"ভাই ক্যানভাসের লেখাগুলো কী আপনার নিজের?"
ইনবক্সের এই প্রশ্নটা খুবই বিরক্তিকর। মেজাজ খারাপ হবার মতই।
আমি কখনও কারোর লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেইনা। গ্রুপে এমন কাউকে করতে দেখলে সাথে সাথে বহিষ্কার করি। লেখাচোররা আমার দুই চোখের বিষ। অথচ এই প্রশ্নটা আমারই ইন্টেগ্রিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
স্বাভাবিক, মেজাজ খারাপ হলো।
"জ্বী ভাই, ক্যানভাসে নকল করা লেখা ছাপা হয়না।"
"রাগ করবেন না ভাই। এমনিই প্রশ্ন করেছি। আপনার নিজের মুখ থেকে শুনে ভাল লাগলো।"
বুঝে গেলাম প্রশ্নকর্তার বয়স বেশি না।
সাথে লিখলো, "আমি এইচ.এস.সি ক্যান্ডিডেট। আপনার আজকের লেখাটা ("স্কুলের রেজাল্ট দিয়ে বাবা মারা যেন বাচ্চাদের দূরে ঠেলে না দেন" - বিষয়ের উপর লেখা) খুবই ভাল লাগলো। আবার খুব খারাপও।"
আমার লেখা ভাল লেগেছে শুনে ভাল লাগলো। খারাপ লাগলো শুনে অবশ্য খারাপ লাগলো না। আমার লেখা ভাল লাগা পাবলিকের সংখ্যাই বরং কম। দেখেন না, ইদানিং গ্রুপে মানুষ কিভাবে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচ্ছে?
"এইটা কেন লিখলেন? ঐটা কেন লিখেন নাই?" অতি ধার্মিকেরা বলে "আপনি মুনাফেক!" অতি নাস্তিকেরা বলে "আপনি ছুপা ছাগু!"
"না ভাই, রাগ করিনাই। তবে লেখাটি তোমার জন্য না। তোমার মা বাবাকে পড়াও।"
ছেলেটা জানালো তাঁর মা বাবা নেই।
শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আমার বাবা মারা গেছেন আমি যখন নিজের খাবার নিজে কিনে খেতে পারি। নিজের থাকার জন্যও কারোর উপর নির্ভর করতে হয় না। তারপরেও মনে হয়েছিল হঠাৎ করেই আমি যেন গৃহহীন হয়ে গেছি। হঠাৎ করেই উপলব্ধি হলো, এখন থেকে আমার যাবতীয় সমস্যা আমার নিজেকেই সমাধান করতে হবে, সব সমস্যার সমাধান নিয়ে বাবা আর কোনদিন হাসিমুখে এগিয়ে আসবেন না। তখন আমার বয়স ছাব্বিশ। যদি বয়স বাষট্টিও হতো, আমি নিশ্চিত, তখনও একই উপলব্ধি হতো।
অথচ এই ছেলে মাত্র কলেজে পড়ে। এইচএসসির মতন জীবনের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে কেউ নেই মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন, "ভয় নেই ব্যাটা! নিজের উপর ভরসা রাখ। তোকে দিয়েই হবে।"
"আমি দুঃখিত।"
"ভাইয়া, একটা রিকুয়েস্ট রাখতে হবে।"
"বল।"
"কিছুদিন আগে একটা ডাক্তার আপুর ঘটনা শুনেছেন যে ছিনতাইকারীদের শিকার হয়ে কয়েক বছর ধরে কোমায় আছে?"
"হ্যা।"
"আমি ক্লাস টেনে থাকতে আমার আম্মার সাথেও ঠিক একই কাজ হয়। অনেক বড় ঘটনা, আম্মা সাত দিন কোমায় থাকার পর আল্লাহর কাছে চলে গেছে। যেই ছেলেগুলা কাজটা করছে, ওরা অনেক ভাল ফ্যামিলির, দেখতে শুনতেও ভাল, আমি নিজেই ছিলাম ওইদিন আম্মার সাথে।রিক্সায়। আমার আম্মার জন্য না, তবে এসব কাজ যারা করে, তারা তো কয়েকটা টাকা, ফোন এগুলা পাওয়ার জন্য এসব করে, কিন্তু তারা হয়তো জানেও না, যে তারা কারো শেষ আশ্রয়টুকুও হয়তো কেড়ে নেয়। আমি অনেক সাফার করছি, আরো করবো। তবে এরা যাতে চেঞ্জ হয়, নিজের মেন্টালিটি চেঞ্জ করে, এর জন্য কিছু একটা লিখবেন। আমার ভালো লাগবে। আমি অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, আপনাকে এটা বলবো। সময় পেলে লিখার চেষ্টা করবেন।এতটুকুই।"
ছেলেটির ঘটনা শোনার পর থেকে মাথাটা একদম খালি হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধুর বাবাকেও এইভাবে সামান্য কিছু টাকার জন্য পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিল ছিনতাইকারী। আঙ্কেলও সেদিন বাঁচতে পারেননি। পিতৃহীন বন্ধুটির কষ্ট আমি নিজের চোখে দেখেছি।
কথা হচ্ছে, এমন ঘটনাতো এখন প্রতিদিনই ঘটছে। কিন্তু এই বিষয়ে লেখালেখি করার কোন ক্ষমতা কী আমার আছে? আমি, আপনি, আমরা সবাই লিখলেই কী কিছু ঘটবে? আমাদের লেখালেখিতে কী কখনও ছেলেটার কষ্টটা ফুটে উঠবে? ছেলেটা কোন সান্তনা পাবে? জানোয়ারগুলি শুধরাবে? সবচেয়ে বড় কথা, ওরা কী পড়ে? বই পড়তে হলে একটি সুন্দর মনের প্রয়োজন হয়। সেই মনটা কী তাদের আছে?
মাত্র কয়েকটা টাকার জন্য একটি ছেলের কাছ থেকে তাঁর মাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ওরা কী করেছে সে টাকা দিয়ে? নেশা? ড্রাগস? ইয়াবা?
কতটা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি আমরা সেটা কী উপলব্ধি করছি?
কুকুর পাগল হলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়। নাহলে কামড়ে অন্যের জলাতঙ্কের কারন হয়।
আমাদের দেশে এখন অনেক পাগলা কুকুর বেড়ে গেছে। অনেক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:১১