আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে "বাংলাদেশে কী শরিয়া আইন চালু হওয়া উচিৎ?"
আমি সাথে সাথেই উত্তরে বলবো "না। উচিৎ না।"
প্রশ্নকর্তা যদি বলেন, "ভাল করে চিন্তাভাবনা করে বলুন।"
আমি ভাল করে চিন্তাভাবনা করে আবারও বলবো, "না। উচিৎ না।"
অনেকের চোখ কপালে উঠে যাবে। কিছুদিন আগে ব্যান হওয়া এক ক্যানভাস সদস্যের ভাষায় বলতে শুরু করবেন "যে প্রতিটা লেখায় 'কোরান হাদিস মারায়' সে এসব কী বলছে? এতো মুনাফেক!"
তারপর আমার প্রোফাইল ঘাটাঘাটি হবে। দেখা হবে আমার সাম্প্রতিক কিছু ছবি। আমি নববর্ষের দাওয়াতে গিয়ে ভাত-মাংস-ইলিশ খেয়ে ছবি তুলেছি।
দেখা যাবে আমি এখানে একটি রেডিওর সাথে যুক্ত আছি।
দেখা যাবে আমি বাংলাদেশের কিছু বিখ্যাত ব্যান্ড শিল্পীর সাথে আড্ডাবাজি করেছি।
এবং দেখা যাবে আমার বৌর মুখে কোন পর্দা নাই। কাজেই - আমি মুনাফেক। আমি দাজ্জাল। আমাকে কোপানো জায়েজ।
"নারায়ে তকবির! আল্লাহু আকবার!"
যাই হোক, এখন বলি কেন বাংলাদেশে ইসলামী শাসন/খেলাফত উচিৎ না।
একটা ক্ষুধার্ত ফকিরকে আমি যদি রানীর মুকুট থেকে কোহিনূর খুলে এনে ধরিয়ে দেই, সেই ব্যাটা মাত্র একশ টাকায় কোন মুদির দোকানির কাছে সেটা বিক্রি করবে। তারপর সেই টাকায় সে প্রথমে নিজের উদরপূর্তি করবে। তারপর যদি কিছু বাঁচে, তাহলে বিড়ি, সিগারেট, গাঁজা বা মদ - এইরকম সৌখিনি শখ পূরণ করবে। তারপর আবার থালা হাতে ভিক্ষায় নামবে।
উদাহরনটির মূল কথা হচ্ছে, কাউকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন দামী বস্তু ধরিয়ে দেয়া উচিৎ নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সেটার যোগ্য হয়ে উঠে।
আমাদের দেশে এখনও ইসলামী আইন প্রচলিত হয়নি, তাতেই আমরা কুপিয়ে মানুষ মারছি। যদি প্রচলন ঘটে, তাহলেতো দেশে কেয়ামত নামিয়ে ফেলবো।
ভাবতে চমৎকার লাগে, আমরা হজরত উমারের (রাঃ) মতন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবো। বাস্তবে দেশটা আরেকটা আফগানিস্তান হবে। কিংবা হবে আরেক পাকিস্তান। কারন আমরা একই অঞ্চলের জনগণ। নিজের মতবাদের বিরুদ্ধ কিছু নিতেই শিখিনি।
শরিয়া আইন ঠিক পারমানবিক শক্তির মতন। প্রয়োজনে মানব কল্যানে ব্যবহার করা যায়। আবার ভুল হাতে পড়লে মানব সভ্যতা ধ্বংসেও এর জুড়ি মেলা ভার। আমরা খলিফায়ে রাশেদীন, হারুনুর রশিদদের স্মৃতি চারণ করে তৃপ্ত হই, কিন্তু বর্তমানে আইসিস শরিয়ার নামে যা করছে তাই বাস্তবতা। এটাই করবে বাংলাদেশ।
আমাদের দেশটা নিশ্চিত ভাবেই ভুল মানুষে ভরপুর। কাজেই "খিলাফত প্রতিষ্ঠা" নিয়ে উচ্চবাচ্চ না করাই ভাল।
কেউ যদি বলে "আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অ্যামেরিকা এবং চায়নাকে হটিয়ে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে।" - তাহলে কয়জন সেটা বিশ্বাস করবে?
অথচ তৎকালীন সুপার জায়েন্ট রোমান এবং সাসানিড এম্পায়ারকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সভ্যতা বিবর্চিত মরু আরবরা হটিয়ে দিয়েছিল - এইটাতো ঐতিহাসিক সত্য। জ্বী, আল্লাহ চেয়েছিলেন বলেই এটা হয়েছিল। কারন সাহাবীরা, বিশেষ করে উমার (রাঃ), যোগ্য ছিলেন বলেই এমনটা হয়েছে।
এবং কয়েক শতাব্দী পুরানো শক্তি হবার পরেও মুসলিমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার খেয়ে গেল। এইটাও আল্লাহরই ইচ্ছে। কারন আমরা তখন অযোগ্য হয়ে পরেছি। এইটাও ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট।
বুদ্ধিমান মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। বেকুবরাই ইতিহাসকে অস্বীকার করে।
আমার যুক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে আরও কিছু উদাহরণ দেই। দেখি ব্যপারটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারি কিনা।
হাদিসে আছে, "সেই ব্যক্তি জাহান্নামী, যে নিজে উদরপূর্তি করে রাতে ঘুমাতে গেল, অথচ তাঁর প্রতিবেশী অনাহারে রাত কাটালো।"
নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, কয় কোটি মানুষ একবেলা না খেয়ে থাকে সেই হিসাব আছে? অথচ আমরা ফালাফালি করি, "মিয়ানমারের মুসলমানদের নিয়ে কেউ কেন লিখলো না? বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের নিয়ে যে লিখেনা, তার হাদিস মারানির কোন অধিকার নাই। মুনাফেক।"
হাদিসে আছে, "সেই ব্যক্তির জান্নাতে যাওয়া নিশ্চিত যে অন্যের পথ থেকে কাঁটা (আবর্জনা) সরিয়ে দেয়। একই সাথে সেই ব্যক্তিরও জাহান্নামে যাওয়া নিশ্চিত যে অন্যের চলার পথে আবর্জনা ফেলে রাখে।"
নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, রাস্তাঘাটে হাঁটার সময়ে ফুটপাথ থেকে চোখ তোলা যায়না মানুষের থুথু, কফ এবং আবর্জনার যন্ত্রনায়।
এখন আমাকে বলুন, অতি সহজ কিছু নির্দেশ পালনেই যেখানে আমরা ব্যর্থ, সেখানে "ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার" জন্য আমরা কী যোগ্য?
এক ব্যক্তি নবীজির (সঃ) কাছে এসে বলল, "আমি জিহাদে অংশ নিতে চাই। আমাকে আমার মা বাবা আসতে দিতে চাচ্ছিলেন না। তাঁরা কাঁদছিলেন। কিন্তু আমি তাঁদের বাঁধা না মেনে চলে এসেছি। আমাকে আপনার সাথে জিহাদে নিন।"
আমাদের নবীজি (সঃ) কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলতেন না। কিন্তু এই তরুণ সাহাবীকে তিরষ্কার করে বললেন, "তুমি এখুনি তোমার মা বাবার কাছে ফেরত যাও। যেভাবে তুমি কাঁদিয়েছো, সেভাবেই তাঁদের মুখে হাসি ফোটাও। ওটাই তোমার জিহাদ।"
বলা হয়েছে, "নিজের পিতামাতার সেবা কর। যদি পিতামাতা মারা গিয়ে থাকে, তবে তাঁদের বয়সী কারোর সেবা কর ঠিক যেমনটা নিজের পিতামাতার করতে।"
মানে আমি যদি কোন বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে অসহায় অবস্থায় দেখি, তখন কোন কিছু চিন্তা না করেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবো। আমার হাতে আমার আল্লাহ বা নবীজি (সঃ) আর কোন অপশন বাকি রাখেননি।
কথা হচ্ছে, নব্বই শতাংশ মুসলিমের দেশে যার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, কয়টা বৃদ্ধাশ্রম আছে? কয়জন বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে ভিক্ষা করে খেতে হয়? অনাহারে মরতে হয়?
"দ্বীনের ব্যপারে কোন জবরদস্তি নেই।"
"তোমরা বিধর্মীদের কোন দেবদেবীদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলো না, নাহলে ওরাও তোমাদের আল্লাহ এবং নবীকে (সঃ) নিয়ে বাজে কথা বলবে।"
"কারোর উপাসনাস্থল ভাংচুর না।"
"তোমরা আমাদের উপাসনায় বাঁধা দিওনা, আর তোমাদের উপাসনায় যদি কেউ বাঁধা দেয় তবে তোমরা সরাসরি আমাকে (উমার (রাঃ)) জানাবে, আমি ন্যায় বিচার পাইয়ে দেব।"
আমাদের দেশে প্রতি বছর কয়টা মন্দির ভাংচুর হয়? সংখ্যালঘু অত্যাচার ঘটনা কতটা স্বাভাবিক? মানুষ মরলে প্রথমেই হাইলাইটেড হয় "ও ছিল একজন ব্লগার," "ও ছিল একজন মালাউন," "ও ছিল একজন সেতার বাদক!"
জ্বী ভাই। আমরা মেয়েদের সেক্স ভিডিও তৈরী করে ব্ল্যাক মেইল করা বিশিষ্ট শিক্ষক পরিমলকে কিচ্ছু বলিনা, অথচ সেতার বাজানোর অভিযোগে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করি। আমরাই খিলাফত প্রতিষ্ঠা করব! খুউব আনন্দ! আসেন কোলাকুলি করি।
বলা হয়েছে "যে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করলো, সে যেন পুরো মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করলো।"
অথচ কেউ বিপদে পড়লে আমরা হিসাব করি সে কি মুক্তমনা, সে কি সমকামী, নাকি সে বিধর্মী!
একটি মেয়ে ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছে - হিজাব ছিল, ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ছিল - অথচ একদল পারভার্ট "নাট্যকর্মী" ছিল বলে সেই অপরাধকে লঘু প্রমান করার চেষ্টা করছে।
মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের অলিতে গলিতে মসজিদ। নামাজ পড়া ছাড়া যেখানে মোটামুটি আর কিছুই হয়না। অথচ বিদেশে, আমাদের অ্যামেরিকান মসজিদ কী করে সেটা বলি।
প্রতি রমজান মাসে কমিউনিটি ইফতারের ব্যবস্থা থাকে। সবাই মিলে একসাথে এক পরিবারের মতন ইফতার করেন। ফার্স্টক্লাস ইফতার। ধনী গরিব কোন পার্থক্য থাকেনা। এতেই ভ্রাতৃত্ব বাড়ে।
ঈদের নামাজের পর কমিউনিটি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা থাকে।
প্রতি শনিবার ফজরের নামাজ শেষে কমিউনিটি ব্রেক ফাস্ট।
এছাড়া মহররম বা বিশেষ বিশেষ অকেশনেও থাকে কমিউনিটি ডিনার, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ।
যারা অর্থকষ্টে থাকে, যাদের বাড়িতে রান্না হয়না, তাঁদের জন্য খাওয়া খাদ্যের কী সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে লক্ষ্য করছেন?
এছাড়া থাকে সাপ্তাহিক হালাকাহ। এশার নামাজের পর জীবন কিভাবে সুন্দর করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে হয় আলোচনা।
যুবকদের জন্য থাকে আলাদা আলাদা প্রোগ্রাম। মেয়েদের জন্যও থাকে স্পেশাল কিছু ইভেন্ট। এমন কি শিশুদের জন্যও তাই।
থাকে কমিউনিটি ক্লিনিক, যারা ডাক্তারের ফীস দিতে পারেন না, তাঁদের জন্য ফ্রি ডাক্তারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
ট্যাক্স সিজনে থাকে ফ্রি ট্যাক্স ফাইলিং এক্সপার্ট। বিনা পয়সায় ট্যাক্স ফাইল করে দেয়। সাধারণত বাইরে থেকে করলে যেখানে একশ ডলারের মতন লাগে।
এছাড়াও ইন্টারফেইথ আলোচনা চলে। খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকদের সাথে আলোচনা চলে। ওরা আমাদের এখানে আসে, মুসলিমরা চার্চে যায়। রবিবার ওদের চার্চের পার্কিং লট ভরে গেলে ওরা আমাদের মসজিদের পার্কিং লটে পার্ক করে, শুক্রবারে আমরা ওদের চার্চে গাড়ি পার্ক করি।
কুরবানির ঈদের সময়ে তিনভাগের একভাগ মাংস যেটা গরিবদের দান করা হয়, সেটা ওরা নিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে দিয়ে আসে। ক্ষুধার্ত মানুষদের জন্য কিছুদিন পরপর "ফুড ড্রাইভ" চালানো হয়।
শীতার্থদের জন্য কম্বল তোলা হয়। মানুষ কম্বল কিনে এনে মসজিদের ভিতর রাখা বিরাট কাগজের বাক্সে ফেলে দেয়। মসজিদ কমিটি যথাস্থানে পৌছে দেয়।
চলে "পিস ওয়াক" কর্মসূচি।
এইরকম আরও অনেক কিছু।
এখন বলেন, কাফের নাসারার অ্যামেরিকা কী আমাদের "মুসলিম রাষ্ট্র" বাংলাদেশ থেকে ভাল করছে না?
কেন? কারন আমরা, মানে বাংলাদেশের মুসলিমরা হচ্ছি সেই ভিখারী, যার হাতে কোহিনূর ধরিয়ে দিলে আমরা মুদির দোকানে বিক্রি করে ভাল করে উদরপূর্তি করবো। তারপর কিছু বাঁচলে সৌখিনি শখ মেটাবো। এবং তারপরের বেলাতেই থালা হাতে ভিক্ষায় নামবো।