রতিটা খেলোয়াড় ওকে বাপের দৃষ্টিতে দেখে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, "আমি তাহলে আমার খেলোয়াড়দের কি বলবো? শুধুমাত্র সাদা চামড়ার কারণেই সে দলে সুযোগ পাবে না?"
সাউথ আফ্রিকান দলে মাখায়া এনটিনি, হার্শেল গিবস, লান্স ক্লুজনার, রাবাদা ও লুঙ্গি ছাড়া আর কয়জন কালো খেলোয়াড় সেভাবে নাম করতে পেরেছে বলতে পারেন? যাদের নাম বললাম, ওরা নিজেদের প্রতিভায় এমনিতেও সুযোগ পেত। ক্লুজনার, গিবস প্রমুখরা এই কোটা সিস্টেমের আগে থেকেই সাউথ আফ্রিকা দলের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট দলে সমীহ জাগানিয়া দল, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিভা ও যোগ্যতা থাকার পরেও অস্ট্রেলিয়ার মতন "সর্বকালের সর্বসেরা দল" গঠন করতে পারে না।

এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকেই বিবেচনায় নেয়া যাক।
ধরা যাক সরকার এমন একটা নিয়ম করে দিয়েছেন যে আজকে থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে ১১ জনের মধ্যে মিনিমাম ৬জন খেলোয়াড় হতে হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু/বৌদ্ধ/খ্রিস্টান), ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। আপনি সাধারণ মুসলমান বাংলাদেশী হলে যত ভাল খেলোয়াড়ই হন না কেন, আপনার কম্পিটিশন হবে মাত্র পাঁচ আসনের মধ্যে স্থান পাওয়া কোটি কোটি প্রতিযোগীর বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারনে আপনার কম্পিটিশন তুলনামূলক অনেক কম প্রতিযোগীর বিরুদ্ধে লড়ে ছয়টি আসনে স্থান পাওয়া।
যেকারনে তখন দেখবেন শূন্য সরকার যতই শূন্য মারুক, ওকে দল থেকে খেদাতেই পারবেন না। কারন আর কোন "সংখ্যালঘু" ওর পর্যায়ের খেলোয়াড়ই না।
এদিকে সাধারণ কোন ব্যাটার জান প্রাণ দিয়ে দিলেও দলে সুযোগ পাবেনা কারন অন্য কোন মুসলিম ব্যাটসম্যান হয়তো ওর চেয়ে ভাল খেলবে।
আপনি বলতে পারেন এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু দিন শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হারবে।
এইটা ফ্যাক্ট।

আমেরিকায় কোটা সিস্টেম নাই। যেটা আছে তা হচ্ছে প্রতিটা মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু এবং মহিলারা যেন আর অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করা।
আপনি পড়াশোনা করতে চান। শুধুমাত্র কালো বলে আপনাকে আলাদা সুযোগ যেমন দেয়া হবেনা, তেমনই শুধুমাত্র কালো বলে আপনাকে বঞ্চিতও করা হবেনা। শুধু কালোই না, প্রতিবন্ধীদের জন্যও আমেরিকা সব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। আপনি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন, আপনি চোখে দেখতে পাননা, অথবা আপনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলেই যে শিক্ষা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেন, এমনটা ওরা করতেই পারবে না। যে করার চেষ্টা করবে, ওকে আদালতে টেনে নেয়া হবে।
বহু ত্যাগ, আন্দোলন, রক্তের বিনিময়ে মাইনোরিটিরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছেন। তাঁদের আন্দোলন এই ছিল না যে আমরা কালো, আমাদের চাকরি দাও। ওদের আন্দোলন ছিল, আমরা কালো, আমাদের শিক্ষার সমান সুযোগ দাও, চাকরির সমান সুযোগ দাও।
দুই ক্ষেত্রে মানসিকতার পার্থক্য বুঝতে পারছেন?
আমাদের দেশে এইসব কোটামোটা বাদ দিয়ে বরং ফোকাস হওয়া উচিত প্রতিটা বাসিন্দা, সে বাংলাদেশী বাঙালি হোক, পাহাড়ি হোক, শিক্ষার জন্য সমান সুযোগ পাবে। চাকরির সমান সুযোগ পাবে। যেখানে ওদের প্রতি অন্যায় করা হবে, সাথে সাথে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। আমেরিকায় যেমন অনেক কালো আছে রেসিজ্ম গেম প্লে করে (আমি কালো বলে আমার প্রতি এইটা করা হয়েছে), আমাদের দেশেও তেমনটা হবে। কিন্তু আদালত সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। এমন না হলে আমরা আজীবন দক্ষিণ এশিয়ার একটা অতি ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে পড়ে থাকবো।

শুনতে খারাপ লাগলেও আমরা ভিখারি জাতে পরিণত হয়েছি। আমাদের মন মানসিকতাই এমন হয়ে গেছে যে আমাকে যেকোন শর্তে একটি সরকারি চাকরি দাও, ঘুষ আমি নিজেই খেয়ে নিতে পারবো।
আমার নানা/দাদার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আছে, সেই ভিত্তিতে আমাকে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দাও। তুমি এতে দ্বিমত পোষণ করলে তুমি রাজাকার!
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই অবিবেচকের মতন বলেন, হয় আপনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়তো রাজাকার! এ কেমন কথা? উনার বয়স হয়ে গেছে, বয়স্ক মানুষের শিশুদের মতন কিছু চিন্তাভাবনা না করে কথাবার্তা বলে। সেটাই দেখছি।

সবাই বলছেন বর্তমান প্রজন্ম কেন গর্বের সাথে বলছে যে সে রাজাকার!
ওরা কি নেপথ্যের কারনটা বুঝতে পারছে না? দেশের অভিভাবক, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অমন কথায় অভিমানে ওদের আর কি কোন কিছু বলার অবকাশ আছে? আমি নিজেও কোটাবিরোধী, জীবনেও কোটার কোন সুযোগ নেই নাই, জীবনেও আমার বাপ গিয়ে কাউকে আমাদের জন্য সুপারিশও করেনাই। অনেক কিছুই পাইনাই জীবনে। সেগুলো পেলে হয়তো জীবন অন্যরকম হতো। আবার যা পেয়েছি, সেটা যতই ক্ষুদ্র হোক, নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি, তাই সেগুলো মাথায় তুলে রেখেছি।

এই সেদিনই আমার এক মুক্তিযোদ্ধা আংকেলের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, উনার পরিচিত এমন অনেকেই আছেন যারা একাত্তরের নয়মাস পালিয়ে বেরিয়েছে, কিন্তু ওদের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট আছে। ভুয়া। রাষ্ট্রকে ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার জন্য নিজেদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাগিয়ে নিয়েছে। এদিকে নিজের জীবনের পরোয়া না করে, নিজের পরিবারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাতের আঁধারে পালিয়ে তিনি যুদ্ধে গেলেন, তিনি কিছুতেই মানতে পারেন না তাঁর সেই দেশকে এই লুটেরারা খুবলে খাচ্ছে। তাঁর দেশে তাঁরই পৈতৃক জমিজমা নিয়ে সরকারি দপ্তরে তাঁকে হেনস্থার শিকার হতে হয়। ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর কাছে ঘুষ চায়। ঘুষ! কিছু শূকরছানাকে ঘুষ খাওয়ানোর জন্য তিনি সেদিন পাখি মারা বন্দুক নিয়ে মেশিনগান হাতের মিলিটারি মারার পণ নিয়ে বাড়ি মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছিলেন?
রাগে, ক্ষোভে, অভিমান ও অপমানে তিনি দেশ ছেড়েছেন। আর কখনই ফিরবেন না বলে কসম খেয়েছেন। তিনি এখন দেখা হলেই বলেন, "ওটা আমার দেশ না।"
অথচ চোখের কোণে বিষাদটা লুকাতে পারেন না।

হেলমেট পরে ছাত্রলীগ এর আগেও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছিল। ওদের দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক।
আজকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পিটালো। ওদের দাবি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাদ দিয়ে মেধাকে বিবেচনায় নেয়া হোক।
ইজরায়েলি জায়নবাদী ইহুদিরা যেমন নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিক্টিম কার্ড প্লে করে, আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধ প্লেকার্ড চালু হয়েছে। আপনি ন্যায্য কিছু দাবি করলেও ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে মুক্তিযুদ্ধ টেনে এনে আপনাকে বলবে "আপনি মুক্তিযোদ্ধার নাতির কোটা বিরোধী, মানে আপনি মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী, মানে আপনি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, মানে আপনি স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শত্রুর দলের লোক! আপনি রাজাকার!"

শংকা হয়, সেই আংকেলের মতোই দিনে দিনে বহু লোক বাড়বেন যারা চোখের কোণের বিষাদ আর বুকের কষ্ট চাপা দিতে দিতে বলবে "ওটা আমার দেশ না।"
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:৪৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×